You dont have javascript enabled! Please enable it!

লক্ষ্মীপুর গণহত্যা (আটঘরিয়া, পাবনা)

লক্ষ্মীপুর গণহত্যা (আটঘরিয়া, পাবনা) সংঘটিত হয় ২০শে আগস্ট। এদিন লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিতে হানা দিয়ে ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালায় এবং বহু মানুষকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে আটঘরিয়ার দেবোত্তর, বংশীপাড়া, গড়রী, আটঘরিয়া বাজার এবং একদন্তের বেলদহ এলাকার মধ্য সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয় এই লক্ষ্মীপুর গ্রামে। এদিন লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ডা. এম এ গফুরকেও হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের এই সময়ে পাবনায় ভয়াবহ বন্যায় চারদিক ডুবে যায়। পাবনা শহরের রাস্তাঘাটে নৌকা চলাচল করে। এমনি অবস্থায় পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের দোসরদের নির্মম অত্যাচারে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। একদিকে খাদ্য সংকট, অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর নির্যাতন। এর ফলে মানুষ চরম বিপাকে পড়ে। এলাকার মানুষ বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবার, আওয়ামী লীগ সমর্থক পরিবার এবং তরুণরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দূরের গ্রামসমূহে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বিভিন্ন এলাকায় শহর থেকে এসে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলোর ওপর লুটতরাজসহ নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় স্বাধীনতাবিরোধী এবং অনেক এলাকায় স্থানীয় দুর্বৃত্তরা অংশ নেয়। এলাকায় তখনো মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন তৎপরতা শুরু হয়নি।
পাবনার বিভিন্ন এলাকায় অবরুদ্ধ অসহায় মানুষের ওপর পাকসেনাদের আক্রমণ এবং হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ বেড়েই চলে। আটঘরিয়ার পার্শ্ববর্তী হাদল এবং ডেমরায় ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। এসব গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা হানা দিয়ে শতশত লোককে গুলি করে হত্যা করে এবং ঐসব গ্রামের যুবতী, কিশোরী এমনকি শিশুদেরও ধর্ষণ করে। ডেমরায় প্রায় সাড়ে আটশ লোককে হত্যা করা হয়। পাকসেনারা লক্ষ্মীপুর গ্রামেও হামলা করে।
২০শে আগস্ট শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গ্রামের মানুষ স্থানীয় মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় গোটা গ্রাম জুড়ে হৈচৈ, দৌড়াদৌড়ি আর কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। মাঝে-মাঝে গুলির শব্দও শোনা যায়। মানুষজন উত্তরদিকে বিলের মধ্য পালাতে থাকে। কিন্তু গ্রামের হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা এবং তাদের কাছে আশ্রয় নেয়া হিন্দু পরিবারগুলো পালাতে পারেনি। পাকসেনারা সেসব পরিবারের পুরুষদের ধরে এক জায়গায় জড়ো করে এবং নারীদের ওপর নির্যাতন, ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। এরপর হানাদাররা বহু মানুষকে গ্রাম সংলগ্ন ইছামতি নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে খোরস্রোতা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এছাড়া উক্ত গ্রামের ২৮ জনকে কালী মন্দিরের বিগ্রহের সামনে এনে হত্যা করা হয়।
লক্ষ্মীপুর গ্রামে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডব চালিয়ে হানাদার বাহিনী গ্রামের পশ্চিম দিকে কৈজুরী শ্রীপুর বাজারে গিয়ে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ডা. এম এ গফুরকে আটক করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অভিযোগে তাঁকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। এ-সময় তাঁর সামনে থাকা রেডিওতে তাঁরই গাওয়া গান পরিবেশিত হচ্ছিল। সে শিল্পী একথা পাকসেনাদের বলার পরও তাদের মন গলাতে পারেননি। এরপর এই মরমী শিল্পীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাশের ইছামতি নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সে-সময় বাজার থেকে অজ্ঞাতনামা আরো একজনকে ধরে একইভাবে হত্যা করা হয়।
লক্ষ্মীপুরে সেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে যারা নিহত হন, তাদের কয়েকজন হলেন- অধীর চন্দ্র দাস (পিতা মোহন দাস), অখিল চন্দ্র চন্দ (পিতা ক্ষিতীশ চন্দ্র চন্দ), অবনী চন্দ্র দাস (পিতা তারাপদ দাস), অশ্বিনী কুমার সর (পিতা অক্ষয় কুমার সর), অনীল চন্দ্র দাস (পিতা মেঘলাল দাস), অমল কুমার হালদার (পিতা চৈতন্য হালদার), আশুতোষ দত্ত (পিতা রতিলাল দত্ত), কানাই লাল দাস (পিতা কুশল দাস), কুশল চন্দ্র পাল (পিতা মনোহর পাল), কমল চন্দ্র পাল (পিতা মনোহর পাল), গৌর চন্দ্র ভদ্ৰ (পিতা চন্দন ভদ্র), গোপাল চন্দ্র দাস (পিতা মোহন চন্দ্ৰ দাস), তারাপদ দাস (পিতা কালীচরণ দাস), তারাপদ হালদার (পিতা মুকুন্দ হালদার), ধীরেন্দ্র নাথ চর (পিতা রাধাকান্ত চর), নিজাম উদ্দিন শেখ (পিতা কুশাই শেখ), নিরঞ্জন পাল (পিতা মনোহর পাল), নরেশ চন্দ্র দাস (পিতা গোড় চন্দ্ৰ দাস), ব্রজগোপাল সর (পিতা সদানন্দ সর), বিমল চন্দ্ৰ দাস (পিতা বিষু চন্দ্র দাস), ভাদু মোল্লা (পিতা জব্বার মোল্লা), মোহন দাস (পিতা মিরণ দাস), সূর্যকান্ত দাস (পিতা যুগল চন্দ্ৰ দাস), সদানন্দ সর (পিতা রমানন্দ সর), সনাতন দত্ত (পিতা রসিক দত্ত), সুরেন্দ্র নাথ দাস (পিতা মেঘলাল দাস), হারান লাল হালদার (পিতা রসিক লাল হালদার) ও রতিলাল দত্ত (পিতা গরানাথ দত্ত)। [আমিরুল ইসলাম রাঙা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!