You dont have javascript enabled! Please enable it!

রায়পুর গণহত্যা (দাউদকান্দি, কুমিল্লা)

রায়পুর গণহত্যা (দাউদকান্দি, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় ২৩শে মে। রায়পুর কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার জিংলাতলী ইউনিয়নের একটি গ্রাম। গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পূর্বে এবং ইলিয়টগঞ্জ বাজারের পশ্চিম পাশে এর অবস্থান। গ্রামটির পূর্বে বাহাদুরখোলা ও সিঙ্গুলা গ্রাম, পশ্চিমে বানিয়াপাড়া গ্রাম, দক্ষিণে মালিখিল ও ধিপপুর গ্রাম এবং উত্তরে ভিটিচারিপাড়া গ্রাম। গ্রামটির ওপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চলে গেছে। পাকবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা এ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে ১২ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে।
রায়পুর গ্রামের আবু বাছেত, আদমপুর গ্রামের আব্দুস সামাদ এবং সিঙ্গুলা গ্রামের কবির উদ্দিন ভূঁইয়া ভারতে গ্রেনেড চার্জের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে ২১শে মে দেশে আসেন। তাঁদের আগমনে স্থানীয় রাজাকাররা ভীত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ২২শে মে মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় রাজাকার ঈমান আলীর বাড়িতে একটি গ্রেনেড চার্জ করেন। এ খবর পাকসেনাদের জানিয়ে দিলে পরদিনই তারা রায়পুর গ্রামে এসে হানা দেয় এবং এ গ্রামের ১০ জনসহ মোট ১২ জনকে হত্যা করে।
২৩শে মে দুপুর বেলা হঠাৎ পাঞ্জাবি সৈন্যরা রায়পুর গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এ খবর পেয়ে গ্রামের, বিশেষত হিন্দুপাড়ার লোকজন আতঙ্কে দিকবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। তাদের কেউ-কেউ ধানক্ষেতে, কেউ-বা পরিচিত মুসলমানদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শরৎচন্দ্র সরকার নামে একজন তখন রায়পুর খালের পাড়ে ছিলেন। পাকসেনা আসার খবর শুনে তিনি দ্রুত বাড়ি এসে নারী ও শিশুদের পালানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু নিজে পালানোর আগেই পাকসেনারা তাকে ধরে ফেলে এবং ব্রিজের কাছে নিয়ে হত্যা করে। তার বাড়ির তিনটি ঘরে পাকসেনা ও রাজাকাররা লুটপাট চালায় এবং আগুন দেয়।
সুধীর বণিক নামে সাধু প্রকৃতির একজন লোক ৬ ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু আবার ঘরে গিয়ে তিনি আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনায় বসেন। এরই মধ্যে পাকসেনারা তাঁকে খালপাড়ে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাঁর বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেয়। একই সময়ে শীতল চন্দ্র সরকার নামে আরেকজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে এবং তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধা কবির উদ্দিন ভূঁইয়া এ গণহত্যার সময় ব্রিজ থেকে কিছুটা দূরে ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন। তিনি দেখতে পান যে, পাকসেনারা হিন্দু বাড়িগুলো থেকে লোকজনদের ধরে এনে খালপাড়ে লাইনে দাঁড় করায়। তারপর সবাইকে গুলি করে মৃতদেহগুলো লাথি মেরে খালে ফেলে দেয়। পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর তিনিসহ আরো অনেকে কাছে এসে দেখেন গুলিতে শহীদদের মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এবং বেশির ভাগের মগজ বের হয়ে এসেছে। পরে স্বজনরা এসে লাশগুলো নিয়ে যায়।
২৩শে মে গণহত্যায় রায়পুর গ্রামের শহীদরা হলেন- ডা. পাণ্ডব দেবনাথ (পিতা রাম মাণিক্য দেবনাথ), শীতল চন্দ্ৰ সরকার (পিতা বলরাম সরকার), পাণ্ডব সাহা (পিতা কেবলা সাহা), বিদেশিনী সাহা (স্বামী পাণ্ডব সাহা), ফেলান সরকার (পিতা রাজারাম সরকার), শরৎ চন্দ্র সরকার (পিতা জয়চন্দ্র সরকার), সুধীর বণিক (পিতা লালমোহন বণিক), কামিনী সুন্দরী দেবনাথ (পিতা নরেন্দ্র দেবনাথ) এবং উমেশ সরকার ওরফে হারাই মিস্ত্রী (পিতা রমেশ চন্দ্র সরকার)।
রায়পুর গ্রামে গণহত্যা চালানোর পর পাকসেনারা পার্শ্ববর্তী আদমপুর গ্রামে আরো দুজনকে হত্যা করে। তারা হলেন- অনুকূল সরকার ও নুরু মিয়া। পাকসেনাদের আসতে দেখে অনুকূল সরকার পাটক্ষেতে লুকিয়েছিলেন। কিন্তু পাকসেনারা তাকে দেখতে পেয়ে ধরে এনে আদমপুর মসজিদের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। নুরু মিয়ার বাড়ি ছিল কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার রামহন গ্রামে। আদমপুরে তিনি তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। পথে জনৈক কালা মিয়ার বাড়ির কাছাকাছি এলে পাকবাহিনী তাকে ধরে ফেলে এবং সেখানেই গুলি করে হত্যা করে।
ঘটনার কয়েকদিন আগে রায়পুরের রামদয়াল দেবনাথের ছেলে অনাথ দেবনাথ ইলিয়টগঞ্জ বাজারে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে স্থানীয় দালালরা পাকসেনাদের দেখিয়ে দিয়ে বলে যে, সে হিন্দু। সঙ্গে-সঙ্গে পাকসেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। রায়পুরে গণহত্যা চালানোর পর পাকসেনা ও তাদের দোসররা স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের বাড়িতে লুটপাট করে এবং আগুন দেয়। এ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবু বাছেত ২৩শে মে সকালে পাশ্ববর্তী কচুয়া উপজেলার সাচারে অপারেশনে যান। পাকসেনারা তাঁদের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে না পেয়ে তাঁদের দুটি ঘরে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন দেয়। আদমপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদের বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁদের ৪টি ঘরে আগুন দেয়। পার্শ্ববর্তী বাড়ির আব্দুল গনি মিয়ার বসত ঘরটিও আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। এখান থেকে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদের চাচা মোহাব্বত আলীকে মারধর ও নির্যাতন করে এবং তার নগদ অর্থ লুটপাট করে নিয়ে যায়। পাকসেনাদের এই তাণ্ডব দেখে আব্দুস সামাদের ভাই শামছুল হক ভয়ে স্ট্রোক করেন এবং কয়েক দিন পর মারা যান। জিংলাতলী গ্রামের বাসিন্দা সিরাজ বি.টি ছিলেন রায়পুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং দাউদকান্দি থানা আওয়ামী লীগ-এর প্রবীণ নেতা। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সংগঠিত করেন। এ কারণে ২৩শে মে রায়পুর গণহত্যার পরপরই পাকসেনারা তাঁর বাড়িতে আগুন দেয়। [বাশার খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!