You dont have javascript enabled! Please enable it!

রামশীল যুদ্ধ (কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ)

রামশীল যুদ্ধ (কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৪ই জুলাই। এদিন কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে হেমায়েত বাহিনী-র মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এতে নেতৃত্ব দেন হেমায়েত বাহিনীর প্রধান কোটালীপাড়া থানা কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম। এতে পাকবাহিনীর ১৫৮ জন সৈন্য নিহত হয়। তাদের ফেলে যাওয়া প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হেমায়েত বাহিনীর দখলে আসে। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম এবং অনিল মল্লিক শহীদ হন।
ঘটনার দিন পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল মাদারীপুর ও টেকেরহাট হয়ে হেমায়েত বাহিনীর চলবল ক্যাম্পের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে। তাদের একটি দল ক্যাম্পের খুব নিকট রামশীল গ্রামে ঢুকে পড়ে। হেমায়েতের সঙ্গে তখন কমলেশ বেদজ্ঞ (১৯৭৩ সালের ১০ই মার্চ ঘাতকের হাতে নিহত) ও ধীরেন্দ্র নাথ বালা (পিতা করদা কান্ত বালা)-সহ ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের নিয়েই হেমায়েত পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন। সংবাদ বাহকদের মাধ্যমে নিকটবর্তী স্থানগুলোতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী-র কোম্পানিগুলোকে পাকবাহিনীর এ আক্রমণের খবর পাঠান এবং ত্বরিত গতিতে চলবল ঘাঁটির চারদিকে এসে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন।
রামশীল গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি খাল গৌরনদী থানার বাসাইল গ্রামের দিকে চলে গেছে। এ খাল দিয়ে হানাদার বাহিনী আসতে পারে ভেবে হেমায়েত উদ্দিন পূর্বদিক মুখ করে ৩ জন করে দুটি গ্রুপে এবং সংকেত দেয়ার জন্য উঁচু একটি গাছের ডালে অবস্থান নেয়ার জন্য একজনকে নির্দেশ দেন। বাকি ৬ জনকে নিয়ে হেমায়েত পশ্চিমমুখী হয়ে অবস্থান নেন। এ ৬ জনের কাছে ছিল একটি মেশিনগান এবং ২টি এলএমজি। ৩ জনের গ্রুপদুটির প্রত্যেকটিতে ছিল একটি করে এলএমজি। তিনি অন্য কোম্পানিগুলোর পৌঁছার অপেক্ষা না করে দ্রুত স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়েই প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন। রামশীল খাল হয়ে পাকবাহিনী অগ্রসর হতে পারে ভেবেই হেমায়েত নিজে পশ্চিমমুখী হয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে গাছে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা সংকেত দেন যে, ঐ পথ ধরেই পাকবাহিনী এগিয়ে আসছে। হেমায়েত মেশিনগানের রেঞ্জে পাকবাহিনীর আসার অপেক্ষা করছিলেন। বাকি দলদুটিকে অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন করে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। পাকবাহিনীর অগ্রগামী দলটিকে লক্ষ করে হেমায়েত মেশিনগান থেকে প্রথম গুলি ছোড়েন। পাকবাহিনী পাল্টা গুলি চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের একটি গুলি হেমায়েতের দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা নায়েক মকবুলের (তিনি মেশিনগান চালাচ্ছিলেন) মাথার খুলি ভেদ করে চলে গেলে তিনি শহীদ হন। তাঁর মৃতদেহ নিতে গেলে হানাদার বাহিনীর অন্য একটি গুলি হেমায়েতের মুখের বামপাশ দিয়ে ঢুকে ডান চোয়ালের ১টি দাঁতসহ বেরিয়ে যায়। হেমায়েতের জিহ্বার একটি টুকরোও সেই সঙ্গে উড়ে যায়। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননি যে, তিনি আহত হয়েছেন। রক্তাক্ত মুখমণ্ডলটি একটি গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলেন। মকবুলের হাতের মেশিনগানটি অন্য একজনকে চালাতে নির্দেশ দিয়ে তিনি পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। ইতোমধ্যে নিকটবর্তী এলাকার অন্যান্য কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে পাকবাহিনীকে ঘিরে ফেলে প্রচণ্ডভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। ৪৫ মিনিটের বেশি সময় এ-যুদ্ধ চলে। হেমায়েত বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পাকাবাহিনী পালাতে বাধ্য হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা ছিল ১৫৮ জন। তাদের ফেলে যাওয়া প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হেমায়েত বাহিনীর দখলে আসে। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম (হেমায়েতের সঙ্গে জয়দেবপুর থেকে আসা) এবং অনিল মল্লিক শহীদ হন। যুদ্ধের পরপরই মারাত্মকভাবে আহত হেমায়েতকে স্থানীয় ডা. রাজেশ্বর রায়, ডা. সুরেন্দ্রনাথ, ডা. বেলায়েত এবং ডা রঞ্জিতের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা করানো হয়। এরপর তিনি লক্ষ্মীকান্ত বলের হিজলভিটা গ্রামের বাড়িতে আসেন। সেখানে এক রাত থেকে তিনি নৈয়ারবাড়ি গ্রামে গেদু জয়ধরের বাড়িতে এবং সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য মুকসুদপুর থানার বানিয়ারচর মিশন হাসপাতালে যান। ২৭শে সেপ্টেম্বর তিনি বানিয়ারচর খ্রিস্টান মিশন হাসপাতালে ভর্তি হন এবং মিশনের ফাদার মারিনো রিগনের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন [রবীন্দ্রনাথ অধিকারী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!