রায়গ্রাম যুদ্ধ (ত্রিশাল, ময়মনসিংহ)
রায়গ্রাম যুদ্ধ (ত্রিশাল, ময়মনসিংহ) সংঘটিত হয় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। এতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২৮শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহের ত্রিশালে অনুপ্রবেশ করে ত্রিশাল থানা সদরে নজরুল একাডেমিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। অবশ্য জেলা সদর নিকটবর্তী হওয়ায় পাকসেনারা এ ক্যাম্পে কিছু নিরাপত্তাকর্মী রেখে স্থানীয় রাজাকার, আলবদর- ও অন্য সহযোগীদের হাতে ছেড়ে দেয়। এসব ক্যাম্পে রাজাকার ও আলবদররা অবস্থান করলেও প্রায়শ পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় এসে বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করত।
মুক্তিযোদ্ধারা ভালুকার মেদুয়ারী ইউনিয়ন থেকে রাতে পায়ে হেঁটে ত্রিশাল থানার রায়গ্রাম স্কুলে হাইড আউট করেন। ত্রিশাল সদর থেকে ৭-৮ কিমি দূরে গফরগাঁও সীমান্তে নির্জন অজপাড়াগাঁ এ রায়গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধা ডা. ওয়াজেদ আলীর কোম্পানি ভারত থেকে ট্রেনিং শেষ করে রায়ের গ্রাম প্রাথমিক স্কুলে ক্যাম্প করে। এ ক্যাম্পের অধিনায়ক ছিলেন ডা. ওয়াজেদ আলী স্বয়ং। এখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ কৌশল বিষয়ে ধারণা দেন। ক্যাম্প থেকে খাবার সংগ্রহে মুক্তিযোদ্ধারা পার্শ্ববর্তী রায়গ্রামে গমন করেন। নির্জন জায়গা দেখে তাঁরা তাঁদের অস্ত্র রেখে বিশ্রাম নিতে এবং খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। খাবার সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন আজমত আলী মঞ্জুর, চাঁন মিয়া ও মেজবাউল হক। তাঁরা খাবারের আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এদিকে কয়েকজন পাকিস্তানি চর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পায়। তারা সাহায্যকারী সেজে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিশে যায়। রায়গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান থেকে কয়েক কিমি পূর্বে আমলীতলা বাজারে ছিল পাকসেনাদের দোসর রাজাকারদের ক্যাম্প। ইতোমধ্যে স্থানীয় রাজাকার ও খালেক মাস্টারের মাধ্যমে এ সংবাদ গফরগাঁও থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়। শেষ রাতের দিকে গফরগাঁও থেকে পাকসেনারা ত্রিশালের রায়গ্রামে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রস্তুত অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং এদেশীয় দোসর রাজাকাররা অতর্কিতে তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিযোদ্ধারা খাবার ফেলে দ্রুত পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী প্রতিরোধের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জয় হলেও, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধা দলের ১১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— আকরাম আলী, আবদুল হাই, আবদুল খালেক, আবদুল আজিজ, আবদুল জব্বার, আলী নেওয়াজ, মিরাজ উদ্দিন, লাল মিয়া, মকবুল হোসেন, ফজলুল হক ও শামসুদ্দিন।
এ গণহত্যায় শহীদ ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার লাশ রায়গ্রামে গণকবরে সমাহিত করা হয়। বর্তমানে সেখানে তাঁদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। রায়গ্রামের যুদ্ধ ত্রিশালের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত। ত্রিশাল উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আরো একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ৯ই ডিসেম্বর ত্রিশাল হানাদারমুক্ত হয়। [জগন্নাথ বড়ুয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড