রামনগর রেলব্রিজ যুদ্ধ (রায়পুরা, নরসিংদী)
রামনগর রেলব্রিজ যুদ্ধ (রায়পুরা, নরসিংদী) সংঘটিত হয় তিনবার – ১৩ই ও ১৪ই এপ্রিল, ১০ই নভেম্বর এবং ২৬শে নভেম্বর। প্রথম ও দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে কোনো পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তৃতীয়বারের যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও দুজন আহত হন। অপরপক্ষে ২-৩ জন পাকসেনো নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।
প্রথমবারের যুদ্ধ
৯ ও ১০ই এপ্রিল বাগবাড়ি-পাঁচদোনা যুদ্ধের পর পাকবাহিনী নরসিংদী দখল করে নিলে ক্যাপ্টেন মতিউর তাঁর বাহিনীসহ আশুগঞ্জ চলে যান। সেখানে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন নাসিমের (পরে মেজর জেনারেল) পরামর্শে ১৩ই এপ্রিল সকালে তিনি ভৈরবের পশ্চিমে রায়পুরা থানার রামনগর রেলব্রিজে প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করেন। বেলা ১১টার দিকে রেল লাইন ধরে পাকসেনারা ভৈরবের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে তিনি তাদের ওপর আক্রমণ করেন। সারাদিন তুমুল যুদ্ধের পরও পাকবাহিনী ভৈরবের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। রাতভর প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে। পরদিন সকালে পাকিস্তানি সাবরজেট আশুগঞ্জ, ভৈরব ও আশপাশের এলাকায় বোমাবর্ষণ ও স্ট্যাফিং করে। এছাড়া কয়েকটি হেলিকপ্টার থেকে চতুর্দিকে সৈন্য নামিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। এদিকে মুক্তিবাহিনীর নিকট যে গোলাবারুদ ছিল, তা শেষ হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে ১৪ই এপ্রিল দুপুরের পর ক্যাপ্টেন মতিউরের নির্দেশে নায়েক সুবেদার আ. মালেক, সুলতান এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান ত্যাগ করে মেঘনা নদীর ওপাড়ে কুলিয়ারচরে চলে যান।
দ্বিতীয়বারের যুদ্ধ
নারায়ণপুর ও মাহমুদাবাদ এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিন ও আব্দুল হকের পরামর্শ অনুযায়ী রামনগর রেলব্রিজে অবস্থিত পাকবাহিনীর চৌকির ওপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত হয়। আব্দুল হক ও আবুল খায়ের রাতে গিয়ে এলাকাটি রেকি করে আসেন। সিদ্ধান্ত হয় ১০ই নভেম্বর ভোর সাড়ে ৪টায় রামনগর গ্রামের পূর্বপাড়ার মেঘার বাড়ির পাকা মসজিদের পাশে অবস্থান নিয়ে আক্রমণ করা হবে। এ অপারেশনে বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) সদস্য ছিলেন ৬ জন এবং বোরহান উদ্দিনসহ এফএফ ছিলেন ২০ জন।
মুক্তিযোদ্ধারা দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যান। একটি গ্রুপ ক্রলিং করে রেল লাইনের ওপরে উঠবে এবং অন্যটি কভারিং ফায়ার করবে। দুজন মুক্তিযোদ্ধা গ্রেনেড নিয়ে রেল লাইনের দক্ষিণ পাশে বাঙ্কারে পজিশন নেবেন। প্রথম গ্রুপটি রেল লাইনের ওপর উঠে যায়। দ্বিতীয় গ্রুপটি রেল লাইনের কাছাকাছি গেলে একজন মুক্তিযোদ্ধা নির্দেশ ছাড়াই ফায়ার করে ফেলেন। সঙ্গে-সঙ্গে পাকবাহিনী এলএমজি দিয়ে বৃষ্টির মতো ফায়ার করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা রেল লাইনের ওপর শুয়ে ফায়ারিং করছিলেন। অন্য দুজন গ্রেনেড চার্জ করেন, কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কভারিং ফায়ার কোনো কাজে আসছিল না। পাকবাহিনীর গোলাগুলিতে মসজিদের দেয়ালে গর্ত হয়ে যায় এবং একটি টিউবয়েলের মাথা উড়ে যায়। প্ৰায় ১০-১৫ মিনিট গোলাগুলির পর আকাশ ফর্সা হয়ে যায়। ভৈরব থেকে আরো পাকসেনা এসে শত্রুদের সঙ্গে যুক্ত হয়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি ফুরিয়ে আসে। অপর দিক থেকে ঝাঁকে-ঝাঁকে গুলি আসছে। প্রায় ৩৫ মিনিট এভাবে গোলাগুলির পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
তৃতীয়বারের যুদ্ধ
কমান্ডার আবুল কাশেম ভূঁইয়া ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হকসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কয়েক দফা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেন যে, রায়পুরা ও ভৈরব থানার কয়েকটি জায়গায় পাকবাহিনীর পেট্রল গ্রুপ এবং পাহারা চৌকির ওপর আক্রমণ করা হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রামনগর রেলব্রিজ যুদ্ধ। ২২শে নভেম্বর রেকি করে ভৈরবের পশ্চিমে দেড় মাইল দূরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের রেলব্রিজের উভয় পাড়ে পাকবাহিনীর চৌকির ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
রেকির মাধ্যমে এবং জগন্নাথপুরের এক রাখালের কাছ থেকে জানা যায় যে, পূর্বপাড়ে ব্রিজের দুপাশে দুটি পাকা বাঙ্কারে থেকে পাকসেনারা রাত্রিবেলা ব্রিজ পাহারা দেয়। পশ্চিম পাড়ে একটি পাকা বাঙ্কার এবং ব্রিজের ওপর একটি টিনের চালাঘরেও পাহারা থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের উভয় পাড়ে একত্রে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
পশ্চিম পাড়ে রামনগর গ্রামের উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ছোট একটি আড়ং (গ্রাম্য হাট) ছিল। এটি রেলব্রিজ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। এখান থেকে গভীর রাতে নৌকায় নদী পাড় হয়ে রামনগর গ্রামের পূর্বপাড়ার আবুল হোসেনের বাড়ির মসজিদ ও জঙ্গল থেকে এবং রেল লাইনের দক্ষিণে শিমুলতলা থেকে একযোগে আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় প্রায় ৮০ জন। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে ২৪শে নভেম্বর রাত ৩টায় আক্রমণের জন্য তাঁরা রওনা হন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হচ্ছিলেন। তখন পাকবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার উড়ে গিয়ে রেলব্রিজের পশ্চিম পাড়ে রেলওয়ে খেলার মাঠে নামে। এ খবরটি তাৎক্ষণিকভাবে কমান্ডার কাশেম ভূঁইয়াকে দিলে অপারেশনের সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে ফিরে যান। পরের দিন বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে, হেলিকপ্টারে করে কিছু রসদাদি এখানে নিয়ে আসা হয়েছে এবং পাকসেনারা মাঠে একটি তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্প করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা এবার তাঁদের আক্রমণের পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন আনেন। তাঁরা ২৬শে নভেম্বর ভোররাতে দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে এক গ্রুপ রামনগর গ্রামের পূর্বপাড়ার আবুল হোসেনের পরিত্যক্ত বাড়ির জঙ্গলে এবং অন্য গ্রুপ শিমুলতলায় অবস্থান নেন। এরপর তাঁরা এক সঙ্গে আক্রমণ শুরু করেন। ছোট একটি গ্রুপকে দায়িত্ব দেয়া হয় নদীর পাড়ে একটি শেওড়া গাছের নিচে অবস্থান নিয়ে অনবরত ব্রিজের পূর্বপাড়ে ফায়ার করতে, যাতে পূর্বপাড় থেকে শত্রুবাহিনী পশ্চিম পাড়ে না আসতে পারে। খুব কাছাকাছি থেকে এ আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের এরূপ আক্রমণ শত্রুপক্ষ কল্পনা করতে পারেনি।
তখনো কিছুটা অন্ধকার ছিল। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট কোনো ভারী অস্ত্র ছিল না, তবে প্রচুর গোলাবারুদ ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগই ছিলেন স্থানীয়। এক রামনগর গ্রামেরই ছিলেন ৫৪ জন। তাঁদের যেহেতু রাস্তাঘাট সব নখদর্পণে, তাই তাঁদের সাহসও ছিল বেশি। কয়েক মিনিট গোলাগুলির পর কয়েকটি গ্রেনেড চার্জ করা হলে পাকসেনারা তাঁবু ছেড়ে ব্রিজের বাঙ্কারে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের তাঁবু দখল করে নেন। এরপর পূর্বপাড় থেকে পাকবাহিনীর কিছু সেনা ব্রিজের ওপর দিয়ে পশ্চিম পাড়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলির ফলে তারা আসতে পারছিল না। এদিকে বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধা রেল লাইনের ওপরে অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ ক্রলিং করে মেইন বাঙ্কারের অতি কাছে এসে গ্রেনেড চার্জ করলে কয়েকজন শত্রুসেনা বাঙ্কার ছেড়ে গড়াতে-গড়াতে ও ক্রলিং করে ব্রিজের ওপর উঠে পূর্বপাড়ে যেতে থাকে। কিন্তু পূর্বপাড় থেকে পাকবাহিনী এবং পশ্চিম পাড় থেকে মুক্তিবাহিনীর গোলাগুলির মধ্যে পড়ে ২- ৩ জন পাকসেনা গুলিতে আহত হয়ে নদীতে পড়ে যায়। পূর্বপাড় থেকে ক্রমাগত এলএমজি-র ফায়ারের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখে অগ্রসর হতে পারছিলেন না। তবে এই গোলাগুলির মধ্যেই ২০-২৫ জন পাকসেনা আহত হয়ে ব্রিজের ওপর দিয়ে পূর্বপাড়ে চলে যায়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ক্রলিং করে ব্রিজের ওপর উঠে তাদের ধাওয়া করেন। হঠাৎ একটি গুলি এসে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের মাথায় লাগলে তিনি ব্রিজের ওপর পড়ে যান। এ-সময় অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ব্রিজের ওপর উঠে ক্রমাগত গুলি চালাচ্ছিলেন। একটি গ্রুপ পশ্চিম পাড়ে ব্রিজের নিচে গিয়ে পূর্বপাড়ে শত্রুদের ওপর গুলি চালাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর পূর্বপাড় থেকে মর্টার শেল নিক্ষেপ শুরু হয়। ভৈরব থেকে নতুন কিছু পাকসেনা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর শেলিং করে। মুক্তিযোদ্ধারা তখন পিছু হটে পশ্চিম পাড়ে এসে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করেন। প্রায় আধঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর পাকসেনাদের একটি গ্রুপ পিছু হটে ভৈরবের দিকে চলে যায়। অপর একটি গ্রুপ শেলিং ও মেশিনগানের গুলি চালিয়ে পিছু হটে। এ-যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও দুজন আহত হন। [মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড