You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.16 | রামপুর এম্বুশ (রায়পুরা, নরসিংদী) - সংগ্রামের নোটবুক

রামপুর এম্বুশ (রায়পুরা, নরসিংদী)

রামপুর এম্বুশ (রায়পুরা, নরসিংদী) করা হয় ১৬ই জুলাই। এতে হানাদার বাহিনীর ৩০-৪০ জন সৈন্য হতাহত হয়।
১৪ই জুলাই -বেলাব যুদ্ধ-এ জয় লাভের পর পাকহানাদার বাহিনী যেমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তেমনি মুক্তিযোদ্ধারাও ঐ যুদ্ধে ক্ষয়-ক্ষতির প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। শীঘ্রই সে সুযোগ এসে যায়। গোপন সূত্রে খবর পাওয়া যায় যে, ১৫ই জুলাই যে-কোনো সময় পাকবাহিনীর পাঁচটি লঞ্চ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে কটিয়াদি থেকে মঠখোলার দিকে যাত্রা করবে। দুটি করে লঞ্চ জোড়া বেঁধে অগ্রভাগে থাকবে এবং পঞ্চম লঞ্চটি পেছনে আসবে। এই লঞ্চসমূহে সৈনা ছাড়াও তাদের রসদ, পথ্য ও গোলাবারুদ থাকবে। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর লঞ্চবহরকে রামপুর এলাকায় বাধা দেয়ার পরিকল্পনা করেন। তদনুযায়ী ১৫-২০ জন মুক্তিযোদ্ধা বড়চাপা এলাকা থেকে ইপিআর শেখ হারুনের নেতৃত্বে ১৪ই জুলাই রাতে সাগরদী বাজারের নিকটবর্তী স্থানে সমবেত হন। ১৫-২০ জন মুক্তিযোদ্ধার অপর একটি দল ইপিআর মোশাররফ হোসেন কিরণের নেতৃত্বে খিদিরপুর এলাকা থেকে একই রাতে সাগরদী বাজারের নিকটবর্তী স্থানে সমবেত হয়। প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, রেকি ও ব্রিফিং শেষে মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে সূর্যোদয়ের পূর্বে এম্বুশ এলাকায় অবস্থান নেন। তিনটি দল শেখ হারুন, মো. সানোয়ার আলী ও মোশাররফ হোসেন কিরণের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। সার্বিক নেতৃত্বে থাকেন শেখ হারুন। তাঁদের সঙ্গে অন্যান্য যাঁরা এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা হলেন— হাবিলদার আকমল আলী, সাইদুর রহমান, নানু, আলতাফ, জয়নাল, আসাদ, আফতাব, আফজাল, মজিবর, মোস্তফা প্রমুখ।
মুক্তিযোদ্ধারা ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁকে রামপুর গ্রামের উত্তর প্রান্তে এম্বুশ করেন। পাকবাহিনীর প্রথম দুটি লঞ্চ মুক্তিবাহিনীর তিন নম্বর দলের আওতায় আসামাত্র এম্বুশ অধিনায়ক শেখ হারুন সর্বপ্রথম গুলিবর্ষণ করবেন এবং তা অন্য দুটি দলের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফায়ার সংকেত হিসেবে পরিগণিত হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এম্বুশস্থলে অবস্থান করেন, কিন্তু পাকবাহিনী না আসায় তাঁরা নিকটবর্তী একটি বাড়িতে রাত্রিযাপন করেন। বাড়ির মালিক আবদুর রশিদ ওরফে তারা মাস্টার তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করেন।
পরদিন ১৬ই জুলাই সকাল বেলা মুক্তিযোদ্ধারা গোয়েন্দা মারফত খবর পান যায় যে, পাকবাহিনীর লঞ্চবহর কটিয়াদি থেকে মঠখোলার উদ্দেশে রওনা হয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের স্ব-স্ব অবস্থানে এম্বুশ গ্রহণ করেন এবং পাকবাহিনীর আগমনের অপেক্ষা করতে থাকেন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে শত্রুদের লঞ্চগুলো মুক্তিবাহিনীর এম্বুশ এলাকায় ঢুকতে থাকে। এক সঙ্গে বাঁধা এক জোড়া লঞ্চ প্রথমে এম্বুশ এলাকায় প্রবেশ করে এবং ১ ও ২ নং দলের অবস্থান অতিক্রম করে ৩নং দলের আওতার মধ্যে এলে হঠাৎ করে উক্ত দলের মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন উত্তেজিত হয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে-দিতে লঞ্চের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করেন। আফতাব উদ্দিনের গুলিবর্ষণের সঙ্গে-সঙ্গে তিনটি দলের অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও একযোগে লঞ্চের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। অতর্কিত এ হামলার ফলে পাকবাহিনী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং বেশকিছু পাকসেনা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্ধারিত সময়ের আগেই গোলাগুলি শুরু হয়ে যাওয়ায় পাকবাহিনীর ৩ নং লঞ্চটি এম্বুশ এলাকায় না ঢুকে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয় এবং স্রোতের টানে ধীরে-ধীরে পূর্ব দিকে সরে যেতে থাকে। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। ইতোমধ্যে ৩নং লঞ্চটি আরো পূর্বদিকে সরে গিয়ে রামপুর বাজারের কিছুটা পশ্চিমে ভেড়ে পাকসেনারা লঞ্চ থেকে নেমে অনগার্ড পজিশনে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনী পূর্বদিক থেকে মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রতিআক্রমণ এবং লঞ্চের ওপর তৈরি করা বাংকার থেকে ২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ-সময় শেখ হারুন পাকবাহিনীর ওপর এলএমজি থেকে ফায়ার করতে-করতে পেছনে সরে আসতে সক্ষম হন। মুক্তিবাহিনী বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে এম্বুশ প্রত্যাহার করে প্রথমে সাগরদী বাজার এবং পরে চালাকচরে চলে আসে। এদিকে হানাদার বাহিনীও আড়ালিয়া এলাকায় চলে যায়। এ-যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৩০-৪০ জন সৈন্য হতাহত হয়। কিছুক্ষণ পর একটি হেলিকপ্টার এসে হতাহত পাকসেনাদের তুলে নিয়ে যায়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা বেলাব যুদ্ধের উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। [মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড