মুক্তিযুদ্ধে রামগঞ্জ উপজেলা (লক্ষ্মীপুর)
রামগঞ্জ উপজেলা (লক্ষ্মীপুর) ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো লক্ষ্মীপুর জেলার আপামর জনসাধারণও প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ২রা মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একদফা (বাংলাদেশের স্বাধীনতা) আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সম্মুখে ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উড্ডীন করে এবং দেশের সর্বত্র ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শাখা গঠন করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ছাত্র-যুবকদের প্রতি আহ্বান জানায়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐ আহ্বানের পরদিন অর্থাৎ ৩রা মার্চ থেকে রামগঞ্জসহ লক্ষ্মীপুর জেলার প্রতিটি স্কুল-কলেজে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শাখা গঠিত হয় এবং ছাত্রসমাজ এদিন থেকেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্রসমাজের এই একদফা আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগণ যোগ দিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর লক্ষ্মীপুর জেলার সর্বত্র সর্বদলীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ-এর নির্বাচিত এমএনএ এবং এমপিএ-গণ এ-সকল কমিটির নেতৃত্ব দেন। নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সারা দেশের মতো রামগঞ্জেও সর্বাত্মকভাবে এ আন্দোলন চলতে থাকে। আন্দোলনের পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তার সদস্য ছিলেন মফিজুল হায়দার, আবদুল মান্নান, সালেহ আহমেদ ভূঁইয়া, আবদুল মান্নান মজুমদার, নূর মোহাম্মদ, ওয়াজি উল্যাহ পাটওয়ারী, বদিউজ্জামান, হাবিবুর রহমান, গোলাম সরওয়ার মন্টু, সৈয়দ আহমেদ পাইন, আলী আকবর এবং শেখ বদরুদ্দোজা। আলহাজ্ব গিয়াস উদ্দিন (নওয়াপাড়া, রামগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি)-কে আহ্বায়ক এবং নজির আহমেদ চেয়ারম্যান (রসূলপুর)-কে সদস্য-সচিব করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি থানা সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যার -অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পরই দেশব্যাপী শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। এর সঙ্গে প্রশিক্ষণও শুরু হয়। নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও আর্মড সার্ভিসেস বোর্ডের সভাপতি মঞ্জুরুল করিমের আহ্বানে দুই কোম্পানি সশস্ত্র বাহিনী এবং পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত পরিষদের তত্ত্বাবধানে ছাত্র, যুবক ও শ্রমিকরা বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার প্রতিটি থানা, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, খেলার মাঠ ও ঈদগা ময়দানে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। কাঠের তৈরি ডামি বন্দুক আর বাঁশের লাঠি ছিল প্রশিক্ষণের প্রধান অস্ত্র। ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ চলে। বিভিন্ন থানায় গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ভারতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করেন। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার ছাত্র-যুবক ভারতের ত্রিপুরার চোত্তাখোলায় যান। পরে আরো অনেকে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন।
২৬শে মার্চ থেকে বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলারও বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী, ইপিআর (বর্তমান বিজিবি), পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহনীর অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে থাকা সদস্যদের সহযোগিতায় ছাত্র-যুবকরা সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। ২৬শে মার্চ সকালে ছাত্রনেতা আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে রামগঞ্জ থানা থেকে ১৩টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল এবং ৫ হাজার রাউন্ড গুলি হস্তগত করা হয়। সেগুলো দিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার ও হাবিলদাররা কলেজ ও হাইস্কুল মাঠে যুবকদের প্রশিক্ষণ দেন। বালুয়া চৌমুহনীতে ন্যাপনেতা নুর হোসেনের নেতৃত্বেও একটি প্রশিক্ষণ শিবির চালু হয়। সশস্ত্র অবস্থায় পালিয়ে আসা সেনা ও ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের নেতৃেত্বে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ বাহিনী। থানাগুলো থেকে হস্তগত করা অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা-বারুদ প্রতিরোধ বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করে।
রামগঞ্জ থানা সংগ্রাম পরিষদ পানিয়ালা বাজারে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে এবং সুবেদার জহুরুল হক পাঠানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়। এপ্রিল মাসের শেষদিকে রামগঞ্জ থানায় পাকবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপিত হওয়ার পর মুক্তিকামী যুবকরা সোনাইমুড়ী থেকে কানকিরহাট হয়ে ভারতের আগরতলা যায়। সেখান থেকে তারা চোত্তাখোলা, রাজনগর, তেজপুর, হাফলং, দেরাদূন প্রভৃতি ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। উল্লেখ্য যে, বিএলএফ সদস্যদের প্রশিক্ষণ হতো ভারতের উত্তর প্রদেশের দেরাদূনে। ঐ সময় দেরাদূন সামরিক একাডেমির অন্যতম প্রশিক্ষক ছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক (রামগঞ্জ, ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগ – কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক)। প্রশিক্ষণের পর মুক্তিযোদ্ধারা দলে-দলে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় রামগঞ্জ উপজেলায় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন মো.আব্দুর রশিদ এমএনএ (নাগমুদ; নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য; ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার-এর সদস্য হিসেবে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ক্যাম্প পরিচালনা করেন এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভে জোর তৎপরতা চালান), আলহাজ্ব গিয়াস উদ্দিন (অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন; কাওয়ালী ডাঙ্গা, পানিয়ালা ও চৌধুরী বাজারে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপনে তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়), ডা. অহিদুর রহমান (দক্ষিণ চণ্ডীপুর, পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবেক অফিসার; ফতেহপুরে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেন এবং নিজগ্রামের ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন), এ বি এম আব্দুল কুদ্দুস (ফতেহপুর), আ ক ম শহীদ উল্যাহ, রুহুল আমিন পাটোয়ারী, জিয়াউল হক, ফজলে এলাহী, আবুল হোসেন, রুস্তম আলী, আবদুর রহমান, সিরাজ মাহমুদ, মো. শাহজাহান (ছাত্রনেতা), মো. ওবায়েদ উল্লাহ, মো. ছাকায়েত উল্লাহ, ক্যাপ্টেন এম আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম (পিউরী), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এস আই এম নুরুন্নবী খান, বীর বিক্রম (লক্ষ্মীধরপাড়া), নায়েক সুবেদার মো.শহীদুল্লা ভূঁইয়া, বীর বিক্রম (শেফালিপাড়া), মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক (লামচর), আবুল খায়ের (চাটখিল কলেজের ভিপি), আব্দুর রউফ (ঐ, জিএস), গোলাম মোস্তফা মিরন (ছাত্রলীগ নেতা), কায়কোবাদ (ঐ), শওকত (ঐ), কামাল (ঐ), সিরাজুদ্দৌলা (২ঊনসত্তরের গণআন্দোলন-এর সময় ঢাকার জিন্নাহ কলেজের ভিপি ছিলেন), মনির আহমেদ (লাকসাম কলেজের জিএস), বজলুর রশিদ (চৌমুহনী কলেজের ভিপি), গোলাম জিলানী চৌধুরী (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র), এম এ গোফরান (কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র), সফিকুল ইসলাম (চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের ছাত্র), সিরাজ উদ্দিন (ঢাকার কায়দে আজম কলেজের ছাত্র), আবুল কালাম, নজরুল ইসলাম মজুমদার নসু (চাঁদপুর কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন-এর সংগঠক), প্রবীর মজুমদার (পরে শহীদ), মাহাবুবুল আলম দুলাল, আবুল খায়ের, আমির হোসেন, নুর মোহাম্মদ, শাহ আলম, রফিকুল ইসলাম, দিলীপ মজুমদার, জনার্ধন বণিক (রতনপুর), আবুল কাশেম দেওয়ান, স্বপন নন্দী, পরেশচন্দ্র সূত্রধর, দিলীপ পাটোয়ারী, ফয়েজ আহম্মেদ (আঙ্গারপাড়া), ছিদ্দিক উল্যাহ, মোস্তফা আনোয়ার, অমল চক্রবর্তী, পুলিন চক্রবর্তী, অর্জুন, শাহজাহান মাস্টার (জয়দেবপুর) প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের সময় রামগঞ্জ থানা কমান্ডার ছিলেন সাখাওয়াত উল্যাহ (সমেষপুর), আবুল হোসেন খাঁন সুফি ও আমির হোসেন এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন সিরাজুল ইসলাম ও নূর হোসেন। রামগঞ্জ-রায়পুর নিয়ে গঠিত জোনাল কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন একরামুল হক (রামগঞ্জ, ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক)।
রামগঞ্জ ছিল মুজিব বাহিনী – (বিএলএফ)-র জোন- বি-এর অধীন। এর অধিনায়ক ছিলেন মো. একরামুল হক এবং উপ-অধিনায়ক ছিলেন মো. আবুল কাসেম পাটোয়ারী ও আনসার উদ্দিন আহম্মদ। এছাড়া দেরাদূনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিএলএফ নোয়াখালী জেলা কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেলায়েত (রামগঞ্জ, ১৯৬৫ সালে চৌমুহনী কলেজের জিএস)। রামগঞ্জ থানা বিএলএফ ট্রুপস কমান্ডারদের মধ্যে ছিলেন আবুল কাশেম পাটোয়ারী (বাউরপাড়া), আবুল হোসেন ছুফি (বিঘা), রুস্তম আলী (পদ্মা), শাহজাহান চৌধুরী (শ্রীনারায়ণপুর)। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডে ছিলেন সুবেদার এসহাক (উত্তরভাট্টা), এফএফ- গ্রুপ কমান্ডারদের মধ্যে ছিলেন ফজলুল হক (লক্ষ্মীধরপাড়া), আবু তাহের (শরীফপুর), তোফাজ্জেল হোসেন বাচ্চু (উদনপাড়া), সৈয়দ আহমেদ (নাগমুদ), আবুল হাশেম (টিওরী), আবুল বাসার (বাউরপাড়া) এবং তাজুল ইসলাম (বারঘরিয়া)।
পাকবাহিনী এপ্রিল মাসের শেষদিকে রামগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করে এবং মধুপুর হাইস্কুলে প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া রামগঞ্জ থানা, খাদ্যগুদাম, ডাকবাংলো ও পশুহাসপাতাল ছিল পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সুরক্ষিত ঘাঁটি।
রামগঞ্জ উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো- মাওলানা আবদুল আল বাকী (টামটা, ফতেহপুর মাদ্রাসার শিক্ষক), ডা. আফাজ উদ্দিন (শ্রীপুর, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক), ডা. মির্জা মজিবুল হক (নন্দনপুর), আজিজ উল্যাহ পাটোয়ারী (নন্দনপুর, সাবেক জিন্না হল ছাত্র সংসদের জিএস), ফয়েজ আহম্মেদ বিএসসি (নাগমুদ, পিউরী হাইস্কুলের শিক্ষক), ডা. আবদুল হাই (নরিংপুর, সেনাসদস্য), আবু তাহের মাস্টার (মধ্যপাড়া), মাওলানা আবুল কালাম (কাসিমনগর) এবং আবদুল লতিফ মাস্টার (সাতারপাড়া, শিক্ষক)।
এদের উদ্যোগে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ছিল- মাওলানা আবুল কালাম (কাশিমনগর), মাওলানা আবদুল-আল-বাকী, আবদুল লতিফ মাস্টার, ডা. মির্জা মজিবুল হক, আজিজ উল্যাহ পাটোয়ারী, কালা মিয়া (রতনপুর), মানিক (রতনপুর), মিজানুর রহমান (আউগীনখিল), ইউছুব আলী (নোয়াখোলা), মাজহারুল ইসলাম তপদার (ভাটরা), সাখাওয়াত উল্যাহ (আঙ্গারপাড়া), চৌধুরী মিয়া (আউগীনখিল) প্রমুখ।
পাকবাহিনী রামগঞ্জে প্রবেশ করার পরপরই স্বাধীনতাবিরোধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং পাকবাহিনীর সঙ্গে হাত মেলায়। তাদের সহায়তায় পাকসেনারা সোনাপুর বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। এতে বাজারের বেশির ভাগ দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পুড়ে যাওয়া দোকানগুলোর অধিকাংশই ছিল হিন্দু ব্যবসায়ীদের। আগুন দেয়ার আগে দোকানগুলোর মূল্যবান পণ্যসামগ্রী লুট করা হয়। পাকবাহিনী কোনো এলাকায় প্রবেশ করার আগে গোলাগুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করত। পরে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করত। বাজারের দোকানপাট বন্ধ দেখলে তা জ্বালিয়ে দিত। পাকবাহিনী দশঘরিয়া বাজারের আশপাশের গ্রামের বাড়িঘর, উঘারিয়ার মুক্তিযোদ্ধা বোরহান চৌধুরীর বাড়ি, বগৌড়ের ডা. সুলতানের বাড়ি (পাটোয়ারী বাড়ি) এবং তার আশপাশের সব বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং এসব এলাকায় নির্যাতন চালায়।
২৮শে জুন (১৩ই আষাঢ়) গভীর রাতে পাকবাহিনী কমরদিয়া ঘোষবাড়িতে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে সংখ্যালঘু তিন যুবককে আটক করে এবং দুজনকে হাত-পা বেঁধে পার্শ্ববর্তী পুকুরে নিক্ষেপ করে। এতে তাদের করুণ মৃত্যু ঘটে। অপরজন প্রবীর মজুমদার (এককালে ছাত্র ইউনিয়ন ও পরবর্তীতে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা; রামগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেবতী মোহন মজুমদারের ভাগ্নে)-কে এক সপ্তাহ অমানুষিক নির্যাতনের পর রামগঞ্জ বাজারের বড়পুলের পশ্চিম পাশে গুলি করে হত্যা করে। মৃত্যুর পূর্বেও তিনি ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করেছিলেন।
৮ই জুলাই রামগঞ্জের প্রান্তসীমায় অবস্থিত নরিংপুর পাকবাহিনী ক্যাম্প থেকে হানাদাররা তিনটি নৌকাযোগে এসে ভাটরা মজুমদার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। চাঁদপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার সুবেদার মেজর জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বাধীন সুবেদার আলী আকবর (পানপাড়া) তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
আগস্ট মাসে পাকবাহিনী রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে রামগঞ্জ ঘাঁটি থেকে দাসপাড়া হয়ে রসূলপুর এসে নজির আহমেদ চেয়ারম্যানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর মাঝিরগাঁও বাজারের দিকে অগ্রসর হলে লামচরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেয়া হয়। সেখান থেকে ২০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা দ্রুত এসে মাঝিরগাঁও বাজারের দক্ষিণে জহির উদ্দিন বেপারীর বাড়ি এবং মুলাদির বেপারী বাড়িতে এম্বুশ রচনা করেন। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দলটি যখন মাঝিরগাঁও বাজারের পশ্চিমে নতুন মসজিদের কাছে এসে উপস্থিত হয়, তখন মুক্তিযোদ্ধারা দুটি অবস্থান থেকে গুলিবর্ষণ করেন। এতে কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে পাকবাহিনী রাস্তার অপর পাড়ে অবস্থান নিয়ে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু সীমিত এমুনেশনের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে পিছু হটেন। তখন ক্ষিপ্ত পাকবাহিনী গুলি ছুড়তে-ছুড়তে বাজারের দিকে অগ্রসর হয়ে প্রথমে একজন দিনমজুরকে হত্যা করে। অতঃপর মাঝিরগাঁও-এর আশ্রাফ আলী মিঝির বাড়িতে প্রবেশ করে ৫ জন, দুলা মিয়া পাটোয়ারীর বাড়িতে একজন এবং কাশিমনগর কবিরাজ বাড়িতে একজনসহ মোট ৭ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনা মাঝিরগাঁও গণহত্যা নামে পরিচিত। এরপর পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় রামগঞ্জ থানার দরবেশপুরের দেওয়ান বাড়ি, ভাদুরের এরশাদ মিয়ার বাড়িসহ শতাধিক বাড়িতে গান পাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।
পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে কম বয়সী তরুণদের মনেও মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রামগঞ্জে এরূপ দুজন তরুণের মধ্যে একজন ছিল রামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র তোফায়েল আলম মনু এবং অপরজন পিউরী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র মির্জা তারেকুল কাদের। এরা অস্ত্রহাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত গেরিলা দলের সক্রিয় সদস্য ছিল মির্জা তারেকুল কাদের।
রামগঞ্জ ডাকবাংলো, রেজিস্ট্রি অফিস, জামে মসজিদের ছাদ, খাদ্যগুদাম এবং মধুপুর হাইস্কুল ছিল শান্তি কমিটির নির্যাতনকেন্দ্র। শান্তি কমিটির সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ লোকদের এখানে ধরে এনে বিচার করত এবং তাদের প্রহসনমূলক বিচারে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে নির্মম নির্যাতনের পর পাকবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হতো।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রামগঞ্জ থানার পশ্চিম পাশে এবং বেড়িবাঁধের পূর্বপাশে অনেক লোককে কবর দেয়া হয়। এ স্থানটি রামগঞ্জ থানা-সংলগ্ন গণকবর নামে পরিচিত। এর পশ্চিম পাশে একটি বধ্যভূমি আছে। এছাড়া মধুপুর হাইস্কুলের পাশে সেনবাড়ির ডোবা, হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাসা-সংলগ্ন ডোবা এবং স্কুলের পূর্বপাশের বটগাছের নিচেও অনেককে হত্যা করা হয়।
রামগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব যুদ্ধ হয়, সেগুলো হলো- নরিংপুর পাকবাহিনী ক্যাম্প অপারেশন দক্ষিণ ফতেহপুর অপারেশন, রামগঞ্জ অবরোধ, কাজীর দিঘির পাড় যুদ্ধ – চৌধুরী বাজার-ফতেহপুর এম্বুশ এবং পদ্মাবাজার অপারেশন। নরিংপুর পাকবাহিনী ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় ১৫ই জুলাই। এতে ৭-৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। দক্ষিণ ফতেহপুর অপারেশন পরিচালিত হয় ৬ই আগস্ট। এতে ১০-১৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং পানপাড়া হাইস্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র আবদুল মতিন শহীদ হয়। রামগঞ্জ অবরোধ চলে ৯ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ সময় সুবেদার আলী আকবর, সুবেদার তোফাজ্জল হোসেন, এম এ গোফরান, শাহজাহান কমান্ডার, আমির হোসেন, আ ক ম রুহুল আমিন প্রমুখ নিজ-নিজ গ্রুপ নিয়ে পাকবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ঘিরে রাখেন। অবরোধের ফলে রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর কোনো দিক থেকেই পাকবাহিনী রামগঞ্জে প্রবেশ করতে পারেনি। অবশেষে লক্ষ্মীপুর থেকে ২০০ পাকসেনা এসে অবরোধ ভেঙ্গে ফেলে এবং মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। কাজীর দিঘির পাড় যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১০ই সেপ্টেম্বর। এ-যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরদিকে শত্রুপক্ষের কয়েকজন হতাহত হয়। চৌধুরী বাজার-ফতেহপুর এম্বুশ করা হয় ১৬ থেকে ১৯শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এতে নেতৃত্ব দেন রফিকুল হায়দর চৌধুরী ও সুবেদার লুৎফর রহমান। ১৯শে সেপ্টেম্বর সকালে ২৫ জন পাকসেনার একটি দল একটি দল চৌধুরী বাজারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ারের মধ্যে পড়ে গাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়। এর দুদিন পর পাকবাহিনী মাজিরগাঁও বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। এদিন মীরগঞ্জের দক্ষিণে পাকবাহিনীর কমান্ডার ইমতিয়াজ নিহত হয়। কমান্ডার নূর হোসেনের নেতৃত্বে ৪ঠা ডিসেম্বর পদ্মাবাজার অপারেশন পরিচালিত হয়। এতে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়।
এদিনই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পর্যদুস্ত পাকবাহিনী রামগঞ্জ থানা ত্যাগ করে। কিন্তু তাদের দোসর কিছু রাজাকার থেকে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে তাদের ঘেরাও করে রাখেন। অবশেষে ১৯শে ডিসেম্বর তারা আত্মসমর্পণ করে। তবে ৪ঠা ডিসেম্বরকেই উপজেলা হানাদারমুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়৷
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. সহিদ উল্লাহ ভূঁইয়া, বীর বিক্রম (পিতা ছফিউল্লাহ ভূঁইয়া, শেফালী পাড়া), এস আই এম নুরুন্নবী খান, বীর বিক্রম (পিতা হাজী হাবিবউল্লাহ খান, লক্ষ্মীধরপাড়া) ও মোহম্মদ সোমা মিঞা, বীর প্রতীক (পিতা আব্দুর রহমান, টাঘটা)।
রামগঞ্জ উপজেলার ৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন— সুবেদার মো. সহিদ উল্লাহ ভূঁইয়া, বীর বিক্রম (১৪ই আগস্ট দিনাজপুরের মনোহরপুরে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), ক্যাপ্টেন এম আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম (পিতা আব্দুল কাদের, পিউরী), রফিক উল্যাহ (কাশিমনগর), মো. শামছুল হক খাঁ (শ্রীরামপুর), মো. রফিক উল্যাহ (চণ্ডীপুর), আজহার মিয়া শেখ (জগতপুর), মো. কালা মিয়া (দৌলতপুর), আমিনুল ইসলাম (লক্ষ্মীধর পাড়া), আবদুল হাই (লক্ষ্মীধর পাড়া), শহীদ উল্যাহ (নারায়ণপুর), আবদুল মতিন পাইন (চণ্ডীপুর), রফিকুল ইসলাম (নাগমুদ), আনছার আলী (দরবেশপুর), সৈয়দ আহম্মদ (উত্তর দরবেশপুর), রহমত উল্যাহ (দরবেশপুর), আবদুর রশিদ (পিতা মো. বশির উদ্দিন মিয়া, কাঞ্চনপুর; ২৭শে নভেম্বর রামগঞ্জ গোডাউনের পাশে বাংকারে যুদ্ধরত অবস্থায় পাক মিলিশিয়াদের গুলিতে শহীদ), আবদুল মান্নান (ভাদুর), মো. নজীব উল্যাহ (পিতা সামছুল হক, মাঝিরগাঁও; সেনাসদস্য), হাবিলদার শাহাব উদ্দিন (ফতেহপুর), সিপাহি নেছার আহমদ (পানপাড়া), আবদুল রাজ্জাক (উত্তর দরবেশপুর), রুহুল আমিন (হানুবাইশ), মো. এনায়েত হোসেন (লক্ষ্মীধর পাড়া), নূরুল ইসলাম (দরবেশপুর), আবদুল মালেক (ভোলাকোট), ইপিআর সিরাজুল ইসলাম (শ্যামপুর), সিপাহি আবদুস ছাত্তার (আলীপুর), ইপিআর নূরুল হক (দলটা), আবদুল লতিফ পাটওয়ারী (আলীপুর), নায়েক আবদুল মনি (সিংবাইশ), ছফি উল্যাহ (রাজা রামপুর), সুলতান আহম্মদ (টামটা), টেলু মিয়া (সোনাপুর), হাবিলদার আবদুর রশিদ (দরবেশপুর), মমতাজ মিয়া (বাউর খাড়া), আনিসুল হক চৌধুরী (নাগমুদ) এবং ফজল হক (আঙ্গারপাড়া)। এছাড়া ১০ই সেপ্টেম্বর কাজীর দিঘির পাড় যুদ্ধে ইসমাইল (পিতা বজল হক, সাগরদী, রায়পুর), বাসু (জকসিন, লক্ষ্মীপুর) এবং বদু (দক্ষিণ সাগরদী, রায়পুর) নামে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
রামগঞ্জ উপজেলায় মুক্তযোদ্ধাদের স্মরণে সোনাপুর চৌরাস্তায় মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয় সংলগ্ন রামগঞ্জ বাজারে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ এবং রামগঞ্জ শিশুপার্ক সংলগ্ন দক্ষিণ বাজার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য নির্মিত হয়। [মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড