মুক্তিযুদ্ধে রামগড় উপজেলা (খাগড়াছড়ি)
রামগড় উপজেলা (খাগড়াছড়ি) দুর্গম পাহাড়ঘেরা অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি উপজেলা রামগড়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে খাগড়াছড়িতে স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রামগড় ছিল একটি মহকুমা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এর অবস্থান। দুর্গম পাহাড়বেষ্টিত খাগড়াছড়ি জেলার এটি হচ্ছে প্রবেশপথ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি ছিল ১ নম্বর সেক্টরের অধীন।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা, ২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট এবং ২৬শে মার্চ পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং তারপর নয়মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। সারা দেশের মতো রামগড় উপজেলার মানুষও এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এখানে গড়ে ওঠে শক্তিশালী সশস্ত্র প্রতিরোধ।
২৬শে মার্চ সকালবেলা রামগড় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহমেদ তারযোগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা সকলকে জানান। স্বাধীনতা ঘোষণার খবরের সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় গড়ে ওঠে প্রতিরোধ আন্দোলনের দুর্গ। ২৬শে মার্চের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক মো. সুলতান আহম্মদ মুক্তিকামী সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে রামগড় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন মো. সুলতান আহম্মদ নিজে এবং সদস্য ছিলেন— সুধীর দাসগুপ্ত, ডা. ফণীন্দ্র ত্রিপুরা, কাজী রুহুল আমীন, মজির উদ্দিন মুন্সী, নন্দেরবাঁশী দেববর্মণ, মাইহলাপ্রু চৌধুরী, নকুল চন্দ্র ত্রিপুরা, আব্দুল লতিফ মেম্বার এবং আব্দুল গফুর সর্দার। এঁরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য রসদ ও অর্থ সংগ্রহ করেন। ২৯শে মার্চ জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ রামগড় আসেন। ১লা এপ্রিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে দুই ট্রাক গোলাবারুদ রামগড়ে প্রেরণ করা হয়। সেগুলো গ্রহণ করেন দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরী, নুর বক্স মিয়া, ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (সাবেক স্বরাষ্টমন্ত্রী)। প্রাপ্ত গোলাবারুদসমূহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ সংগ্রামে সহয়তার জন্য প্রেরণ করা হয়। ২রা এপ্রিল রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম) প্রচুর অর্থ নিয়ে রামগড় আসেন এবং তা বিপ্লবী সরকারের হাতে তুলে দেন। তাঁর দেয়া অর্থে রামগড় লঙ্গরখানা পরিচালনা সহজ হয়। রামগড় লঙ্গরখানা পরচিালনায় স্টোরের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় পশু চিকিৎসক বিকে দাস এবং রান্নার দায়িত্বে ছিলেন মৌলভী বজলুর রহমান, এবি সিদ্দিক প্রমুখ। চট্টগ্রাম শহরের পতন হওয়ার পর চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশনের ১০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন বেতার যন্ত্রটি রামগড় পোস্ট অফিসের দ্বিতীয় তলায় স্থানান্তর করা হয় এবং এখান থেকে ৩রা ও ৫ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-র অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হয়। ৮ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম ও পুলিশ সদস্য হাবিলদার আবুল কাসেমের নেতৃত্বে রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বাধীনতাকামী ছাত্র-যুবক ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তমএর তত্ত্বাবধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা থেকে আসা হাজার-হাজার ছাত্র-যুবক ও বিভিন্ন পেশাজীবীদেরও এখানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। রামগড় পতনের পূর্ব পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু ছিল এবং এখান থেকে চট্টগ্রাম, শুভপুর ও মহালছড়িসহ অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা হতো। এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা, জুলু মগ, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, হাসেম আলী এবং ঞোহলা অং মগ।
মানিকছড়ির মং রাজা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেন। রাজভাণ্ডার হতে তিনি তাঁর গরুর গাড়িতে চাউল, ডাল, তরী- তরকারীসহ মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক নানা উপকরণ। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুগত প্রকাশ করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সরকারের হাতে তুলে দেন।
৩০শে এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী- রামগড় আসেন। তিনি মেজর জিয়া, মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন অলী, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন ভূঞা, লে. মাহফুজ প্রমুখকে নিয়ে রামগড়কে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। ২রা মে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারা ঐদিনই ভারতের সাবরুমে আশ্রয় নেয়। রামগড় পতনের সময় লাইন্সম্যান সোলেমান টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি উঠিয়ে সাবরুমে নিয়ে যায়।
রামগড়ে বহু সামরিক অফিসার, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও গণ্যমান্য ব্যক্তি আশ্রয় নিয়েছিলেন। সামরিক অফিসারদের মধ্যে ছিলেন- ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর শামছুদ্দিন, মেজর শওকত আলী, মেজর আবুল কাশেম, ক্যাপ্টেন এজাজ, ক্যাপ্টেন এনামুল হক, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন শামছু, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন ওয়ালী, ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া, ক্যাপ্টেন মতিন এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদ (পরবর্তীকালে বিমান বাহিনীর প্রধান)। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিলেন এম এ ওহাব, এম এ মান্নান, আবদুল্লাহ-আল-হারুন, মির্জা আবুল মনসুর, ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন, প্রফেসর খালেদ, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, সাংবাদিক শিশির দত্ত, চলচ্চিত্র শিল্পী কবরী, বাদশাহ আলম, প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান, সাইদুর রহমান চৌধুরী, ফজলুল হক বিএসসি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ আর মল্লিকসহ ১৫-১৬ জন অধ্যাপক। মানিকছড়ির ডা. এস বি বিশ্বাস, খাগড়াছড়ির ডা. সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকজন ডাক্তার রামগড়ে আসায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহজলভ্য হয়। এঁরা রামগড়ে এসে কিছুদিন অবস্থান করেন এবং এখান থেকে ভারতে যান। ভারতের বিএসএফ-এর লে. কর্নেল ঘোষ, মেজর প্রধান, ক্যাপ্টেন ঘোষ, সাক্রম পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা মুখার্জী এবং প্রখ্যাত সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যও রামগড়ে এসেছিলেন।
পাকবাহিনী রামগড় দখল করার জন্য ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। একদল আসে চট্টগ্রাম থেকে করের হাট হয়ে, অন্যদল আসে খাগড়াছড়ি থেকে এবং তৃতীয় দল আসে মহালছড়ি থেকে। করের হাট লাইনে মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় অবস্থান ছিল। পাকবাহিনী এ লাইনে সাজোয়া বহর ও ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হয়। বাগান বাজার ইপিআর-এর নায়েব সুবেদার জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে কয়েকজন জোয়ান ও ছাত্র-যুবক করের হাট ফরেস্ট চেকপোস্টের পূর্বদিকে পাহাড় ও নয়াটিলা এলাকায় তাদের প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে তাঁরা পিছু হটেন এবং করের হাট-রামগড় সড়কে একটি পাকা সেতু উড়িয়ে দেন। পাকবাহিনী সেখানে ঝুলন্ত ব্রিজ স্থাপন করে রাগড়ের দিকে অগ্রসর হয়।
২রা মে রামগড়ে প্রবেশ করে বাগান বাজার, সোনাইপুল ও কমপাড়ায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে রামগড় পুলিশ স্টেশন, রামগড় হাসপাতাল, রামগড় বাজার এবং সীমান্ত এলাকার ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়ে যায়। পাকবাহিনী রামগড়ে প্রবেশ করে স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও হিলরাজ বাহিনী গঠন করে। আমির হোসেন চৌকিদার (খাগড়াবিল; শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), এরশাদ উল্লাহ (তৈচালাপাড়া), আবদুল সালাম (ঐ), নুরুল ইসলাম (কালাডেবা), ডা. মোকশেদ আলম (খাগড়াবিল), মোতালেব (বলিপাড়া), আলতাব আলতাব হোসেন দর্জি (ঐ) প্রমুখ পাকবাহিনীকে হত্যা, লুটপাট, নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযোগে সহযোগিতা করে।
রামগড় দখল করার পর পাকবাহিনী নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। আলতাফ হোসেন দর্জি এবং শান্তি কমিটির অন্য সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকবাহিনী রামগড় সংগ্রাম কমিটির সদস্য কাজী রুহুল আমীনের বড়ভাই আবদুল লতিফ (মেম্বার)-কে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে। রামগড় মহামনি বৌদ্ধ বিহারের বুদ্ধমূর্তিটি বেয়নেট চার্জ ও রাইফেলের গুলিবর্ষণে ক্ষতবিক্ষত করে এবং মূর্তির ডান হাত ভেঙ্গে ফেলে। এছাড়া তারা আরো অনেককে হত্যা এবং নারীনির্যাতন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। পাকসেনারা তাদের দোসরদের সহযোগিতায় চৌধুরীপাড়া, রামগড় পোস্ট অফিস ও সোনই পুলে বন্দিশিবির এবং নারীনির্যাতন কেন্দ্র স্থাপন করে। এসব স্থানে বহু সাধারণ মানুষ ও অনেক নারীকে নির্যাতন করা হয়।
রামগড় উপজেলায় একটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়, যা চৌধুরীপাড়া বধ্যভূমি নামে পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রামগড় উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে চারটি অপারেশন পরিচালনা করেন। সেগুলো হলো— রামগড় অপারেশন, রামগড় এম্বুশে, নাকাপা আর্মিক্যাম্প অপারেশন, মহামনিপাড়া অপারেশন, কালাপানি ক্যাম্প আক্রমন এবং রামগড় বিমান আক্রমণ।
রামগড়ে পাকবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স ও একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। ১৪ই আগস্ট ভোরের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে আক্রমণ চালান। অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান উদযাপনে পাকসেনাদের ভীত- সন্ত্রস্ত করে তোলা। এ অপারেশনে অংশ নেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা (কমান্ডার), রণবিক্রম ত্রিপুরা, রণজিৎ দেববর্মণ, সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, ধীমান বড়ুয়া, ভুবন ত্রিপুরা (অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য), নীলমোহন ত্রিপুরা প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা। ১৫ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের রামগড় এম্বুশে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। নাকাপা আর্মিক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় ১৬ই সেপ্টেম্বর। মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবসেক্টর থেকে এসে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার গভীর অরণ্য অতিক্রম করে পাকসেনাক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল পাকসেনাদের এখান থেকে বিতাড়িত করে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচল নির্বিঘ্ন করা। এতে তাঁরা সফল হন। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে পাকসেনারা পরের দিন ১৭ই সেপ্টেম্বর ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। রামগড় মহামনিপাড়া অপারেশন পরিচালিত হয় ১৪ই অক্টোবর কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে। এ অপারেশনে পাকবাহিনীর একজন কর্নেলসহ ১০জন সেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। অপরদিকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। রামগড় বিমান আক্রমণ পরিচালিত হয় ৬ ও ৭ই ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাকবাহিনীর এ অবস্থানের ওপর বিমান আক্রমণ চালায়। এ অপারেশনে গাইড ও সার্ভেয়ারের দায়িত্ব পালন করেন ধর্মদাস ত্রিপুরা (কার্বারী), দীনবন্ধু ত্রিপুরা, মংসাজাই চৌধুরী প্রমুখ।
রামগড় উপজেলার পাতাছড়া ইউনিয়নে পাকবাহিনীর কালাপানি ক্যাম্পে মংশোয়ে অং মারমা (জুলু বাবু) ও হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা এবং আলী আশরাফ তিন গ্রুপ কমান্ডার যৌথভাবে মিলিত হয়ে প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিন দিক থেকে আক্রমন করে। প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা যাবত গোলাগুলির পর পাকবাহিনী পিছু হঠে এবং ক্যাম্প ছেড়ে মানিকছড়ির দিকে পালিয়ে যায়। ৮ই ডিসেম্বর পাকসেনারা পালিয়ে গেলে রামগড় উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। এর পরপরই মুক্তিযোদ্ধা, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং আওয়ামী লীগ নেতা মো. সুলতান আহম্মদসহ অন্য নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে রামগড় পোস্ট অফিস প্রাঙ্গণে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
পার্বত্য এলাকার যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাঁরা হলেন- হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা (কমান্ডার), রণবিক্রম ত্রিপুরা, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, কালাচান দেববর্মণ, বাবুল মজুমদার, মণীন্দ্র কিশোর ত্রিপুরা, অংকিউ মারমা, ভুবন ত্রিপুরা, রণজিত কিশোর দেববর্মণ, নীলা মোহন ত্রিপুরা, মণীন্দ্র কুমার নাথ, গণচন্দ্র ত্রিপুরা, আব্দুর রহমান, আব্দুর রহমান (কুহিনুর সার্কাস), প্রিয়জ্যোতি রোয়াজা, আলী আশ্রাফ মাস্টার, শেখ আহাম্মদ, ধীমান কান্তি বড়ুয়া, সন্তোষ কুমার নাথ, নিতাই চন্দ্র দাস, দুলাল চন্দ্র দে, মুলকুতর রহমান, লোকনাথ ত্রিপুরা, আবু কালাম, ছালেহ আহমদ, বিনোদ বিহারী দাস, সুলতান আহাম্মদ, ব্রজেন্দ্র কুমার ত্রিপুরা, যতীন্দ্র কুমার দাস, রাখাল চন্দ্ৰ পাল, দাস, মনোরঞ্জন দাস, অনিল চন্দ্র দাস, সমীর শীল, বরুণ চন্দ্র পাল, আবদুল বারেক, নুরনবী চৌধুরী, অমূল্য চরণ দাস, মো. সফর মিয়া, শাহ নেওয়াজ, মাখন বড়ুয়া, মো. তোফাজ্জল, ঝন্টু কুমার ঘোষ, বিজয় ত্রিপুরা এবং মমং মগ।
রামগড় উপজেলার কোনো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়নি। তবে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার অধিবাসী ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম ২৭শে এপ্রিল মহালছড়ি (খাগড়াছড়ি) প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ হন। রামগড় শহরেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। এছাড়া ১৪ই অক্টোবর মহামনিপাড়া যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
রামগড় উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। উপজেলা কার্যালয়ের সম্মুখে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘বিজয়’, বিজিবি গেইটের সম্মুখে শহীদদের স্মরণে ভাস্কর্য এবং রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন রাস্তার পার্শ্বে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের, বীর উত্তমএর সমাধিসৌধ, তাঁর স্মরণে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং তাঁর নামে রামগড় থেকে জালিয়া পাড়া পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [অংশেপ্রু মারমা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড