You dont have javascript enabled! Please enable it!

রামগতি থানাযুদ্ধ (রামগতি, লক্ষ্মীপুর)

রামগতি থানাযুদ্ধ (রামগতি, লক্ষ্মীপুর) সংঘটিত হয় ৪ঠা জুলাই ও ৪-৫ই ডিসেম্বর দুবার। বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার অন্তর্গত রামগতি উপজেলায় ছোট-বড় অনেক যুদ্ধ হয়েছে। তন্মধ্যে এ-দুটি যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দুটি যুদ্ধই হয় পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারদের সঙ্গে।
জুন মাসের শেষার্ধে শতাধিক পাকমিলিশিয়া স্টিমারযোগে রামগতি থানায় আসে এবং স্টিমার ঘাটসংলগ্ন পানি উন্নয়ন বোর্ড ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারপর কয়েকদিন ধরে তারা আশপাশের বাড়িঘরে, বিশেষত হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। এ-সময় তারা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী কাজ করে। তারপর প্রায় ৫০ জন মিলিশিয়া ও রাজাকার রেখে বাকিরা লক্ষ্মীপুর সদরে চলে যায়। পরে তাদের সঙ্গে আরো অনেক স্থানীয় রাজাকার যাগ দেয়। এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় ফিরে আসেন। তাঁরা খবর পান যে, জেলা হেডকোয়ার্টার্স থেকে নদীপথে পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও রাজাকারদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা এসব অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেন। অপারেশনের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে তাঁরা ৪ঠা জুলাই থানা আক্রমণ করেন। প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। প্রচণ্ড গোলাগুলির পর এক পর্যায়ে গভীর রাতে রাজাকার ও পুলিশরা থানা থেকে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে ৭০টি অত্যাধুনিক রাইফেল ও বিপুল পরিমাণ গুলি উদ্ধার করেন। প্রথমবারের এ-যুদ্ধে মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) আঞ্চলিক (জোন সি রামগতি ও হাতিয়া) অধিনায়ক মো. মোশারেফ হোসেন, থানা অধিনায়ক হাসান মাহমুদ ফেরদৌস এবং এফএফ কমান্ডার সুবেদার লতিফের নেতৃত্বে প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন।
দ্বিতীয়বারের যুদ্ধ হয় ৪-৫ই ডিসেম্বর। ৪ঠা ডিসেম্বর খুব ভোরবেলা খবর আসে যে, রামগতি স্টিমার ঘাট সংলগ্ন পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনী নদীপথে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের নেয়ার জন্য নদীর ঘাটে একটি স্টিমার অপেক্ষা করছে। এ-খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধারা তৎক্ষণাৎ ক্যাম্পের দিকে রওনা হন। তাঁরা ক্যাম্পে পৌঁছার আগেই হানাদার বাহিনী ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু তখনো স্টিমারে উঠতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পের সন্নিকটে পৌঁছেই পেছন দিক থেকে তাদের আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমণে হতবিহ্বল মিলিশিয়া ও রাজাকাররা স্টিমার ঘাট সংলগ্ন একটি দোতলা সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেয় এবং সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। সারারাত উভয় পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ গোলাগুলি চলে। গোলাগুলির শব্দ শুনে নদীতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর একটি স্পিডবোট থেকে মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। অপরদিকে, যুদ্ধের খবর পেয়ে হাতিয়া সীমান্তে অবস্থানরত শাহ আবদুল মাজেদ (উপ-অধিনায়ক জোন সি) এবং মো. রফিকুল আলম (উপ-অধিনায়ক, হাতিয়া জোন) একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নদীপথে এসে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন।
এক পর্যায়ে রাতের অন্ধকারে মিলিশিয়া বাহিনী ও রাজাকাররা যুদ্ধে আহত-নিহত সৈনিকদের নিয়ে স্টিমারযোগে পালিয়ে যায়। গুলিতে মারাত্মক আহত এক পাকিস্তানি মিলিশিয়া সৈনিককে মুক্তিযোদ্ধারা ধানক্ষেত থেকে আটক করেন। এলাকার এক পীরের অনুরোধে তাঁরা তাকে হত্যা না করে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি জামাল উদ্দিনের বাড়িতে নিয়ে চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করেন পরবর্তীতে সুস্থ হলে রেডক্রসের মাধ্যমে তাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দুজন সদস্য আহত হন। এভাবে ৬ই ডিসেম্বর রামগতি থানা হানাদারমুক্ত হয় এবং এলাকাবাসী বিজয় উল্লাসে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে মিছিল করে। [শাহ আবদুল মাজেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!