রামদিয়া অভিযান (বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ী)
রামদিয়া অভিযান (বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ী) পরিচালিত হয় ৫ই জুন শ্রীপুর বাহিনীর প্রধান আকবর হোসেনের নেতৃত্বে। রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার অন্তর্গত রামদিয়া ছিল ঐ অঞ্চলের একটি বিশিষ্ট ব্যবসাকেন্দ্র এলাকাটি চন্দনা নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত। এখান থেকে রেল ও নদীপথে বিভিন্ন কৃষিপণ্য দেশের নানা জায়গায় চালান হতো। রেল স্টেশনের কাছে ছিল ৪টি জুট বেলিং প্রেস। ইস্পাহানি, রেলি ব্রাদার্স, তিব্বত ও কোহিনূর কোম্পানির আড়ত ছিল। ভগবান আগরওয়ালা এবং গদুনাথ মারোয়ারী ছিলেন দুজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। চল্লিশজন স্বর্ণকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মধু কর্মকার, নারায়ণ কর্মকার, চন্দ্র কর্মকার এবং শ্রীমন্ত কর্মকার। বিখ্যাত এই জনপদের ত্রাস ছিল চাঁদ খাঁ নামে এক বিহারি। তার নেতৃত্বে বিহারি রাজাকাররা এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রামদিয়া এলাকায় চাঁদ খাঁর নেতৃত্বে বিহারিরা বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আওয়ামী লীগ- কর্মীদের খুঁজে বের করা, স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের টাকা-পয়সা, সোনা-দানা লুট করা, হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, নারীদের ধর্ষণ করা ইত্যাদি অপকর্ম শুরু করে। তাদের অত্যাচার এক সময় চরমে ওঠে। এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য এলাকার লোকজন আকবর হোসেনের সহায্য প্রার্থনা করে। ইপিআর সদস্য সিরাজুল ইসলাম এবং সাংবাদিক এম ইকরামুল হক এ-দুজন চাঁদ খাঁ বাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে তাঁকে বিস্তারিত অবহিত করেন। এরপর আকবর হোসেন চাঁদ খাঁর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী তিনি ১৮টি রাইফেলসহ তাঁর বাহিনী নিয়ে একদিন রাত ১০টার দিকে গড়াই নদী পাড় হয়ে এক বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরদিন সকালে তাঁরা দুভাগে ভাগ হয়ে স্থানীয় আব্দুল মালেক ও আব্দুল হাইয়ের বাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে সকালে তাঁরা রামদিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
চাঁদ খাঁ তখন রামদিয়া বাজারের নিকট এক হিন্দু ব্যক্তির একটি দোতলা বাড়ি দখল করে তার কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল। ৫ই জুন মুক্তিযোদ্ধারা বাজারের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটি গুলি এসে মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের মাথার খুব কাছ দিয়ে চলে যায়। তৎক্ষণাৎ অধিনায়কের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশনে চলে যান। দুপক্ষে গোলাগুলি শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফের গুলিতে চাঁদ খাঁ নিহত হয়। কিছুক্ষণ গোলাগুলির পর মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যেতে থাকেন। এমন সময় চাঁদ খাঁর ছেলে রমজান একটি রামদা নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে সে-সহ আরো কয়েকজন বিহারি ঘটনাস্থলে নিহত হয়। চাঁদ খাঁর নাবালক পুত্র ও তার ভাইয়ের স্ত্রীসহ কয়েকজন বিহারি ছেলে-মেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। ৪টি রাইফেলও মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা কিছুক্ষণ বাড়িটি ঘিরে রাখেন। বিকেলের দিকে তাঁরা রামদিয়া বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে রওনা হন। সামনে পড়ে চন্দনা নদী। নদীর ধারে বহু লোক তাঁদের অভিনন্দন জানায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এ অভিযানের খবর প্রচারিত হলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়।
রামদিয়া অভিযানে খোন্দকার নাজায়েত আলী, সিরাজুল ইসলাম (ইপিআর), আব্দুল খালেক, আনারদ্দিন, আব্দুল লতিফ (ইপিআর), মনোয়ার হোসেন (ইপিআর), আব্দুল ওহাব, আনোয়ার হোসেন (সেনাসদস্য), ইন্তাজ, আনোয়ার, রেজা, বাঁশী, নজর আলী, আব্দুল খালেক, আবেদ আলী, আবুল কালাম, আব্দুল হাই, জাহাঙ্গীর, মোক্তাদের রহমান, সুলতান আহমদ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। রামদিয়া বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি ভাস্কর্য নির্মিত হয়। [এম ইকরামুল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড