নির্যাতিতা নারী রাবেয়া খাতুন
রাবেয়া খাতুন নির্যাতিতা নারী। পাকিস্তানি হানাদারদের রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স দখলের অন্যতম প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি তখন পুলিশ লাইন্সে স্যুইপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনে স্যুইপার হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার কাতর মিনতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এরপর দীর্ঘ নয় মাস রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের আবর্জনা পরিষ্কারের পাশাপাশি প্রত্যক্ষ করেন পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক আচরণের দৃশ্য, যার মর্মস্পর্শী বিবরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র-এর অষ্টম খণ্ডে (পৃষ্ঠা ৪২) উল্লেখ রয়েছে।
২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর যে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, সেই পৈশাচিকতার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স। সেদিন আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ৩০৩ রাইফেল নিয়ে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা মরণপণ প্রতিরোধযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। শেষরাতে পুলিশের গোলা-বারুদ ফুরিয়ে গেলে হানাদার বাহিনী পুলিশ লাইন্স দখল করে নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইন্সে ব্যাপক লুটপাট করে, আটকে পড়া পুলিশদের যথেচ্ছভাবে হত্যা করে লাশ বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় এবং স্যুইপার রাবেয়াসহ অন্য নারীদের ওপর নির্মম পাশবিক নির্যাতন চালায়। পরবর্তীতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের হেডকোয়ার্টার্স ভবনটিকে তাদের নির্যাতন ক্যাম্পে পরিণত করা হয়।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে কর্মরত স্যুইপার রাবেয়ার ভাষ্য: “১৯৭১ খ্রিঃ ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার পাঞ্জাবী সেনারা যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের উপর অতর্কিতে হামলা চালায় তখন আমি রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের এসএএফ কেন্টিনে ছিলাম। আসন্ন হামলার ভয়ে আমি সারাদিন পুলিশ লাইসের ব্যারাক ঝাড়ু দিয়ে রাতে ব্যারাকে ছিলাম। কামান, গোলা, লাইটবোম আর ট্যাঙ্কের অবিরাম কানফাটা গৰ্জ্জনে আমি ভয়ে ব্যারাকের মধ্যে কাত হয়ে পড়ে থেকে থরথরিয়ে কাঁপছিলাম। ২৬শে মার্চ সকালে ওদের কামানের সম্মুখে আমাদের বীর বাঙালি পুলিশ বাহিনী বীরের মত প্রতিরোধ করতে করতে আর টিকে থাকতে পারে নাই। সকালে ওরা পুলিশ লাইনসের এসএএফ ব্যারাকের চারদিকে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ব্যারাকের মধ্যে প্রবেশ করে বাঙালি পুলিশদের নাকে, মুখে, সারা দেহে বেয়নেট ও বেটন চার্জ করতে করতে ও বুটের লাথি মারতে মারতে বের করে নিয়ে আসছিল। ক্যান্টিনের কামড়া থেকে বন্দুকের নলের মুখে আমাকেও বের করে আনা হয়, আমাকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় এবং আমার উপর প্রকাশ্যে পাশবিক অত্যাচার করছিল আর কুকুরের মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। আমার উপর উপর্যুপরি পাশবিক অত্যাচার করতে করতে যখন আমাকে একেবারে মেরে ফেলে দেওয়ার উপক্রম হয় তখন আমার বাঁচবার আর কোন উপায় না দেখে আমি আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য ওদের নিকট কাতর মিনতি জানাচ্ছিলাম। আমি হাউ মাউ করে কাঁদছিলাম, আর বলছিলাম আমাকে মেরোনা, আমি স্যুইপার, আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পায়খানা ও নর্দমা পরিষ্কার করার আর কেউ থাকবে না, তোমাদের পায়ে পড়ি তোমরা আমাকে মেরোনা, মেরোনা, মেরোনা, আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পুলিশ লাইন রক্ত ও লাশের পঁচা গন্ধে মানুষের বাস করার অযোগ্য হয়ে পড়বে। তখনও আমার উপর এক পাঞ্জাবী কুকুর, কুকুরের মতই আমার কোমড়ের উপর চড়াও হয়ে আমাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করছিল। আমাকে এভাবে ধর্ষণ করতে করতে মেরে ফেলে দিলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স পরিষ্কার করার জন্য আর কেউ থাকবে না একথা ভেবে ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে এক পাঞ্জাবী সেনা ধমক দিয়ে বলতে থাকে, “ঠিক হায়, তোমকো ছোড় দিয়া যায়েগা জারা বাদ, তোম বাহার নাহি নেকলেগা, হার ওয়াকত লাইন পার হাজির রাহেগা’ একথা বলে আমাকে ছেড়ে দেয়।”
স্যুইপার রাবেয়া বাঙালি নারীদের ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার বিবরণে আরো উল্লেখ করেন যে, পাঞ্জাবি সেনারা রাজাকার ও দালালদের সাহায্যে প্রতিদিন বহু বাঙালি যুবতী মেয়ে, রূপসী মহিলা এবং সুন্দরী বালিকাদের জিপ ও মিলিটারি ট্রাকে করে এনে পুলিশ লাইসের বিভিন্ন ব্যারাক এবং হেডকোয়ার্টার্স বিল্ডিং-এর ওপর তলার রুমে নিয়ে রাখত। এসব নিরীহ বাঙালি নারীদের উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে রাখা হতো এবং তাদের পাহারা দিত সশস্ত্র পাঞ্জাবি সেনারা। লাইন থেকে পাঞ্জাবি সেনারা কুকুরের মতো জিভ চাটতে চাটতে ব্যারাকের মধ্যে উন্মত্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে প্রবেশ করত। রাবেয়া ড্রেন পরিষ্কার করার অজুহাতে লক্ষ করেন, পাকিস্তানি সেনারা সেই মেয়েদের কীভাবে ধর্ষণ করত আর দাঁত দিয়ে স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে-কামড়াতে রক্তাক্ত করে দিত। ওদের উদ্ধত ও উন্মত্ত কামড়ে অনেক কচি মেয়ের স্তনসহ বক্ষের মাংস উঠে আসত, মেয়েদের গাল, পেট, ঘাড়, বক্ষ, পিঠ ও কোমরের অংশ ওদের অবিরাম দংশনে রক্তাক্ত হতো। যে সকল বাঙালি যুবতী ওদের প্রমত্ত পাশবিকতার শিকার হতে অস্বীকার করত, তৎক্ষণাৎ পাঞ্জাবি সেনারা তাদের চুল ধরে টেনে এনে স্তন কেটে ফেলত এবং যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে সেই বীরাঙ্গনাদের পবিত্র দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিত।
ক্যাম্পে নারীদের দুর্দশার উল্লেখ করে রাবেয়া বর্ণনা করেন যে, অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত মহিলা এবং মেয়েদের প্রকৃতির কাজ সারার জন্য হাত ও চুলের বাঁধন এক মুহূর্তের জন্যও খুলে দেয়া হতো না। এই ঝুলন্ত উলঙ্গ মেয়েরা হাতবাঁধা অবস্থায় লোহার তারে ঝুলে থেকে সেখানে তা সারত। রাবেয়া প্রতিদিন সেখানে গিয়ে এসব প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কার করতেন এবং দিনের বেলায়ও বন্দি মহিলাদের পূতিগন্ধ প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কার করার জন্য সারাদিন উপস্থিত থাকতেন। কোনো বাঙালি এমনকি রাবেয়া ছাড়া অন্য কোনো স্যুইপারকেও সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হতো না। সেখানে সর্বক্ষণ কড়া পাহারার ব্যবস্থা থাকায় এসব মেয়েদের উপকারে আসা কারো পক্ষে সম্ভব হতো না। তা সত্ত্বেও রাবেয়া সিদ্ধেশ্বরীর রানু নামের একটি মেয়েসহ কয়েকজন নির্যাতিতাকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ডিসেম্বরের প্রথমদিকে মিত্রবাহিনী- ঢাকায় বোমা বর্ষণের সঙ্গে-সঙ্গে পাঞ্জাবি সেনারা বন্দি নারীদের নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে। রাজারবাগ হেডকোয়ার্টার্স অফিসের ওপর তলায়, সমস্ত কক্ষে এবং বারান্দায় এই নিরীহ মহিলা ও বালিকাদের তাজা রক্ত জমাট হয়েছিল। [আবিদা সুলতানা]
নোট: স্যুইপার রাবেয়া খাতুন সাক্ষাৎকার আকারে বিবরণটি দেন ১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪। স্যুইপার রাবেয়া খাতুনের ছবি বা ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড), ঢাকা, হাক্কানী পাবলিশার্স ২০০৩; হাবিবুর রহমান (সম্পাদিত), মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ (তৃতীয় মুদ্রণ), বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ২০১৮; আসাদুজ্জামান আসাদ (সম্পাদিত), একাত্তরের গণহত্যা ও নারী নির্যাতন, ঢাকা, সময় প্রকাশনী ১৯৯২; আবিদা সুলতানা, শহিদ পুলিশের রক্তের ঋণ, ঢাকা, সময় প্রকাশনী ২০১৬
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড