রাজেশ্বর-লাকুড়তলা গণহত্যা (শরণখোলা, বাগেরহাট)
রাজেশ্বর-লাকুড়তলা গণহত্যা (শরণখোলা, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ২৮শে জুন। স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আলসামস ও শান্তি কমিটির লোকজন পাকবাহিনীকে পথ চিনিয়ে এ গ্রামগুলোতে নিয়ে যায়। গণহত্যার পর তারা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতন চালায়।
লাকুড়তলা ও রাজেশ্বর পাশাপাশি দুটি গ্রাম। এ গ্রামদুটির পাশেই দক্ষিণ কদমতলা গ্রাম। শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের রায়েন্দা বাজার থেকে দক্ষিণে জিলবুনিয়া গ্রামের সীমান্তে বলেশ্বর নদীর পাশ ঘেঁষে রাজেশ্বর গ্রাম। এ গ্রামে বলেশ্বর নদীর তীরে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান গঙ্গাস্নান ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। রাজেশ্বর, কদমতলা ও লাকুড়তলা গ্রামে বেশকিছু সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের বসবাস ছিল। ২৮শে জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা গ্রামগুলো ঘেরাও করে হামলা চালায় এবং দিনভর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতন করে।
রায়েন্দা বাজার থেকে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার প্রথমে রাজেশ্বর গ্রামে ঢোকে। হানাদার বাহিনীর আসার খবর পেয়ে গ্রামের লোকজন বিশেষ করে হিন্দুরা পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু হানাদাররা গ্রামটির চারদিক থেকে ঘিরে ফেলায় অনেকের পক্ষে পালানো সম্ভব হয়নি। যারা পালাতে পারেনি পাকিস্তানি বাহিনী তাদের খুঁজে বের করে জবাই করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন— গোপাল হালদার (পিতা ঈশ্বর চন্দ্র হালদার), ক্ষিরোদ কুলু (পিতা হাজারি কুলু), মনোহর কুলু (পিতা বাবু চান কুলু), কার্তিক বালা (পিতা নিরোদ বালা), যতীন্দ্র নাথ এদবর প্রমুখ। উল্লেখ্য, গ্রামের মধ্য থেকে তাফালবাড়ী হয়ে বলেশ্বর নদীতে মিশে যাওয়া খালে রাজাকাররা লাশগুলো ফেলে দেয়।
একই দিনে লাকুড়তলা ও কদমতলা গ্রামেও হানাদাররা গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীনির্যাতন চালায়। এ দুগ্রামের অটল বিহারী কুলু (পিতা শ্রীচরণ কুলু, লাকুড়তলা), মনোরঞ্জন কুলু (পিতা অদর কুলু, লাকুড়তলা, মহানন্দ সমাদ্দার (পিতা বসন্তকুমার সমাদ্দার, কদমতলা), মনিন্দ্র সাধক (পিতা অভয় চরণ সাধক, লাকুড়তলা), বিমল সাধক (পিতা দয়াল সাধক, লাকুড়তলা), ভোলানাথ হালদার, বিনোদ কুলু (পিতা হাজারী কুলু, কদমতলা), নিরোদ কুলু (পিতা হাজারী কুলু, কদমতলা) প্রমুখকে তারা দড়ি দিয়ে বেঁধে জবাই করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। অটল বিহারী কুলুকে যখন জবাই করে তখন তার মা কৈলাসমনি কুলু পুত্রকে রক্ষার জন্য সামনে গিয়ে দাঁড়ালে রাজাকাররা রাইফেলের বাট দিয়ে তার হাত ভেঙ্গে দেয়। এ আঘাত ও পুত্রশোকে কয়েকদিনের মধ্যে কৈলাসমনি মৃত্যুবরণ করেন। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা গ্রামের সকল হিন্দুর বাড়ি লুট করে ও পরে পুড়িয়ে দেয়। দুই গ্রামের প্রায় সকল নারী তাদের দ্বারা লাঞ্ছিত হন। এ গণহত্যার পর এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ফলে ঐ এলাকার হিন্দুদের অনেকে জীবন বাঁচাতে ভারতের শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় নেয়। এদিনের গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীনির্যাতনে হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করে রাজাকার আ. আজিজ মাস্টার, আ. লতিফ পঞ্চায়েত, মতি তালুকদার, রফেজ পাহলান, লুৎফর, আনোয়ার খাঁ, কাঞ্চন খাঁ, আ. ছত্তার, আমির ঘরামী, হামিদ ফরাজী, ক্বারী আ. খালেক হাওলাদার, কাদের মোল্লা, জয়নাল, ওহাব হাজী ও শান্তি কমিটির মকবুল হাওলাদারসহ শতাধিক শতাধিক স্বাধীনতা-বিরোধী। এখানে প্রধানত রায়েন্দা বাজারের ক্যাম্পের রাজাকাররা অংশ নেয়। আক্কেল আলী, লাল মিয়াসহ অনেকে লুটপাটে অংশ নেয়। [আবু জাফর জব্বার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড