রাজাপুর যুদ্ধ (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট)
রাজাপুর যুদ্ধ (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ১৩ই নভেম্বর। এতে বেশকয়েকজন রাজাকার নিহত হয় এবং বাকি রাজাকার ও পাকসেনারা পলায়ন করে।
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে ভোলা নদীর পূর্বপাড়ে রাজাপুর গ্রামের অবস্থান। এ গ্রামে হাসেম ডিলারের বাড়ি। হাসেম ডিলার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন লোক। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি তাঁর নিজ বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেন। তাঁর বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধারা ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করতেন। ১৩ই নভেম্বর মোড়েলগঞ্জ এবং শরণখোলা থেকে রাজাকার ও পাকবাহিনীর একটি বড় দল রাজাপুর গ্রামে আসে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সুন্দরবনের মুক্তিযোদ্ধাদের অবরুদ্ধ করে রাখা এবং মুক্তিযোদ্ধারা যাতে কোনোভাবে বেরিয়ে আসতে না পারেন সেদিকে নজর রাখা। তারা রাজাপুর, ছোট রাজাপুর, দক্ষিণ রাজাপুর, উত্তর রাজাপুর প্রভৃতি গ্রামে প্রবেশ করে স্বাধীনতার পক্ষের অসংখ্য লোককে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনীর ১৫-২০ জনের একটি দল পশ্চিম রাজাপুর গ্রামে প্রবেশ করে সাধারণ লোকজনদের ধরে এনে ওয়াপদা রাস্তা ও রাজাপুর বাজারে জবাই করে হত্যা করে। এ খবর জানতে পেরে পশ্চিম রাজাপুর গ্রামের মানুষ ভোলা নদী পার হয়ে রাতের মধ্যেই সুন্দরবনে এসে আশ্রয় নেয়। আমজাদ হোসেন মল্লিক হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য সুন্দরবনের পশ্চিমাঞ্চলের সহকারী কমান্ডার খালিদ হোসেনের কাছে অনুমতি চান। তৎক্ষণাৎ অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে আমজাদ হোসেন, হেমায়েত হোসেন মৃধা, খলিলুর রহমান, ছফর আলী, ইউসুফ আলী, শেখ মশিউর রহমান, আব্দুল খালেক শিকদার ও আব্দুল হাসেম সহ ১৩ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল ছোট একটি নৌকায় করে ভোলা নদী পাড়ি দিয়ে নদীর পাড়ে অবস্থিত একটি মাদ্রাসার কাছে ওঠেন। মাদ্রাসার ভেতরে ছিল রাজাকারদের অবস্থান। রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি টের পেয়ে মাদ্রাসার ভেতর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি বর্ষণ করে। গুলির শব্দ শোনামাত্র সুন্দরবনে আশ্রয় নেয়া গ্রামবাসীরা অনুমান করে আমজাদ মল্লিকের মুক্তিযোদ্ধা দল হয়তো হানাদার বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। বনে আশ্রিত গ্রামবাসী উচ্চস্বরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে। স্লোগানে সুন্দরবন এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। হানাদার বাহিনীর অব্যাহত গুলির সামনে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা দল বেড়িবাঁধের ওপর উঠে রাজাকারদের ওপর ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের প্রত্যেকটি ফায়ারিং পয়েন্ট লক্ষ করে গুলি করতে থাকেন। একই সঙ্গে তাঁরা শত্রুবাহিনীর প্রত্যেকটি অবস্থানে নদীতীর থেকে বেড়িবাঁধের বিপরীতে গ্রেনেড চার্জ করেন। এক পর্যায়ে সুইসগেট ভেঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের গানপয়েন্টের ভেতরে ঢুকে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষিপ্র গতিতে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকেন। কিছু সময় পর তাঁরা দেখতে পান ব্রাশ ফায়ারে ৪- ৫ জন রাজাকার নিহত হয়ে পড়ে আছে। অনেকে আহত হয়েছে। আহত ও অক্ষত রাজাকাররা পালিয়ে যেতে থাকলে আমজাদ মল্লিক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাদের ধাওয়া করে গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েন। রাজাকারদের ওপর আক্রমণকালে গ্রামবাসী উচ্চস্বরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে। তাদের গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের শব্দে ভীত হয়ে কয়েকজন রাজাকার বেড়িবাঁধের খাদ থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যতবার ধ্বনিত হয়, শত্রু বাহিনী ততটাই পিছু হটে। জনতার ভয়ে ভীত হয়ে রাজাকাররা রাস্তার এদিক-সেদিক পালাবার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা জনতাকে ইশারা করামাত্র তারা ক্ষিপ্র গতিতে রাজাকারদের পাকড়াও করে এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। অনেকে পালাবার চেষ্টা করে জনতার হাতে নিহত হয়।
একই সময়ে কমান্ডার খালিদ হেডকোয়ার্টার্স থেকে একটি বড় বাহিনী নিয়ে ভোলা নদী পার হয়ে যুদ্ধস্থলে পৌঁছান। মুক্তিযোদ্ধাদের এই সম্মিলিত দল কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে হানাদার বাহিনীর অবস্থান লক্ষ করে গুলি বর্ষণ করে। কমান্ডার খালিদ হোসেনের দুঃসাহসিক আক্রমণের সামনে পাকহানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে পেছন ফিরে অতি দ্রুত শরোণখোলার দিকে পলায়ন করে। এ-যুদ্ধটি ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা প্রায় ৩ শতাধিক হানাদার বাহিনীর সামনে মাত্র ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলের মুখোমুখি হওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। শুধুমাত্র ‘জয় বাংলা’ স্লোগান মুক্তিযোদ্ধাদের এতটাই অনুপ্রেরণা ও শক্তি যুগিয়েছিল যে, মৃত্যুর ঝুঁকি তাদের বিচলিত করেতে পারেনি। [শেখ মশিউর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড