You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স প্রতিরোধযুদ্ধ

১৯৭১ সালের মার্চের অগ্নিঝরা দিনে পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীসহ সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ছিলেন খুবই উজ্জীবিত। সরকারের অস্ত্রধারী বাহিনীর বাঙালি সদস্য হিসেবে সে-সময় সারাদেশে সাধারণ মানুষের কাছে একান্ত আপন জন ছিল পুলিশ। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নিকট এ অবস্থাটি নিশ্চিতভাবেই মানসিক পীড়নের কারণ ছিল। তদুপরি ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রতিরোধের নীরব প্রস্তুতি চলতে থাকে। ১৬ই মার্চ প্রেসিডেন্ট গার্ড ডিউটিতে নিয়োজিত পুলিশের ট্রাক ও জিপে কালো পতাকা ওড়ানো হয়। পেশাগত কারণেই পাকিস্তানি সরকার তথা সামরিক জান্তার আচরণ বিশেষ করে এদেশের জনসাধারণ সম্পর্কে তাদের ধারণা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন পুলিশের সদস্যরা। পাকিস্তান সরকার বুঝতে পেরেছিল যে, পূর্ব বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক কার্যক্রমে পুলিশ সরকারের পক্ষে অস্ত্র ধারণ করবে না। এ কারণে ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে গণহত্যার নীলনকশায় অপারেশন সার্চলাইট-এর অন্যতম লক্ষ্যস্থল ছিল পুলিশ বিশেষত রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স।
১৯৫৩ সালে রাজারবাগে নির্মিত হয় ঢাকা জেলা পুলিশ লাইন্সের হেডকোয়ার্টার্স ভবন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এখানে নির্মিত হয় পিআরএফ (প্রভিন্সিয়াল রিজার্ভ ফোর্স)-এর ব্যারাক, ওয়ার্কশপ, আস্তাবল, অফিসার্স কোয়ার্টার্স, জুনিয়র অফিসার্স কলোনি এবং তিনটি বড় পুকুর। উত্তর ও দক্ষিণের দুটি গেট ছিল ভেতরে আসার মূল প্রবেশপথ। রাজারবাগের পশ্চিমে চারতলার এসবি ও সিআইডি ভবন এবং দক্ষিণে ডন স্কুল ছাড়া অন্য সব ভবন ছিল একতলা, দোতলা কিংবা টিনের তৈরি আধাপাকা বিল্ডিং।
২৫শে মার্চ দুপুর থেকে পুলিশের বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারাকে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যগণ পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলায় প্রতিরোধযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকেন। একই দিন দুপুরের পর খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, সরকারের সঙ্গে নেতৃবৃন্দের আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা নিশ্চিত অনুমান করতে পারেন যে, চূড়ান্ত যুদ্ধ আসন্ন। তাই অনেক পুলিশ সদস্য রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্ব পালন শেষ না করেই রাজারবাগে ফিরে আসতে শুরু করেন। সন্ধ্যার আগ থেকে চরম উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে পুলিশ লাইন্সে। এদিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে ট্যাংক, মর্টার, কামানসহ পাকিস্তানি হানাদারদের সাঁজোয়া বহর। রাত আনুমানিক ১০.৩০ মিনিটের দিকে বহরটি ফার্মগেটে আসতেই তেজগাঁও থানার অপারেটর চার্লি-৭ রাজারবাগ বেইজ স্টেশনে বেতার বার্তার মাধ্যমে সংবাদটি পৌঁছে দেয়, Charley 7 for base, about 35- 40 trucks loaded with Pak army are proceeding towards Dhaka city from cantonment area’|
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে অবস্থানরত পেট্রল পার্টির সদস্যগণ সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানের বহরকে ঐ এলাকা অতিক্রম করে রাজারবাগের দিকে অগ্রসর হতে দেখে। তৎক্ষণাৎ পুলিশের পেট্রল গাড়িটি ভিন্ন পথে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পৌঁছে এ সংবাদ দেয়। এ সংবাদ প্রচারের সঙ্গে- সঙ্গে পুলিশ লাইন্সে অবস্থিত সকলেই প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। পুলিশ সদস্যরা পুলিশ লাইন্সের চতুষ্পার্শ্বস্থ রাস্তায় স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিলে ব্যারিকেড স্থাপন করেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ পুলিশ জাদুঘর সাঁজোয়া যানসমূহ সৈন্যসহ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের চারদিক ঘিরে অবস্থান গ্রহণ তাৎক্ষণিকভাবে রাজারবাগস্থ পুলিশের কেন্দ্রীয় ওয়ারলেস বেইজ স্টেশন থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর এ আক্রমণের সংবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে দেন কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। সংবাদটি ছিল এরূপ: Base for all stations of East Pakistan Police, keep listening, watch, we are already [being] attacked by the Pak Army, try to save yourself, over. এ-সময় রাজারবাগ ওয়ারলেস বেইজে আরো উপস্থিত ছিলেন এএসআই ইয়াছিন আলী তরফদার, কনস্টেবল মুসলিম আলী শরীফ, কনস্টেবল মনির হোসেন, কনস্টেবল মতিউর রহমান মতিন, কনস্টেবল আব্দুল লতিফ, কনস্টেবল সোহরাব হোসেনসহ আরো অনেকে।
পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সংবাদ পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের জানান তৎকালীন আইজিপি-র বডিগার্ড কনস্টেবল আব্দুল আলী। পুলিশ সার্জেন্ট মোহম্মদ মর্তুজার নেতৃত্বে ম্যাগাজিন গার্ডে বাংলাদেশের পতাকা
উত্তোলন করা হয়। এরপর অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। এ- সময় তাঁরা লাইন্সের চারদিকে, ব্যারাকের ছাদে, বিভিন্ন দালানের ছাদে এবং বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে অবস্থান নেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের দক্ষিণ-পূর্ব দিক (প্রাক্তন ডন স্কুল, বর্তমান ইস্টার্ন প্লাস মার্কেট) থেকে প্রথম গুলি বর্ষিত হয়। পুলিশের ছোড়া বুলেটটি একজন পাকিস্তানি সৈনিককে আঘাত হানে। সঙ্গে-সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ঐ সৈনিক ডন স্কুলের ওপর থেকে ছোড়া সেই বুলেটটি ছিল স্বাধীনতার সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের প্রথম বুলেট। এরপর প্যারেড গ্রাউন্ডের উত্তর-পূর্ব দিকের শাহজাহানপুর ক্রসিং ও মালিবাগ থেকেও গুলির শব্দ শোনা যায়। ব্যারাকের ছাদে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ করে গুলি বর্ষণ করেন। শুরু হয় দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ।
বাঙালি পুলিশ সদস্যদের মরণপণ প্রতিরোধে প্রাথমিকভাবে থমকে যায় ট্যাংক ও কামান সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী। একটু পরই তারা মর্টার ও হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পিআরএফ-এর চারটি ব্যারাকে আগুন ধরে যায়। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮শ।
রাত ১১.৪৫ মিনিটে শুরু হওয়া যুদ্ধ থেমে-থেমে চলতে থাকে রাত আনুমানিক ৩.০০-৩.৩০টা পর্যন্ত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ট্যাংক বহরসহ পুলিশ লাইন্সের প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করে। ফ্লেয়ার ছুড়ে আকাশ আলোকিত করে পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে গুলি করে হত্যা করতে থাকে। পুলিশ সদস্যদের গুলি শেষ হয়ে গেলে তাঁরা যাঁর যেদিক দিয়ে সম্ভব অবস্থান পরিবর্তন করার চেষ্টা চালান। দাউদাউ করে জ্বলছিল সমগ্র রাজারবাগ। তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক সাইমন ড্রিং- এক সাক্ষাৎকারে (মুক্তিযুদ্ধ পুলিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত) তখনকার পরিস্থিতি এভাবে বর্ণনা করেন-
We heard the sound of small arms fire coming from the direction of the Rajarbagh Police Lines, again it’s difficult to tell being stuck on the roof of hotel exactly what was going on. But around one O’clock sound of that gun fire turned into heavy weapons and it sounded very much of mortars and may be recoilless rifles would being fired in the direction of Rajarbagh Police Lines. Again we could see some signs of fire and tracer bullets and we knew that there must be a resistance because the police had the access to weapons. And by 1.30 the sound of the fighting and firing was quite heavy and in the morning as the sun came up and the dawn broke we could see smoke rising from the area of Rajarbagh Police Lines. পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এ-যুদ্ধে অনেক পুলিশ সদস্য শাহাদত বরণ করেন। এসআই, সুবেদার, হাবিলদার, নায়েক, সিপাহিসহ প্রায় দেড়শ বীর যোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হন। প্রতিরোধযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানি আর্মিদের ওয়ারলেস মেসেজ বিশ্লেষণে এর সত্যতা পাওয়া যায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার আক্রমণ ও গোলার আঘাতে রাজারবাগের রিজার্ভ অফিসের সকল দাপ্তরিক কাগজপত্র পুড়ে যাওয়ায় স্বাধীনতার প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও গবেষণায় প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে রাজারবাগেই ১১২ জন শহীদ পুলিশ সদস্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রকৃত শহীদ পুলিশ সদস্যের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ পুলিশ সদস্যদের স্মরণে রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ যারা’ শিরোনামে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে শহীদ কনস্টেবল সালাম ও জাহাঙ্গীরের সমাধি এবং টিএন্ডটি কলোনিতে অন্যদের সঙ্গে শহীদ পুলিশ সদস্যদের গণকবর রয়েছে। মিরপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল এন্ড কলেজ’। [আবিদা সুলতানা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!