মুক্তিযুদ্ধে রাজবাড়ী সদর উপজেলা
রাজবাড়ী সদর উপজেলা গোয়ালন্দ থানা নামে ১৮৮৮ সালে গঠিত হয়। তখন এটি ছিল গোয়ালন্দ মহকুমার অন্তর্গত সদর থানা। পরে গোয়ালন্দ মহকুমার নতুন নাম রাজবাড়ী হলে এ থানার নাম হয় রাজবাড়ী সদর থানা এবং গোয়ালন্দ নামে আরেকটি থানা হয়। ১৯৮৪ সালে রাজবাড়ী জেলা প্রতিষ্ঠিত হলে রাজবাড়ী সদর থানা উপজেলায় উন্নীত হয়। এর ১৪টি ইউনিয়ন হলো- মিজানপুর, পাঁচুরিয়া, বরাট, খানখানাপুর, দাদশী, আলীপুর, শহীদ ওহাবপুর, বসন্তপুর, সুলতানপুর, মূলঘর, বাণীবহ, রামকান্তপুর, খানগঞ্জ ও চন্দনী ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- রাজবাড়ী রেলওয়ে মাঠে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেন। সেদিন তাঁর দেয়া ভাষণ শুনে এ এলাকার মানুষ ভীষণভাবে উজ্জীবিত হয় এবং আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের আস্থা আরো বেড়ে যায়। এর ফলে রাজবাড়ী এলাকায় এ বি এম নুরুল ইসলাম এবং কাজী হেদায়েত হোসেন বিপুল ভোটে যথাক্রমে এমএনএ ও এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠনের একচ্ছত্র অধিকার পায়। কিন্তু এই বিপুল বিজয় সত্ত্বেও বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা না দেয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা নানারকম চক্রান্ত শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও হঠাৎ তা স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে বাঙালিরা ফুঁসে ওঠে; বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে। ৭১-এর সেই উত্তাল সময়ে রাজবাড়ী শহর বিদ্রোহী জনতার এক বিক্ষুব্ধ নগরীতে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো অবিরাম প্রতিবাদ মিছিল, ধর্মঘট, বিক্ষোভ, হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সারাদেশের মুক্তিপাগল মানুষের মতো
রাজবাড়ীর আপামর জনসাধারণও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উড়িয়ে দেয়। অফিস-আদালত, হাট-বাজার সব বন্ধ হয়ে যায়। রাজবাড়ী শহরের প্রাণকেন্দ্রে মুজিব বিল্ডিং (বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শহীদ মুজিবর প্রামাণিকের ছাদে বাড়ি)-এর ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে উত্তোলিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ বৈঠক করে ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। কাজী হেদায়েত হোসেন এমপিএ, অমল চক্রবর্তী, কমরেড আশু ভরদ্বাজ প্রমুখ নেতা মুক্তিযুদ্ধের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ এবং পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের এডভোকেট আ. ওয়াজেদ চৌধুরী, ডা. এস এ মালেক, বাদশা চৌধুরী, ন্যাপের কমরেড কমলকৃষ্ণ গুহ, এম এ মোমেন (বাচ্চু মাস্টার) ছাড়াও ডা. আসজাদ, প্রফেসর ওয়াহাব প্রমুখ সাংগঠনিক প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ছাত্রনেতাদের মধ্যে মকছুদ আহমেদ রাজা, নাজিবুর রহমান, আব্দুল লতিফ বিশ্বাস প্রমুখ নেতাও প্রশিক্ষণ শিবিরে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। রাজবাড়ী রেলওয়ে মাঠ, গোয়ালন্দ হাইস্কুল (বর্তমান রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) মাঠ, বেড়াডাঙা পানির ট্যাঙ্ক মাঠ, বেড়াডাঙা পীরতলা মাঠ, রাজবাড়ী স্টেডিয়াম মাঠ এবং রাজবাড়ী কোকোনাট ফার্মে (বর্তমান হর্টিকালচার সেন্টার) প্রশিক্ষণ চলে। ইপিআর থেকে পালিয়ে আসা কাজীকান্দা মণ্ডলপাড়ার আব্দুল বারী মণ্ডল এবং অন্য সেনাসদস্যরা প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। মহকুমা প্রশাসক শাহ্ মোহাম্মদ ফরিদ এবং পুলিশের কর্মকর্তার কাছ থেকে ডামি রাইফেল নিয়ে রাজবাড়ী শহরের কয়েকটি স্থানে শুরু হয় গেরিলা প্রশিক্ষণ।
রাজবাড়ী সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন কাজী হেদায়েত হোসেন এমপিএ, কমরেড আশু ভরদ্বাজ, ডা. জলিলুর রহমান, অমল চক্রবর্তী, ডা. ইয়াহিয়া, আক্কাছ আলী মিয়া, এম এ মোমেন (বাচ্চু মাস্টার) এবং কমলকৃষ্ণ গুহ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে যাঁরা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের প্রত্যেকের অধীনে ভিন্ন-ভিন্ন মুক্তিবাহিনী ছিল। বাহিনীগুলো কমান্ডারদের নামে পরিচিত ছিল, যেমন- আলম বাহিনী, লালীর বাহিনী, ইলিয়াছ বাহিনী, বাকাউল বাহিনী, সিরাজ বাহিনী – এবং ইসলাম বাহিনী। এসব বাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার পর মুক্তিকামী বাঙালিরা সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকসেনারা ২৫শে মার্চ রাতেই রাজবাড়ীর পার্শ্ববর্তী কুষ্টিয়া শহর দখল করে নেয়। অবশ্য এর আগেই রাজবাড়ীর (তৎকালীন গোয়ালন্দ) এসডিও শাহ্ মো. ফরিদ, মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম, নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং মাগুরার এসডিও ওয়ালিউল ইসলাম ২১, ২২ ও ২৩শে মার্চ ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদের বাসায় গোপন মিটিং করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কুষ্টিয়া শহর শত্রুমুক্ত করতে সহযোগিতা চাওয়া হলে বিপুল সংখ্যক আনসার সদস্য এবং সাধারণ যোদ্ধা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজবাড়ী রেলস্টেশন থেকে একটি বিশেষ ট্রেনে করে চুয়াডাঙ্গা ৯নং উইং-এর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ১লা এপ্রিল হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এ-যুদ্ধে রাজবাড়ীর আনসার সদস্য হাসমত আলী ও কালুখালি উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের কুদ্দুসসহ ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
পাকবাহিনী ৬ই এপ্রিল একটি বিরাট কনভয় নিয়ে পদ্মাপাড়ের আরিচাঘাটে অবস্থান নেয় এবং নদী পাড় হয়ে বিপরীতপাড়ে গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটে পৌছানোর চেষ্টা করে। তখন দক্ষিণবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত এ ঘাটটি ছিল রাজবাড়ী সদর উপজেলায় পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাই রাজবাড়ীর যোদ্ধারা কুষ্টিয়ার যুদ্ধে জয়লাভের পর দ্বিগুণ উৎসাহে গোয়ালন্দঘাটে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। হাজার-হাজার ছাত্র-জনতা, আনসার সদস্য এবং ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সদস্যরাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত তাঁরা পাকবাহিনীকে এখানে প্রতিরোধ করে রাখেন।
পাকবাহিনী ৮ই এপ্রিল রাজবাড়ী সদর উপজেলায় বিমান হামলা চালিয়ে ফিরে যায়। এতে ঘোষপট্টির ৮ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়, যা ঘোষপট্টি গণহত্যা নামে পরিচিত। এরপর ২১শে এপ্রিল তারা আকাশ, নৌ ও স্থলপথে একযোগে আক্রমণ চালায়। এ-সময় তারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তাদের প্রতিরোধ করার জন্য বাহাদুরপুর থেকে মমিনখাঁর হাট পর্যন্ত ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধারা যেসব বাংকার তৈরি করেছিলেন, সেগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। পাকবাহিনীর গোলাগুলিতে সেদিন আনসার কমান্ডার ফকির মহিউদ্দীন ও পল্লিকবি তোফাজ্জেল হোসেনসহ শতাধিক মানুষ নিহত হয়। এভাবে পাকবাহিনী গোয়ালন্দের সকল প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে ট্যাঙ্কবহর নিয়ে ফরিদপুরের দিকে চলে যায় এবং একটি গ্রুপ রাজবাড়ী সদরে প্রবেশ করে। রাজবাড়ী সদরে তারা দাতব্য চিকিৎসালয় (বর্তমান সিভিল সার্জন ও এসপি-র বাসভবন)-এ প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে পাঁচুরিয়ার বাগচী বাবুদের বাড়ি দখল করে সেখানেও একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখানকার ‘আরব সাহেব’ নামে এক পীর এবং খানখানাপুর শান্তি কমিটির সদস্যরা এ ক্যাম্প স্থাপনে পাকসেনাদের সাহায্য করে। এ ক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করে পীরের তিন ছেলে সৈয়দ ইসমাইল, সৈয়দ মো. সাঈদ ও সৈয়দ মো. ইসহাক বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করত। তবে মাস খানেক পরে মুক্তিযোদ্ধারা এসে ক্যাম্পটিতে আগুন ধরিয়ে দেন।
রাজবাড়ী সদর উপজেলায় কনভেনশন মুসলিম লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগ (সবুর খান), জামায়াতে ইসলামী এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। পিডিপি নেতা ইউসুফ হোসেন চৌধুরী (মোহন মিয়া)- র পরামর্শ অনুযায়ী রাজবাড়ীর সর্বত্র শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর- ও আলশামস বাহিনী গঠন করা হয়। এ ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে -এনএসএফ ও ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা-কর্মীরা এবং অবাঙালি বিহারি ও রিফিউজি কলোনির লোকজন। এনএসএফ নেতা ভাজনচালার জাহাঙ্গীর (এডভোকেট রহমত আলীর ভাইপো) এবং মন্টু (ইয়াছিন হাইস্কুলের শিক্ষক এস এ মীরের ভাগ্নে) অবাঙালি বিহারি ও শান্তি কমিটির লোকজনদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড চালায়। বরাটের শামসুল আল বরাটি ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের ফরিদপুর জেলা শাখার নেতা।
রাজবাড়ী সদরে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও অন্যান্য জল্লাদ বাহিনীর সঙ্গে যুক্তরা হলো- ডা. আব্দুর রহমান (রায়নগর, জামায়াতে ইসলামী), এডভোকেট মাজেদ আলী খান (সজ্জনকান্দা, কাউন্সিল মুসলিম লীগ), মো. ওবায়দুল্লাহ মিয়া (নীমতলা, শান্তি কমিটির সেক্রেটারি), সৈয়দ খামার (কলেজপাড়া; অবাঙালিদের নেতা), ইয়াছিন আলী কন্ট্রাক্টর (ভবানীপুর পৌর কমিশনার, মুসলিম লীগ), খন্দকার মাজেদ আলী (ভবানীপুর পৌর কমিশনার), গোলজার হোসেন (রেল কলোনি, রাজবাড়ী বরফকলের মালিক), মো. আ. খালেক মোল্লা (শ্রীপুর), এডভোকেট রহমত আলী (ভাজনচালা), আলাউদ্দিন (ভাজনচালা; অবাঙালি), আব্দুল মজিদ মাস্টার (শান্তি কমিটি), নিয়ামত আলী (পৌর কমিশনার), মজনু খলিফা (কলেজপাড়া, বিনোদপুর) প্রমুখ।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ফরিদপুর সদর ও মধুখালী উপজেলার সীমানাঘেঁষা সুলতানপুর পর্যন্ত শান্তি কমিটির শক্ত অবস্থান ছিল। এখানে শান্তি কমিটির সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল, তারা হলো- ওয়াহাব আলী বিশ্বাস (রাজাপুর, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), বাহার উদ্দিন মিয়া মাস্টার (ধর্মশী, শান্তি কমিটির সেক্রেটারি), হাবিবুর রহমান (ধর্মশী), আনছার উদ্দিন মোল্লা (সুলতানপুর), আ. লতিফ চৌধুরী (জালদিয়া, বালিচর), জয়নাল মিয়া (সুলতানপুর), ডা. দ্বীন মোহাম্মদ (শাইলকাঠি), হাজী আব্দুল গনি মোল্লা (শ্যামনগর), মোসলেম বিশ্বাস (রামনগর) ও আব্দুস সামাদ মোল্লা (বানিয়ারি)।
সাধারণত ইউপি চেয়ারম্যানদের বাধ্যতামূলকভাবে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান করা হতো। কিন্তু সুলতানপুরে এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল। তখন সুলতানপুরের ইউপি চেয়ারম্যান ছিল মোসলেম আলী মণ্ডল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রতি একান্ত আনুগত্যের কারণে ওয়াহাব আলী বিশ্বাসকে সুলতানপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়, আর সেক্রেটারি করা হয় তারই আপন শ্যালক ধর্মশী গ্রামের বাহার উদ্দিন মিয়াকে। পার্শ্ববর্তী মাচ্চর ইউনিয়নের খলিলপুরের রাজাকার খালেক মোল্লা, আমানুল্লা (মাচ্চর, খলিলপুর) ও শুকুর বিহারি (খলিলপুর) এদের সহায়তায় লুটপাট ও রাহাজানি করে আসছিল। অক্টোবর মাসে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় ফিরে এসে এসব রাজাকারকে ধরে ফেলেন। খালেক মোল্লা, আমানুল্লা, ডা. আ. হাকিম শেখ (খলিলপুর, মাচ্চর), বদর উদ্দিন (খলিলপুর), আনছার উদ্দিন খলিফাসহ সব রাজাকারকে রামনগর ক্যাম্পে নিয়ে একসঙ্গে সাতজনকে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর রাজাকার জলিল মৌলভী (মাচ্চর)-র বিরুদ্ধে দালাল আইনে মামলা হয়েছিল। বেশকিছুদিন জেল খেটে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর সে ছাড়া পায়।
খানখানাপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল মুসলিম লীগ নেতা ও তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান মো. মকবুল মোল্লা এবং সেক্রেটারি ছিল অবাঙালি বিহারি সিদ্দিক (কসাই ও ধুনকার)। এ কমিটির সঙ্গে যুক্ত অন্যরা হলো- মতিউর রহমান (ইউপি মেম্বার, পরবর্তীকালে চেয়ারম্যান), উমেদ আলী মাস্টার (ইউপি মেম্বার), ইব্রাহিম সরদার (গাড়োয়ান) প্রমুখ। শান্তি কমিটির নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে কিছুদিনের মধ্যে এখানে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনীর সদস্য ছিল- বসির, টিক্কা খান, সাহেবজান বিহারি, শুকুর উল্লাহ, হানিফ, রমজান, হোসেন আলী বিহারি, আদু কসাই, সাত্তার, আমানুল্লাহ, শাজাহান, ছামাদ, করিম, রতন, আব্দুল হাই প্রমুখ। আলীপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে এখানকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় কাজী লুৎফর রহমানকে। এখানকার শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে আলাদিপুর-কোমরপাড়া রিফিউজি কলোনির বাঙালি রিফিউজিরাও যুক্ত হয়েছিল। তাদের মধ্যে চুন্নু মেম্বার, আমীর হোসেন (রিফিউজি), জল্লাদ সোবহান (আলাদিপুর), নুরু বিশ্বাস (শ্রীপুর), আনজু বাঙালি, আমীন সরদার ও নুর ইসলাম ছিল পাকবাহিনী ও রাজবাড়ীর জল্লাদ বাহিনীর প্রধান অবাঙালি সৈয়দ খামারের সহকারী।
আটদাপুনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী খাঁ স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল। সে সহ কাসেম দফাদার, মোহাম্মদ আলী, মো. আ. রহমান (যুদ্ধের পর নবগঠিত বাণীবহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান), মোহাম্মদ আলী (যুদ্ধের পর নবগঠিত মূলঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পরে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান), আব্দুর রশীদ সৈয়দ গনি (রামকান্তপুর), রিয়াজ বিহারি (বেথুলিয়া), ছামাদ খন্দকার (বেথুলিয়া), হারাইন্যা (বেথুলিয়া), আজাহার (মহিষবাতান), রশীদ (মহিষবাতান), ঈমান আলী (পিতা তমিজউদ্দিন, মাটিপাড়া) প্রমুখ এলাকার বহু মানুষকে হত্যা করেছে এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে। ইয়াকুব খাঁ, মোহাম্মদ আলী এবং আ. রহমান এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে প্রাণে বেঁচে যায়।
রাজবাড়ী সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো- ডা. আব্দুর রহমান (রায়নগর, জামায়াতে ইসলামী), এডভোকেট মাজেদ আলী খান (বড় মসজিদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ), মো. ওবায়দুল্লাহ মিয়া (নীমতলা, শান্তি কমিটির সেক্রেটারি), সৈয়দ খামার (কলেজপাড়া), ইয়াছিন আলী কন্ট্রাক্টর (ভবানীপুর, মুসলিম লীগ), খন্দকার মাজেদ আলী (ভবানীপুর), গোলজার হোসেন (রাজবাড়ী বরফকলের মালিক), ডা. আজহার উদ্দিন (বড় মসজিদ), মো. আ. খালেক মোল্লা (শ্রীপুর), এডভোকেট রহমত আলী (ভাজনচালা), ওয়াহাব আলী বিশ্বাস (রাজাপুর), আলাউদ্দিন (ভাজনচালা, অবাঙালি)।
২১শে এপ্রিল পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ গোয়ালন্দ ঘাট থেকে বসন্তপুর পর্যন্ত অগ্নিসংযোগ ও গুলি ছুড়তে-ছুড়তে রাজবাড়ী সদর উপজেলা ও ফরিদপুর এলাকায় প্রবেশ করে। সাঁজোয়া বাহিনীর আরেকটি গ্রুপ দৌলতদিয়া-খুলনা মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গিয়ে প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক কেন্দ্র খানখানাপুরে প্রবেশ করে। সেখানে তারা গনি ডাক্তার ও পরেশ সাহা (ঘেটু খলিফা)-র বাড়িসহ ৪টি বাড়ি, ঐতিহ্যবাহী সুরাজমোহিনী ইনস্টিটিউশন এবং শিক্ষক তারাপদ কুণ্ডুর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া তারা খানখানাপুর বাজারের প্রায় ১৫০টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান লুট করে। ফিরে যাবার সময় তারা বাজারের পাটের বড় ব্যবসায়ী যুগল কুণ্ডু ও রাখাল কুণ্ডুকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পাকিবাহিনীর আরেকটি গ্রুপ সিএন্ডবি রাস্তার দুপাশ, সদর উপজেলার কল্যাণপুর, বারবাকপুর, আলীপুর, কোমরপুর, দর্পনারায়ণপুর ও শ্রীপুরে বাড়িঘর পুড়িয়ে রাজবাড়ী শহরে প্রবেশ করে।
পাকবাহিনী রাজবাড়ীতে প্রবেশ করে অবাঙালি বিহারি এবং মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। এর ফলে বিহারি ও রিফিউজি কলোনির ৮-১০ বছরের শিশুরা পর্যন্ত হাতে বন্দুক ও তলোয়ার নিয়ে এলাকার নিরীহ মানুষদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। স্বাধীনতাবিরোধীদের এই অত্যাচারের ফলে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ে। তখন হানাদাররা মুসলিম এলাকায়ও অত্যাচার শুরু করে। এর সঙ্গে রাজবাড়ীর বিভিন্ন এলাকার লোকজন জড়িত ছিল। তাদের কয়েকজন হলো- মোহাম্মদ আলী (মূলঘর), মো. ইয়াকুব খান (আটদাপুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান), হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী (জামায়াতে ইসলামী), আ. ছাত্তার পাটোয়ারী (পরবর্তীকালে পাঁচুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান), মো. আ. রহমান (বাণীবহ), মজিদ হোসেন (বাড়াইজুড়ি), মো. লালন (জুকাই), ছোমউদ্দিন (বাড়াইজুড়ি, খোশবাড়ি), হারুনুর রশীদ (খানগঞ্জ), ওয়াহাব আলী বিশ্বাস (রাজাপুর) প্রমুখ। পাকসেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিহারিদের প্রধান কমান্ডার সৈয়দ খামার প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে। তার নেতৃত্বে স্থানীয় বিহারিরা সেগুলো ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে। তারা গ্রামাঞ্চলের নিরীহ, নিরস্ত্র ও নিরপরাধ জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায়। তাদের নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ঐসব এলাকার লোকজন দলে-দলে ভারতে চলে যায়। রাজবাড়ী সদরের বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়।
পাকবাহিনী এলাকায় প্রবেশ করার পর কুখ্যাত বছির কসাই, টিক্কা খান, সাহেবজান, শুকুর উল্লাহ, হানিফ, রমজান, হোসেন বিহারিসহ আরো অনেকে খানখানাপুরের নিরীহ বাঙালিদেরর ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন শুরু করে। তারা বাঙালিদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয়। রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দের মধ্যবর্তী প্রসিদ্ধ পাট ব্যবসাকেন্দ্র খানখানাপুরস্থ ডি কে সাহার প্রসাদোপম দ্বিতল ভবনটি (বর্তমানে স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির অফিস) দখল করে এবং তাঁর বড় ছেলে ব্যবসায়ী নিলু বাবুসহ আরো তিনজনকে হত্যা করে। বিহারি হানিফ, বছিরসহ অন্যরা ঐ বাড়িতে আড্ডাখানা বসায়। তারা সেখানে মদ ও বাইজি নিয়ে রাতভর আসর জমায়। এলাকার যুবতী নারীদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন চালায়।
হানাদাররা খানখানাপুরের পার্শ্ববর্তী পাঁচুরিয়ার খোলাবাড়িয়া গ্রামের জমিদারবাড়ি, কুণ্ডুপাড়া, সাহাপাড়া, দত্তপাড়া, দক্ষিণপাড়া, বণিকপাড়া ও ভান্ডারিয়া এলাকার প্রায় সকল হিন্দুবাড়ি লুট করে। একদিন ১৪ জন হিন্দু জেলে মাছের ডালি নিয়ে রাজবাড়ী অভিমুখে যাচ্ছিল। তখন আনজু, সোবহান, আমির হোসেন প্রমুখ রাজাকার আলাদিপুর বাজারের পাশ থেকে তাদের ডেকে নিয়ে আলাদিপুর স্কুলমাঠে ছ্যান, রামদা ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে একই গর্তে পুঁতে রাখে। এ ঘটনা – আলাদিপুর স্কুলমাঠ গণহত্যা নামে পরিচিত। এ নৃশংসতার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা আনজুকে হত্যা করেন। জল্লাদ সোবহান পলাতক অবস্থায় স্বাধীনতার পর চুয়াডাঙ্গায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেল খাটে। দেশ স্বাধীনের পর বিশু মিয়া, ফরিদ হোসেন মেম্বার ও আরেকজন রাজাকারকে এলকাবাসী মেরে ফেলে।
শ্রীপুর গ্রামের হোমিও ডাক্তার নওয়াব আলীর পুত্র নুরু কন্ট্রাক্টর (জামায়াতে ইসলামীর নেতা ইবাদত আলীর পিতা)- এর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী আলীপুর ইউনিয়নের ইন্দ্রনারায়ণপুর গ্রামের হরেন্দ্রনাথ ঘোষের ১৯টি টিনের ঘরসহ সমগ্র বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। হরেন্দ্রনাথের পুত্র ফণীভূষণ ঘোষ, অরুণ কুমার ঘোষ এবং অতুল কুমার ঘোষ নুরু কন্ট্রাক্টরসহ ৭ জনকে আসামি করে ১৯৭২ সালে দালাল আইনে একটি মামলা করেন। মামালার বিচারে নুরু কন্ট্রাক্টরের ৩ বছর এবং বাকিদের ৭ বছর করে কারাদণ্ডের আদেশ হয়। নুরু ৩ বছর কারাদণ্ড ভোগ করার পর জেল থেকে বেরিয়ে আসে।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর ইশ্বরদী ও সৈয়দপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্রচালনায় পারদর্শী প্রায় দশ হাজার অবাঙালি বিহারিকে রাজবাড়ীতে আনা হয়। রেলওয়ে লোকোসেড ওল্ডকলোনি এবং বিনোদপুর নিউকলোনিতে তারা আশ্রয় নেয়। স্থানীয় বিহারি রাজাকাররা তাদের কাছ থেকে অস্ত্রপ্রশিক্ষণ নেয়। এরপর থেকে তারা সৈয়দ খামারের নেতৃত্বে এখান থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত।
শান্তি কমিটির লোকজন রাজবাড়ী রেলস্টেশনের উত্তরে বিহারিদের নেতা আকুয়ার দোতলা ভবনে অফিস স্থাপন করে। সেখানে ছিল একটি টর্চার সেল। শান্তি কমিটি এখানে বসে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা চালাত এবং বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতন করত। খানখানাপুরস্থ ডি কে সাহার বাড়িটি শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার এবং বিহারিরা তাদের বিনোদন কেন্দ্র ও টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করত।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো হলো- বিনোদপুর নিউকলোনি বধ্যভূমি, লোকোসেড ওল্ডকলোনি বধ্যভূমি, ভাজনচালা দাসবাড়ি বধ্যভূমি, ভাজনচালা মোড় বধ্যভূমি, স্টেশন কলোনি বধ্যভূমি ও গণকবর এবং আলাদিপুর হাইস্কুল বধ্যভূমি। পাকবাহিনী রাজবাড়ী সদর উপজেলায় প্রবেশের পর থেকে উপজেলা মুক্ত হওয়া পর্যন্ত তাদের এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন। ৩০শে এপ্রিল পাকবাহিনীর দোসররা লক্ষ্মীকোল রাজার বাড়িতে আক্রমণ করে রাজা সূর্যকুমারের পৌত্র হারুসহ কয়েকজনকে হত্যা করে এবং বাড়িঘর লুট করে। পরের দিন ১লা মে পাকবাহিনী অবাঙালি বিহারিদের নিয়ে একটি জিপে করে লোকোসেড রেলব্রিজ সংলগ্ন নুরপুরের রাস্তার মুখে রাজবাড়ি কলেজের বিজ্ঞান গবেষণাগারের পিয়ন জোনাব আলীকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর তারা লক্ষ্মীকোল-লোকোসেড এলাকা থেকে ৮ জন যুবককে আটক করে। তাদের মধ্যে ছিল ফুটবলার মঞ্জুর মোর্শেদ বাদশা (বিনোদপুর, লেকপাড়া), শাম (পিতা ইব্রাহীম মওলানা, লক্ষ্মীকোল; মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াসের ভাই), জালাল (রেলের ড্রাইভার গোলাম মওলা ওরফে গোলোর বড়ভাই), আরমান (ফুটবলার শাজাহানের ভগ্নীপতি), ইয়াদুর রহমান (পৌরসভার স্টাফ শাহানার পিতা), তোতা (দক্ষিণ ভবানীপুর) এবং হক সাহেব নামে রেলের এক স্টাফ। এদের জিপে তুলে পাকবাহিনী ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হয়। পাকবাহিনীর গাড়িতে একজনমাত্র বন্দুকধারী সেনাসদস্য ছিল। রাজবাড়ী-ফরিদপুর সড়কের আলাদিপুর মোড়ে গিয়ে পাকসেনাটি মঞ্জুর মোর্শেদ বাদশাকে জিপ থেকে নামিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করার জন্য রাইফেল তাক করে। এসময় বাদশা সহবন্দিদের গাড়ি থেকে পালানোর ইঙ্গিত করে পাকসেনাটির বুকে লাথি মেরে দৌড় দেয়। পাকসেনাটি তার থি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে গুলি ছোড়ে, যা বাদশার পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে চলে যায়। আলাদিপুর গ্রামের বাসিন্দারা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রাজবাড়ী হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় এবং সে প্রাণে বেঁচে যায়। ওদিকে তার সহবন্দি শাম ও তোতা জিপ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও অন্যরা পারেনি। আরমান, জালাল, ইয়াদুর রহমান ও আব্দুল হককে পাকসেনারা ফরিদপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন আটক থাকার পর আব্দুল হক ফিরে এলেও বাকিদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
উপর্যুক্ত ঘটনার পর ডিসেম্বর মাসে অত্র এলাকা মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা বহু অপারেশনও পরিচালনা করেন। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী রাজবাড়ী দখল করার তিন সপ্তাহের মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সৈনিক জালাল আহমেদ (জাবরকোল) ও জালাল উদ্দিন ঘিনে (আড়কান্দি) বাঘুটিয়া গ্রামের দক্ষিণারঞ্জন দাসের বাড়িতে একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন। এরপর তাঁরা ১৭ই মে বাণীবহে অপারেশন চালিয়ে এখানকার ত্রাস আজহার রাজাকার ও আব্দুল গফুর (পাকালিয়া) রাজাকারকে আটক করে বাঘুটিয়া ক্যাম্পে বন্দি করে রাখেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা খলিলপুর রাজাকার ক্যাম্পে একটি অপারেশন পরিচালনা করেন। কুমার নদীর পাড়ে অবস্থিত বাণিজ্যকেন্দ্র খলিলপুরের এ ক্যাম্পটি পাকসেনাদের ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এর অপর পাড়ে সুলতানপুরে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে গ্রুপ কমান্ডার মোকারম হোসেন ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এ ক্যাম্পটি গড়ে তোলেন। রাজাকারদের ক্যাম্পটি এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাই মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পটি গুঁড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। ঘটনার দিন কমান্ডার মোকারমের নেতৃত্বে তাঁরা দুভাগে ভাগ হয়ে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে এগিয়ে যান। রাজাকাররাও ক্যাম্পের ভেতর থেকে পাল্টা গুলি চালায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের সামনে তারা ১৫ মিনিটের বেশি টিকতে পারেনি। অতঃপর তাদের কয়েকজন আত্মসমর্পণ করে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ক্যাম্প থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেন। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন মাসুদুল হক, সৈয়দ হাফিজুল হক, হায়দার আলী, সৈয়দ শামসুল হক (ফারুক), জুলমত খান, আব্দুল করিম মোল্লা, খলিলুর রহমান, সৈয়দ শহীদুল ইসলাম, পরেশ চন্দ্র দাস, সুবল চন্দ্ৰ ভৌমিক, খান মাহবুব এ খোদা প্রমুখ।
মুক্তিযোদ্ধারা ১৯শে আগস্ট ও ৫ই অক্টোবর দুবার রাজাকার ওবায়দুল্লাহ মিয়ার বাড়িতে অপারেশন চালান। বসন্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পকে টার্গেট করে মুক্তিযোদ্ধারা ১৯শে আগস্ট রাতে হাতবোমা নিক্ষেপ করলে ৩ জন রাজাকার হতাহত হয়। কিন্তু রাজাকাররা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে। এরপর রাজাকাররা তাঁদের শহীদ ওহাবপুর ইউনিয়নের (নীমতলা) চেয়ারম্যান ও গোয়ালন্দ মহকুমা শান্তি কমিটির অন্যতম প্রধান মো. ওবায়দুল্লাহ মিয়ার বাড়িতে নিয়ে আটকে রাখে। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল তৎক্ষণাৎ ওবায়দুল্লাহ মিয়ার বাড়িতে হামলা চালিয়ে আটক মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধার করে। পরবর্তীতে ওবায়দুল্লাহ মিয়ার বাড়িতে রাজাকারদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ক্যাম্পের রাজাকাররা প্রায়ই আশপাশের বাড়িঘরে অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। তাদের এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা ৫ই অক্টোবর গভীর রাতে ক্যাম্পে অপারেশন চালান। তাঁরা আকস্মিকভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। রাজাকাররাও পাল্টা গুলি চালায়। দীর্ঘক্ষণ গুলিবিনিময় চলে। এ অপারেশনের পর ক্যাম্পটি উঠে যায়
মুক্তিযোদ্ধারা ১১ই সেপ্টেম্বর পাঁচুরিয়া রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন পরিচালনা করেন। এ ক্যাম্পটি ছিল পাঁচুরিয়া রেল স্টেশনের কাছে পীর আরব সাহেবের বাড়িতে। তার ছেলে ইসহাক ও সাঈদের নেতৃত্বে একদল বিহারি রাজাকার প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পটি স্থাপন করে। ক্যাম্পের ৯ জন রাজাকার মুকুন্দিয়া রেলব্রিজে পাহারা দিত। তাছাড়া রাজাকাররা এ ক্যাম্প থেকে গিয়ে নিরীহ বাঙালিদের ধন- সম্পদ লুট করত এবং বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাত। তাদের এরূপ একটি পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে গোয়ালন্দ ঘাটের একদল মুক্তিযোদ্ধা কাটাখালি (বর্তমান বেড়িবাঁধ) হয়ে রাজবাড়ীর দিকে আসার পথে ১০ সদস্যের আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঘটনার দিন রাত দেড়টার দিকে ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। তাঁদের হঠাৎ আক্রমণে ৫ জন রাজাকার ধরা পড়ে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। তাদের ফেলে যাওয়া একটি স্টেনগান ও ৮টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ অপারেশনে একজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হন। বন্দি রাজাকার ইসহাক ও সাঈদ পরবর্তীতে আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ভূমিকা না নেয়ার অঙ্গীকার করে মাফ চাইলে সাধারণ মানুষের থু-থু ও লাথি খেয়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। তবে বিহারি রাজাকারদের হত্যা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের এ ক্যাম্পটি এবং পার্শ্ববর্তী পাঁচুরিয়া রেল স্টেশনের ক্যাম্পটিও পুড়িয়ে দেন। পাংশার শাওরাইলের মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মাদ আলীর নেতৃত্বে পরিচালিত এ অপারশেনের ফলে পাঁচুরিয়া ও আশপাশ এলাকার সাধারণ মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের কোনো একদিন বাণীবহ বাজারে একটি অপারেশন পরিচালিত হয়। এদিন স্থানীয় রাজাকার ও আলবদররা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালিদের ঘরবাড়ি ও দোকান-পাটে অগ্নিসংযোগ করছিল। বাণীবহ গ্রামের পাশের বিল এলাকায় তখন অবস্থান করছিলেন ইপিআর থেকে পালিয়ে আসা বালিয়াকান্দি এলাকার মো. জালালউদ্দিন ঘিনে। তিনি এখানে একটি প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তিনি দূর থেকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পেয়ে তাঁর বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং অতর্কিতে হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ঘ্যানা রাজাকারের বাহিনীর কুখ্যাত সৈয়দ রিফুজি, মস্তান বিহারি, হালিম বিহারি ও সলেমান রিফুজিকে ধরে নিয়ে তৎক্ষণাৎ গুলি করে হত্যা করেন। তাঁর এ অপারেশনের ফলে বাণীবহ ও আশপাশ এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসে। অক্টোবর মাসের ৫ তারিখ মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার একাই মাতব্বরকে হত্যা করেন। বাণীবহ ইউনিয়নের নিজপাড়া গ্রামের কুখ্যাত এই রাজাকার এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বাণীবহের আশপাশের গ্রামগুলোতেও সে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। স্থানীয় বাঙালিরা সবসময় তার ভয়ে ভীত থাকত। মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় প্রবেশের পর গ্রামবাসীরা জোটবদ্ধ হয়। তাকে শায়েস্তা করতে গ্রামের সাধারণ মানুষ ৫ই অক্টোবর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গিয়ে তার বাড়িতে অপারেশন চালায়। সুচতুর একাই মাতব্বর আগেই পালিয়ে যায়। ফলে বিক্ষুব্ধ জনতা তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনার দুদিন পর ৭ই অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা এ গ্রামে অপারেশন চালিয়ে দুজন রাজাকারদালালকে হত্যা করেন। এর বেশ কিছুদিন পর পুনর্বার অপারেশন চালিয়ে একাই মাতব্বরকে হত্যা করা হয়।
৮ই অক্টোবর শুক্রবার একজন পাকসেনা রাজবাড়ী বাজারে প্রবেশ করে একটি কাপড়ের দোকান থেকে টাকা না দিয়ে জোর করে কিছু কাপড়-চোপড় নেয়ার চেষ্টা চালায়। ঐ সময় রাজবাড়ী শহরের আশপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থাকলেও বাজার এলাকায় তখনো তাঁদের আগমন ঘটেনি। তাই আশপাশের দোকানদাররা একজোট হয়ে এগিয়ে এসে ঐ পাকসেনাকে পাকড়াও করে এবং গণধোলাই দিয়ে ছেড়ে দেয়। সে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষের মার খেয়ে পাকসেনা পালানোর এ ঘটনাটি ‘অপারেশন দুরমুজ পার্টি’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
পশ্চিম মূলঘর গ্রামের লুটেরা বাহিনীর অন্যতম করিম পাটোয়ারীর ছিল একজন দুর্ধর্ষ রাজাকার। পাকবাহিনীর সহায়তায় সে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তার বাড়ি থেকেই রাজাকার বাহিনী লুটতরাজ, হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের পরিকল্পনা করত। ৯ই অক্টোবর তার বাড়িতে রাজাকারদালালদের একটি বিশেষ সমাবেশ হয়। সেখানে লুটের মালামাল ভাগাভাগি নিয়ে আলাদিপুরের আরজু, সোবান, রব্যুল্লা ও শফির সঙ্গে বিহারি রাজাকরদের বিরোধ বাঁধে। এ সুযোগে সাধারণ মানুষ একজোট হয়ে করিম পাটোয়ারীর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়।
১০ই অক্টোবর গাজির গাড়া ব্রিজে একটি অপারেশন পরিচালিত হয়। এদিন রাজবাড়ি-বালিয়াকান্দি সড়কের এ ব্রিজে মুক্তিযোদ্ধারা পাহারারত এক কুখ্যাত রাজাকারকে গুলি করে হত্যা করে লাশ হড়াই নদীতে ফেলে দেন। পরের দিন ১১ই অক্টোবর তাঁরা লুটেরা সর্দার কোরবান আলীকে হত্যা করেন। মূলঘর ইউনিয়নের গোপালপুরের কুখ্যাত লুটেরা, দালাল ও রাজাকার এই কোরবান আলী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তাকে উচিত শিক্ষা দিতে এলাকাবাসী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ১১ই অক্টোবর তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন চালান এবং কোরবান আলীকে হত্যা করে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনেন।
শহীদ ওহাবপুর ইউনিয়নের সাদীপুর গ্রামের এক কুখ্যাত অবাঙালি বিহারি রাজাকার হাতে খোলা তলোয়ার নিয়ে সবসময় গ্রামবাসীদের ভয় দেখাত এবং বিভিন্ন সময়ে দল বেঁধে আশপাশের এলাকায় হত্যা ও লুটতরাজ করত। মূলঘরের ইলিয়াস কমান্ডারের গ্রুপ ২৩শে অক্টোবর অপারেশন চালিয়ে তাকে হত্যা করে।
অক্টোবর মাসে বারোখাদা ব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয়৷ রাজবাড়ী-ফরিদপুর সড়কের বসন্তপুর ও শিবরামপুরের মাঝে অবস্থিত এ ব্রিজে একদল রাজাকার নিয়মিত পাহারা দিত। এর ফলে এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছিল। তাই ঘটনার দিন মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজে পাহারারত রাজাকারদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান। এতে একজন রাজাকার নিহত, একজন গুরুতর আহত এবং চারজন নিখোঁজ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ৪টি রাইফেল হস্তগত করেন।
আলাদিপুর রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় ১লা নভেম্বর। রাজবাড়ী শহরের অদূরে আলাদিপুর তিন রাস্তার মোড়ে অবস্থিত এ ক্যাম্পে হানাদার বাহিনীর প্রধান দোসর অবাঙালি সৈয়দ খামার অবসর যাপন করত এবং রাজাকারদের নির্দেশনা দিত। ঘটনার দিন ভোররাতে কামান্ডার আব্দুল মালেক মিয়ার গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা পদ্মা নদীর আম্বারিয়া চর থেকে উড়াকান্দা, দাদশী ও বক্তারপুর হয়ে সিঙ্গাবিল পাড়ি দিয়ে কোমরপাড়া রাস্তায় ওঠেন এবং একযোগে ক্যাম্পটি ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালান। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গোলাগুলির পর রাজাকার আনজু ও তার দলের সদস্য আনোয়ার রিফিউজি এবং আলাদিপুরের সিদ্দিক রাজাকার ধরা পড়ে। আনজুকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং সিদ্দিক পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা ১নং রিফিউজি কলোনির খুনি ও লুটেরা আমির (হারান দত্ত ও নারান দত্তের থুনি)-কে হত্যা করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করায় আনোয়ারকে ছেড়ে দেন। এ অপারেশনে অংশ নেন আব্দুল মালেক মিয়া, আলিফ শেখ, আবুল হাসেম মিয়া, এস এম নওয়াব আলী, হাত্তার পাটোয়ারী, অনিল ঘোষ, ইউসুফ খান প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা। এর পরের দিন ২রা নভেম্বর রাত ৮টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা মূলঘর ইউনিয়নের কুখ্যাত দালাল রোকন শিকদারকে কুটিরহাট রাস্তার ওপর গুলি করে হত্যা করেন। সে ছিল ঐ এলাকার ত্রাস রাজাকার ও বিহারিদের দালাল।
বাণীবহ অপারেশন পরিচালিত হয় ৩রা নভেম্বর। এখানকার কুখ্যাত দালাল ও লুটেরা আবুল হোসেন আশপাশের গ্রামগুলোর সাধারণ মানুষদের বাড়িঘরে হামলা করে তাদের সহায়-সম্পদ লুট করত। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেয়। ঘটনার দিন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এসে পজিশনে থাকে। রাতে কুটিরহাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাঁরা আবুল হোসেনকে হত্যা করে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
আলাদিপুর বিহারিপাড়া অপারেশন পরিচালিত হয় ১১ই নভেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে। এসময় আলাদিপুর মোড়ে বিহারি রাজাকারদের একটি গোপন সভার প্রস্তুতি চলছিল। এমন সময় কমান্ডার ইলিয়াস মিয়ার বাহিনীর একটি শক্তিশালী গেরিলা ইউনিট অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। রাজাকাররাও পাল্টা গুলি চালায়। প্রায় দুঘণ্টাব্যাপী উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলিবিনিময় হয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে রাজাকার বাহিনী এক সময় বেশকিছু অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বিহারিদের ক্যান্টনমেন্ট বলে পরিচিত আলাদিপুর বিহারিপাড়ায় আগুন ধরিয়ে দেন।
১৬ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মুসলিম লীগ নেতা নিজাম মিয়ার গাড়িতে একটি অপারেশন পরিচালনা করেন। নিজাম মিয়া ১৯৭০ সালের নির্বাচনে রাজবাড়ী-গোয়ালন্দ আসনে জাতীয় পরিষদে মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিল। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর সে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করে শান্তি কমিটির গোয়ালন্দ মহকুমার প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। সে গোপনে নিজের গাড়িতে চড়ে ফরিদপুর আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে হানাদার বাহিনীর কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীকে পরিচালিত করে আসছিল। দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে পাকড়াও করার চেষ্টায় ছিলেন। ১৬ই নভেম্বর ফরিদপুর-রাজবাড়ী সড়কের কুটিরহাট মোড়ের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় কমান্ডার শহীদুন্নবী ওরফে আলম ভাইয়ের গ্রুপ তার গাড়িতে অপারেশন চালায়। কিন্তু অপারেশন সফল না হওয়ায় অল্পের জন্য সে প্রাণে বেঁচে যায়।
২১শে নভেম্বর আলাদিপুর ব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয়। ফরিদপুর জেলা সদর থেকে পাকসেনারা সাঁজোয়া বহর নিয়ে এ ব্রিজ পার হয়ে বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালাত। তাদের ঐ আক্রমণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধারা এ ব্রিজে অপারেশন চালান। এতে আব্দুল আজিজ খুশী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ ঘটনার জের ধরে ২২ ও ২৩শে নভেম্বর এ এলাকায় দুই পক্ষে অনেক সংঘর্ষ হয়। তাতে হানাদারদের হাতে একজন হিন্দু শিক্ষক শহীদ হন এবং বেশকিছু বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়। অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কয়েকজন বিহারি ও রাজাকার এবং তিনজন পাক মিলিশিয়া নিহত হয়।
পাঁচুরিয়া ব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় ২৩শে নভেম্বর। পাকবাহিনীর ফরিদপুর থেকে রাজবাড়ীতে প্রবেশের সব চেষ্টা একে-একে ব্যর্থ হয়। এরপর সাঁজোয়া ট্যাংকবহর নিয়ে তারা পাঁচুরিয়া হয়ে রাজবাড়ী আক্রমণের পরিকল্পনা করে। আগের দিন রাজবাড়ী-ফরিদপুর সিএন্ডবি সড়কের গোয়ালন্দ মোড়ে বিশাল আকারের খাদ সৃষ্টি করায় হানাদার বাহিনীর গাড়ি-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাই তারা ফরিদপুর থেকে পাঁচুরিয়া ঘুরে রাজবাড়ীতে আসার চেষ্টা চালায়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর নওজোয়ানরা পাঁচুরিয়া যাতায়াতের একমাত্র ব্রিজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে এ রাস্তাটিও বন্ধ করে দেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলীর বাহিনীর সদস্যরা এ অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
৯ই ডিসেম্বর শান্তি কমিটির প্রধান মকবুল হোসেন মোল্লা ও আব্দুল হাই বিহারিকে হত্যার ফলে খানখানাপুর এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু রাজবাড়ী থানা তখনো ছিল অবাঙালি বিহারি রাজাকার ও পাক মিলিশিয়াদের দখলে। ১৪ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে একযোগে আক্রমণ করলে তাদের অনেকে নিহত হয়। রাজবাড়ী থানা দখলের যুদ্ধ নামে পরিচিত এ-যুদ্ধে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে রাজবাড়ী সদর উপজেলার একজন হলেন শুকুর আলী, অন্যরা সদর উপজেলার বাইরের। তাঁরা হলেন- কালুখালি উপজেলার মৃগী গ্রামের দিয়ানত আলী এবং পাংশা উপজেলার আরশাদ আলী (হাবাসপুর), আজগর আলী (বাহাদুরপুর), সাদী (কশবামাজাইল), রফিকুল ইসলাম রফিক (কলিমোহর) ও শফিক (মাছপাড়া)। ১৮ই ডিসেম্বর বাকি রাজাকার ও মিলিশিয়ারা আত্মসমর্পণ করলে রাজবাড়ী হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তযোদ্ধা হলেন- অলিক কুমার গুপ্ত, বীর প্রতীক (পিতার নাম মনোরঞ্জন গুপ্ত, মহেন্দ্রপুর)। রাজবাড়ী সদর উপজেলার যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন- আব্দুল আজিজ খুশি (পিতা হারেজ উদ্দিন, কলেজপাড়া), ওহাব খান (পিতা আব্দুল রহমান, গোয়ালন্দ মোড়), সাদেকুর রহমান (পিতা হোসেন আলী, সুলতানপুর), হাকিম মুন্সী (পিতা আব্দুল কাদের মুন্সী, সুলতানপুর), শুকুর আলী (পিতা কুব্বাত আলী, ধুঞ্চি/মিজানপুর), হাসমত আলী (পিতা জালাল সরদার, কেষ্টপুর, দাদশী; আনসার সদস্য) এবং খলিলুর রহমান (পিতা সৈয়দ আলী, দাদশী; সেনাসদস্য)।
রাজবাড়ী সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে শ্রীপুর বাস টার্মিনালে একটি এবং লোকোসেড বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে অপর একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া রাজবাড়ী রেলগেট এলাকার নামকরণ করা হয়েছে ‘স্মৃতিচত্বর’ এবং এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। লক্ষ্মীকোল এলাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সাদী, রফিকুল ইসলাম রফিক ও শফিকের সমাধি সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ খুশির নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘খুশি সড়ক’। [আবু রেজা আশরাফুল মাসুদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড