মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী মহানগর
রাজশাহী মহানগর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে পদ্মানদীর তীরে অবস্থিত। বিভাগীয় শহর হলেও ১৯৭১ সালে এটি ছিল অপেক্ষাকৃত একটি ছোট শহর। এখানে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ছিল। এখানকার সেক্টর কমান্ডার, সেকেন্ড-ইন-কমান্ড, এডজুট্যান্ট, সুবেদার, মেজর সকলেই ছিল অবাঙালি। সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে তিন প্লাটুন ইপিআর সদস্য ছিল। তাদের মধ্যে বাঙালি-অবাঙালি উভয়ই ছিল। ইপিআর বাহিনী ছাড়া উপশহরে অবাঙালি কলোনি এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ছাউনি ছিল। সেখানে কর্মরত ছিল ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৫০০ সৈন্য এবং তাদের কমান্ডার ছিল অবাঙালি লে. কর্নেল শাফাকাত বেলুচ। রাজশাহী পুলিশ লাইনের অধিকাংশ পুলিশ সদস্য, এসপি এবং ডিআইজি ছিলেন বাঙালি। রাজশাহী শহর থেকে ১৮ কিমি দূরে সরদহতে ছিল পুলিশ একাডেমি ও সরদহ ক্যাডেট কলেজ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সংঘটিত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে রাজশাহী শহরবাসীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। রাজশাহী কলেজ (১৮৭৩) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫৩) বরাবরই সচেতন ছাত্র-শিক্ষকদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তাঁদের কারণেই রাজশাহীতে রাজনৈতিক সচেতনতার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রয়েছে এবং এর ফলে প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে রাজশাহীবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগ আইয়ুব খানের পতনকে তরান্বিত করে। ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে রাজশাহী সদর আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী যথাক্রমে এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও এডভোকেট আব্দুল হাদী বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। ১৯৭১ সালে এ এইচ এম কামারুজ্জামান এমএনএ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার-এর স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন।
১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষিত হলে এর প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ববঙ্গের ন্যায় রাজশাহী শহরেও প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাজশাহী কলেজের ছাত্ররা কলেজ চত্বরে প্রতিবাদ সভা করে এবং সভাশেষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। বিকেলে স্থানীয় ভুবনমোহন পার্কে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় বর্ণালী সিনেমা হলে উর্দু ছবি রোড টু সোয়াত-এর প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়া হয়। ২রা মার্চ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট এবং ৩রা মার্চ শহরে পূর্ণদিবস হরতাল পালিত হয়। ঐদিন বিক্ষুব্ধ মিছিলকারীদের ওপর সরকারি বাহিনী গুলিবর্ষণ করলে জাফর আলী (বস্ত্রব্যবসায়ী) ও বিশু (রিকশা শ্রমিক) নামে দুজন শহীদ ও ১৬ জন আহত হন। ৩রা মার্চ শহরে সান্ধ্য আইন জারি ও ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে একজন মিছিলকারী শহীদ হন। এভাবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্র- ছাত্রীবৃন্দ, সাধারণ শহরবাসী, রিকশা শ্রমিক, সাংবাদিক এবং সংস্কৃতি-কর্মীরা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন-এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। গোটা শহরে সভা- সমাবেশের আয়োজন, নাটক মঞ্চায়ন, গণসঙ্গীত পরিবেশন প্রভৃতি কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- পরের দিন সকালে বেতারে শোনার পরপরই মালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে মিয়াপাড়াস্থ সাধারণ গ্রন্থাগারে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামারুজ্জামান ১১ই মার্চ ভুবনমোহন পার্কে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। ১৪, ১৫ ও ১৬ই মার্চ রাজশাহীর সংস্কৃতিকর্মীরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় উন্মুক্ত মঞ্চে ও ট্রাকযোগে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় গণসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। ১৭ই মার্চ রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগ সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আবদুল কুদ্দুস ও সম্পাদক মফিজুর রহমান। ২০শে মার্চ রাজশাহী মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে শহরের অফিস-আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। রাজশাহী কলেজ মাঠে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়।
এডভোকেট আব্দুল হাদী এমপিএ প্যারেডে অভিবাদন গ্রহণ করেন। ২৫শে মার্চ ভুবনমোহন পার্কে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রক্ত কথা বলে নামক একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। অনুষ্ঠানটি মধ্যরাত পর্যন্ত চলে। এ-সময়েই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাজশাহী শহরেও হত্যা অভিযান শুরু করে। অপরদিকে শুরু হয় শহরবাসীর প্রতিরোধযুদ্ধ। এরপর রাজশাহী শহরের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার শেখপাড়া, কাজিপাড়া, বিহারের চাকুলিয়া, শিলিগুড়ির পানিহাটা, কাতলামারি, লালগোলা, মালদার গৌড়বাগান প্রভৃতি ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
রাজশাহী শহরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন- আওয়ামী লীগের এ এইচ এম কামারুজ্জামান এমএনএ, এডভোকেট নাজমুল হক সরকার এমএনএ, এডভোকেট আব্দুল হাদী এমপিএ, মোহাম্মদ মহসীন, ন্যাপ (মোজাফফর)-এর বীরেন্দ্রনাথ সরকার, আতাউর রহমান, সৈয়দ আমীর হোসেন স্পেন, মোশাররফ হোসেন, ন্যাপ (ভাসানী)-র মজিবর রহমান চৌধুরী, এমরান আলী সরকার, বাবর আলী প্রমুখ। এঁরা তালাইমারীস্থ জেবের মিঞার কাঠের মিলে গোপন বৈঠক করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী অঞ্চলকে ৭ নং সেক্টরভুক্ত করা হয়, যার হেডকোয়ার্টার্স ছিল তরঙ্গপুরে। শুরুতে এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন নওগাঁস্থ ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর নজমুল হক। কিন্তু তিনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে অবসরপ্রাপ্ত মেজর কাজী নুরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন প্রায় ১৫ হাজার। তন্মধ্যে নিয়মিত যোদ্ধা (সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্য) ছিলেন প্রায় ২৫০০। অবশিষ্টরা ছিলেন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা।
৭ নং সেক্টরটি ৯টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল। রাজশাহী শহর ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার শেখপাড়া সাব-সেক্টরের অধীন। এর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন বজলুর রশীদ। রাজশাহী শহর তথা রাজশাহী জেলা থেকে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন, তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে প্রথমে মুর্শিবাদবাদ জেলার শেখপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত সূর্যসেন ভারতী ক্যাম্প (দায়িত্বে এডভোকেট আব্দুল হাদী এমপিএ), তিতুমীর ক্যাম্প (দায়িত্বে ডা. আলাউদ্দিন) ও মালদা জেলার সিংগাবাদ যুবশিবির ক্যাম্প (দায়িত্বে সরদার আমজাদ হোসেন এমপিএ)-এ যোগ দিতেন। এসব ক্যাম্পে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাঁদের বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্পে পাঠানো হতো।
মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইপিআর-এর রাজশাহী সেক্টরে দায়িত্বরত বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা হয়। এর মধ্যেও তাদের কয়েকজন বেসামরিক পোশাকে শহরের জনতার সঙ্গে মিশে যান। ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনাছাউনির কমান্ডার পুলিশের বাঙালি ডিআইজি মামুন মাহমুদকে রাজশাহী পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণ করাতে এবং অস্ত্রাগারের চাবি সেনাবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করার নির্দেশ দেয়। মামুন মাহমুদ এ নির্দেশ উপেক্ষা করলে ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৬টার দিকে তাঁকে সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তাঁর এবং তাঁর গাড়ির ড্রাইভারের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
২৫শে মার্চ রাতে এবং ২৬শে মার্চ ভোরে পাকবাহিনী ঢাকার মতো রাজশাহী শহরেও হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে ২৬শে মার্চ ভোররাতে শহরের রানিবাজারের মোড়ে অবস্থিত বাসা থেকে রেভিনিউ অফিসার দেওয়ান সিদ্দিক হোসেন ও তাঁর শ্যালক খন্দকার আলী আফজালকে ধরে নিয়ে যায়, তাঁরা আর ফিরে আসেননি। একই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট নাজমুল হক সরকার এমএনএ, শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ হাফিজ সাত্তার, এডভোকেট বীরেন্দ্রনাথ সরকার এবং বঙ্গবন্ধুর বিশিষ্ট বন্ধু আব্দুস সালামের দুই পুত্র শহিদুজ্জামান সেলিম ও আসিমুজ্জামান, আবদুস সালামের সহোদর হাসানুজ্জামান খোকা ও ভগ্নীপতি সাইদুর রহমান মীনাকে পাকবাহিনী হত্যা করে। এডভোকেট আব্দুল হাদী এমপিএ-এর বড়ভাই আব্দুল হককেও ধরে নিয়ে হত্যা করে। নাজমুল হক সরকারকে হত্যার খবর শুনে শহরবাসী ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং পাড়া- মহল্লায় ব্যারিকেড দিতে শুরু করে। পাকিস্তানি সৈন্যভর্তি কয়েকটি ভ্যান থেকে পুলিশ লাইনের ভেতর গুলিবর্ষণ করলে বাঙালি পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। এতে বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
২৭শে মার্চ সকালে রাজশাহীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী পুলিশ লাইন্সের সামনে ডিফেন্স নেয়। এ পরিস্থিতিতে রাজশাহী পুলিশ ও রাজশাহীস্থ সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী এ সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে দুপুরের দিকে পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে। এ অবস্থায় রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহসান ওয়ারলেসের মাধ্যমে নওগাঁস্থ ইপিআর-এর সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রমএর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর সাহায্য কামনা করেন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় (বিশেষত মুক্তিসংগ্রামীদের সৃষ্ট ব্যারিকেডের কারণে) এবং স্বল্পসময়ে ৬০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করা অসম্ভব বিধায় নওগাঁ থেকে তৎক্ষণাৎ ইপিআর-এর সাহায্য পাওয়া যায়নি। সুতরাং পুলিশ লাইন্সের বাঙালি সদস্যগণ তাদের হালকা অস্ত্র দিয়েই পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করেন। এদিন সমস্ত রাত ধরে গুলি বিনিময় চলে। এক পর্যায়ে পুলিশ লাইন্স দখল করা অসম্ভব মনে করে পাকবাহিনী শঠতার আশ্রয় নেয়। ২৮শে মার্চ সকাল ১০টার দিকে তারা সাদা পতাকা উড়িয়ে গুলি বন্ধের আহ্বান জানায়। তারা গুলি বন্ধ করে সেনাছাউনির উদ্দেশ্যে পুলিশ লাইন ত্যাগ করে। এতে বাঙালি পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যগণ বিভ্রান্ত হয়ে ব্যারাকে ফিরে যান। কিন্তু বেলা ১টার দিকে সেনাবাহিনী অকস্মাৎ পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে এবং মর্টার শেলিংসহ মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকবাহিনীর এই হঠাৎ আক্রমণের কারণে পুলিশ সদস্যগণ পূর্বের ন্যায় প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হন। তাই অনন্যোপায় হয়ে তাঁরা পুলিশ লাইনের পেছন দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান। রাজশাহী পুলিশ লাইন্স যুদ্ধ-এ সেদিন প্রায় অর্ধশত পুলিশ সদস্য ও কর্মচারী শহীদ হন। ২৯শে মার্চ সেনাবাহিনী বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট তাঁদের লাশ হস্তান্তর করে এবং পুলিশ লাইন্সের অভ্যন্তরে বাবলাবনে তাঁদের কবর দেয়া হয়।
পুলিশ লাইন্স দখলের পরপরই সেনাবাহিনী রাজশাহী বেতার কেন্দ্র দখল করে নেয়। এর আগে ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে অবস্থানরত সকল অবাঙালি জওয়ান পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে আশ্রয় নেয়। এই সুযোগে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। যাওয়ার সময় তাঁরা অবাঙালি জওয়ানদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রগুলো নিয়ে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে আক্রমণের পর নওগাঁস্থ ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর নাজমুল ও সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ঢাকা-রংপুর ও ঢাকা-রাজশাহী পথে পাকবাহিনীর যাতায়াত বন্ধের উদ্দেশ্যে কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর অংশ হিসেবে সরদহ ক্যাডেট কলেজের এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন বজলুর রশীদকে রাজশাহী আঞ্চলের ইপিআর সদস্য ও পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের (পিটিসি) পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে গোপালপুর- পুঠিয়া-নন্দনগাছি-ঈশ্বরদি অঞ্চলে ডিফেন্স নিতে বলা হয়। মীরগঞ্জ বিওপি (বর্ডার আউটপোস্ট)-র প্লাটুন কমান্ডার সিরাজউদ্দিন লস্করের ওয়ারলেসের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন রশীদ বিভিন্ন পয়েন্টে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। এজন্য পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রায় ৭০০ রাইফেল ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। ক্যাপ্টেন রশীদের বাহিনী ৩০ ও ৩১শে মার্চ পাবনা থেকে রাজশাহীর দিকে অগ্রসরমাণ ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে ঝলমলিয়া ও বিড়ালদহে আক্রমণ করে। এতে ৩০ জন পাকসেন নিহত হয় এবং মাত্র ১০-১২ জন সৈন্য রাজশাহী শহরে পৌছতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন রশীদের বাহিনীর দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
৩০শে মার্চ পাকবাহিনী রাজশাহী শহর থেকে গিয়ে গোদাগাড়ি ইপিআর ক্যাম্প (বিওপি) আক্রমণ করে। একই সময়ে পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান থেকে ইপিআর বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে ইপিআর সদস্য আব্দুল মালেক শহীদ এবং অনেকে আহত হন। সন্ধ্যার পূর্বেই আবার পাকবাহিনী রাজশাহী ফিরে আসে। এদিকে নওগাঁ থেকে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল ইপিআর সৈন্য এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও গোদাগাড়ির ইপিআর সৈন্যরা রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হন। ক্যাপ্টেন বজলুর রশীদের নেতৃত্বে একটি বাহিনীও সরদহ থেকে রেল লাইন ধরে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়। ৩১শে মার্চ রাতে তাঁরা হর্টিকালচারের উত্তরদিকে আমবাগানে আশ্রয় নেন। সিরাজউদ্দিন লস্করের নেতৃত্বে অপর একটি গ্রুপ সামসাদিপুর আমবাগানে ঘাঁটি গাড়ে এবং এখান থেকে একটি গ্রুপ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। এ-সময় ছাত্রলীগ- ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর কয়েকজন কর্মী তাঁদের সহযোগিতা করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে দুদিন অবস্থানের পর তাঁরা শহরের দিকে রওনা দেন। ৩রা এপ্রিল রাত ২টার দিকে তাঁরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বড়কুঠি ও বাটারমোড়ে অবস্থান নেন। একই সময়ে ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল রাজশাহী কোর্টের উত্তর দিকে পৌঁছায়। রাতের মধ্যেই ক্যাপ্টেন গিয়াস, সিরাজ লস্কর ও ক্যাপ্টেন রশীদের সম্মিলিত বাহিনী শহর দখলে নেয়। সে- রাতে তালাইমারীর বিশিষ্ট ঠিকাদার জেবের মিয়াসহ কয়েকজন যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করেন।
৪ঠা এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা শহরের বিহারি কলোনি দখল করেন এবং সেরিকালচার গবেষণা কেন্দ্রের উত্তরে রেল লাইনের পার্শ্ববর্তী স্থানে ট্রেঞ্চ কেটে অবস্থান নেন। ৬ই এপ্রিল সন্ধ্যা ৬.৩০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা উপশহরস্থ পাকিস্তানি সেনাছাউনি আক্রমণ করে রাজশাহী শহর দখল করে নেন। কিন্তু পাকসেনারা শক্তি বৃদ্ধি করে ১৩ই এপ্রিল পুনরায় আক্রমণ করে। এদিন দিবাগত রাত ২টার দিকে পাকবাহিনী অনবরত আর্টিলারি ফায়ার এবং জঙ্গিবিমান থেকে হামলা চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় গিয়াস বাহিনীসহ মুক্তিবাহিনী পিছু হটে নবাবগঞ্জের দিকে সরে যায় এবং গোদাগাড়িতে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করে। এরপর পাকবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিফেন্স নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক হলসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ও অতিথি ভবন দখল করে। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে তারা পার্শ্ববর্তী এলাকায় হত্যা ও নির্যাতন চালাতে থাকে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ধ্বংস এবং সকল হল, ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার ও ল্যাবরেটরি লুট করে। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী গোদাগাড়ি আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণের মুখে ক্যাপ্টেন গিয়াসের বাহিনী পদ্মানদী পাড় হয়ে চর এলাকায় আশ্রয় নেয়। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। ২২শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন গিয়াস তাঁর বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভারতের লালগোলায় আশ্রয় নেন। ক্যাপ্টেন বজলুর রশীদও তাঁর বাহিনী নিয়ে চারঘাট এলাকা দিয়ে পদ্মানদী অতিক্রম করে ভারত সীমান্তে আশ্রয় নেন। এরপর ক্যাপ্টেন গিয়াস ও ক্যাপ্টেন রশীদ বাহিনীর সমন্বয়ে রাজশাহী অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়।
রাজশাহী শহরের সপুরায় পাকবাহিনীর একটি সেনানিবাস ছিল। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে ছিল রাজশাহী জেলার বৃহত্তম সেনাক্যাম্প।
রাজশাহী শহরের সোনার দেশ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকার সাহেববাজারস্থ অফিস দখল করে রাজাকার বাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করা হয়। শহরের অবাঙালিরা এ বাহিনীতে যোগ দেয় এবং জিন্নাহ ইনস্টিটিউটে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। রাজশাহী জেলা শান্তি কমিটি-র প্রধান ছিল জেলা কনভেশন মুসলিম লীগের সভাপতি আয়েনউদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক জামায়াতে ইসলামীর আফাজউদ্দিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল হাই ফারুকী ও আবদুল আজিজ আলবদর- বাহিনীর শহর শাখার নেতা ছিল। শহরের রানিবাজারস্থ মোহিনীমোহন সাহার বাড়ি দখল করে তাদের কার্যালয় স্থাপন করা হয়।
ঢাকার ন্যায় রাজশাহী শহরেও পাকবাহিনী ২৫শে মার্চ রাত থেকে গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করে এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তা অব্যাহত থাকে। রাজশাহী শহরে তখন বিহারিদের কয়েকটি কলোনি ছিল, যেমন- উপশহর কলোনি, শিরোইল কলোনি, বেলদারপাড়া কলোনি, ভেড়িপাড়া কলোনি ইত্যাদি। এসব কলোনির বিহারিরাই মূলত পাকবাহিনীর বিভিন্ন অপকর্মের সহযোগী ছিল। তাদের সঙ্গে রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির বাঙালি সদস্যরাও যোগ দেয়। তারা শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, বিভিন্ন ব্যক্তিকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়া ইত্যাদি অপকর্ম করে।
পাকবাহিনী ১৩ই এপ্রিল রাজশাহী শহর দখলের পর থেকে সাধারণ মানুষের বাড়িঘর ও দোকানপাট পোড়ানো শুরু করে। ১৪ই এপ্রিল তারা তালাইমারী, ভদ্রা ও রানিনগর এলাকার বাড়িঘরে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করে। তারা রাজশাহী শহরের মোট ৪৭০০টি বাড়ির মধ্যে ১৩৯৮টি বাড়ি সম্পূর্ণরূপে এবং ৭৪৭টি আংশিকভাবে ধ্বংস করে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ জিন্নাতুন নেছা তালুকদারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। রাজশাহী শহরের ব্যবসাকেন্দ্র সাহেববাজার, নিউমার্কেট ও হড়গ্রাম বাজারে লুটপাট শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। হিন্দুবাড়িসহ আওয়ামী লীগপন্থী মুসলমানদের বাড়ি, বিশেষত যে-বাড়ি থেকে কেউ মুক্তিযুদ্ধে গেছেন, তাঁদের বাড়িতেও লুটপাট হয়েছে। শহরের হিন্দুদের মন্দিরগুলোতে লুট হয়েছে। আলবদর বাহিনী মিয়াপাড়াস্থ রাজশাহী ধর্মসভা দখল করে সেখানে মাদ্রাসা বানায়। তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী কলেজে অবস্থিত শহীদ মিনার ভেঙ্গে দেয়। পাকবাহিনী রানিবাজারস্থ কুঞ্জ মৈত্রের বাড়ির সামনে স্থাপিত সিংহমূর্তির স্থাপত্যটি ভেঙ্গে দেয়। রাজশাহী শহরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে অসংখ্য নারী নির্যাতনের শিকার হন। ১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী রানিবাজারস্থ এক বাড়িতে ঢুকে পুত্রবধূ ও তাঁর শ্বাশুড়িকে ধর্ষণ করে। জোহা হলের নির্যাতনকেন্দ্রে বহু নারী নির্যাতিত ও নিহত হন।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অনেক বুদ্ধিজীবীকেও হত্যা করে। বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা ঘটে দু-দফায়। মার্চ ও এপ্রিল মাসে তারা কোনো অঞ্চলে প্রবেশ করে প্রথমেই সেখানকার প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী প্রভৃতি পেশার লোকদের হত্যা করে। পরবর্তীকালে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পরাজয় আসন্ন জেনে তারা পরিকল্পনামাফিক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। রাজশাহী জেলায় তারা ৩৯ জন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, ৮ জন হাইস্কুল শিক্ষক, ৩ জন কলেজ শিক্ষক, ৩ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং ৫ জন আইনজীবীকে হত্যা করে। রাজশাহী শহরে হত্যা করে ৮ জন বুদ্ধিজীবীকে। তাঁদের মধ্যে তিনজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, একজন কবি, তিনজন আইনজীবী এবং একজন সাংবাদিক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক হলেন- অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার (ভাষা বিভাগের সংস্কৃত বিষয়ের শিক্ষক; প্রতিরোধ সংগ্রামে আহত এক ইপিআর মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি ১৩ই এপ্রিল রাতে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়স্থ বাসভবনে আশ্রয় দিয়েছিলেন। প্রতিবেশী উর্দুভাষী এক অধ্যাপক এ বিষয়টি পাকবাহিনীকে জানিয়ে দিলে ১৪ই এপ্রিল সকাল ৯:৩০টায় পাকবাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটের অদূরে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়; স্বাধীনতার পর তাঁর দেহাবশেষ তুলে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সমাহিত করা হয়), অধ্যাপক হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগের শিক্ষক; ১৪ই এপ্রিল বিকেল ৪টায় পাকবাহিনী তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে জুবেরী ভবনে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর সন্ধান পাওয়া যায়নি) এবং অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুম (মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক; ২৫শে নভেম্বর রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অফিসের অবাঙালি স্টেনোগ্রাফার তৈয়ব আলী তাঁকে ঘোড়ামারাস্থ বাসা থেকে ডেকে নিয়ে মিলিটারির গাড়িতে তুলে দেয়। ৩০শে ডিসেম্বর বোয়ালিয়া ক্লাবের সামনে পদ্মার চরে আরো ১৩টি লাশের সঙ্গে তার লাশ পাওয়া যায় এবং কাদিরগঞ্জ গোরস্থানে তাঁকে কবরস্থ করা হয়)।
জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট নাজমুল হক সরকার (আওয়ামী লীগ নেতা, আইনজীবী ও রাজশাহী জেলা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক)-কে পাকবাহিনী ২৬শে মার্চ সকালে গ্রেফতার করে এবং পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। এডভোকেট বীরেন্দ্রনাথ সরকার (আইনজীবী, রাজনীতিক, সমাজসেবক, সাংবাদিক ও রাজশাহী প্রেস ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য)-কে ৩রা এপ্রিল রাত ১১টায় দালালদের সহায়তায় পাকবাহিনী তাঁর অলকা সিনেমা হলের নিকটস্থ বাসভবনের শয়নকক্ষে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে। তসলিম উদ্দীন আহমদ (আয়কর আইনজীবী) নওগাঁয় পাকসেনাদের গুলিতে আহত এক ব্যক্তিকে গোপনে রাজশাহীতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এ অভিযোগে ১৯শে নভেম্বর পাকবাহিনী তাঁকে নিজ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের সন্নিকটস্থ বধ্যভূমিতে অপর ৩০-৪০ জনসহ তাঁকে হত্যা করে। আবুল হোসেন মোক্তার (রাজশাহী কোর্ট)-কে ১৩ই নভেম্বর বোয়ালিয়া থানার পুলিশ ধরে নিয়ে যায় এবং ১৯শে নভেম্বর জোহা হল সন্নিকটস্থ বধ্যভূমিতে পাকসেনারা তাঁকে হত্যা করে। আবু সাঈদ (রাজশাহী জেলা সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, দৈনিক আজাদ পত্রিকার রাজশাহী প্রতিনিধি এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব) মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় রাজশাহীতে গঠিত ‘সাংবাদিক-শিল্পী-সাহিত্যিক পরিষদ’-এর ব্যানারে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২৮শে জুন কয়েকজন দালাল তাঁকে আটক করে জোহা হলে নিয়ে যায়। সেখানে পাকবাহিনী তাঁকে অমানবিক নির্যাতন করে এবং জুলাইয়ের কোনো এক সময় হল-সংলগ্ন বধ্যভূমিতে তাঁকেসহ ১৪ জনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। ফেরদৌস দৌলা বাবুল বিপ্লবী কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ‘ফেদ ইন বেগম’ ছদ্মনামে তিনি স্বাধীনতার কবিতা লিখতেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকে স্বহস্তে হাতবোমা তৈরি করে শহরের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তিনি শত্রুপক্ষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করেন। ২৬শে নভেম্বর ইস্ট পকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিকাফ)-এর কমান্ডার তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং ঐদনিই পদ্মাপারের বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর্যুক্ত তিনজন শিক্ষক ব্যতীত আরো যাঁরা শহীদ হন তাঁরা হলেন- মো. আফজাল মৃধা (প্রহরী; যুদ্ধের শুরুতেই নিখোঁজ), মিজানুল হক (খারদা সাপতলা, লালমনিরহাট; এমএসসি পূর্বভাগের মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে নিজ এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে শহীদ), আব্দুল মান্নান আখন্দ (বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র; ২৭শে মার্চ গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালী ব্রিজ যুদ্ধ-এ আরো দশজন সহযোদ্ধার সঙ্গে শহীদ), আব্দুর রাজ্জাক (নৈশ প্রহরী; ১৩ই এপ্রিল রাতে প্রশাসনিক ভবনে কর্মরত অবস্থায় পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ), মো. কলিম উদ্দিন (প্রকৌশল দপ্তরের কার্য- সহকারী; ১৩ই এপ্রিল আরো অনেকের সঙ্গে পাকসেনারা গায়ে পেট্রল ঢেলে তাঁকে পুড়িয়ে মারে.), মোহন লাল (সুইপার; ১৩ই এপ্রিল পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ শহীদ), আমীরুল হুদা (বাংলা বিভাগের ছাত্র; সৈয়দপুর ও রংপুর সেনানিবাস থেকে অগ্রসরমাণ পাকসেনাদের প্রতিরোধরত এক ক্ষুধার্ত ইপিআর যোদ্ধাকে ১৩ই এপ্রিল মটর সাইকেলে করে দিনাজপুর কালীতলায় তাঁর গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান এবং তাঁকে পুনরায় রণক্ষেত্রে পৌছে দেয়ার সময় শত্রুদের গুলিতে শহীদ হন), মোহাম্মদ ইউসুফ (পিয়ন; ১৪ই এপ্রিল শহীদ), ওয়াহাব আলী (পিয়ন; ২৪শে এপ্রিল পাকসেনারা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে এবং তাঁর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়), কোরবান আলী (প্রহরী; ২৪শে এপ্রিল পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়, তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি), মোহাম্মদ আলী খান (অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র; এপ্রিল মাসে পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ এবং শের-ই-বাংলা হল প্রাঙ্গণে কবরস্থ), আব্দুল মালেক (পিয়ন; জুন মাসে পাকসেনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমপাড়া থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে), প্রদীপ কুমার রাহা (রসায়ন বিভাগের ছাত্র; জুলাই মাসে সিরাজগঞ্জের নিজগ্রামে পাকসেনাদের হাতে শহীদ, পাকসেনারা তাঁদের বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয় এবং বাড়ির মেয়েদের শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করে), শাহজাহান আলী (বিলসা, গুরুদাসপুর; বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র, মুক্তিযুদ্ধের প্রথমার্ধে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে শহীদ), গোলাম সারওয়ার খান সাধন (এমএসসি পূর্বভাগের ছাত্র; ৬ই সেপ্টেম্বর নগরবাড়ির কাছে এক নৈশ অভিযানের পর চার মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে বিশ্রাম নেয়ার সময় ঘাতকদের হাতে ধরা পড়েন এবং নগরবাড়ি পাকসেনা ক্যাম্পে কয়েকদিন অমানুষিক নির্যাতনের পর অন্যদের সঙ্গে ১০ই সেপ্টেম্বর তাঁকে হত্যা করা হয়), ইদ্রিছ আলী (বয়; অক্টোবর মাসে রাজাকাররা শ্যামপুর থেকে জোহা হলে ধরে নিয়ে যায়, তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি), শেখ এমাজউদ্দীন (স্টেনো টাইপিস্ট; ৬ই নভেম্বর রাতে পাকসেনারা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে জোহা হলের পাশে আরো বিশ জনের সঙ্গে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়), আবুল আলী (ড্রাইভার; ৬ই নভেম্বর পাকসেনারা শান্তি কমিটির দালালদের সহযোগিতায় বাড়ি থেকে ধরে এনে হত্যা করে), শফিকুর রহমান (কাঠমিস্ত্রী; ৭ই নভেম্বর আলবদরদের সহায়তায় পাকসেনারা ঘোড়ামারার বাসা থেকে ধরে এনে হত্যা করে), মো. ওয়াজেদ আলী (পিয়ন; ১৩ই নভেম্বর রাতে আলবদর বাহিনী মেহেরচণ্ডীর বাড়ি থেকে ধরে এনে হত্যা করে), এস এম সাইফুল ইসলাম (উচ্চমান সহকারী; ১৩ই নভেম্বর পাকসেনাদের হাতে শহীদ), মোশাররফ হোসেন রঞ্জু (অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র; ঢাকার রূপগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ) এবং নূরু মিয়া (প্রহরী; অফিস চলাকালীন সময়ে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়, তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি)।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা শহীদ হন তাঁরা হলেন- লে. সেলিম, শহিদুল ইসলাম, আব্দুল হামিদ, মো. এ জেড শওকত রেজা, মো. আমিনুর রহমান, মো. তোজাম্মেল হক, সাজেদ উদ্দিন আহমদ, মো. শামসুদ্দীন আহমদ, মো. শহিদ হোসেন, মো. বদরুদ্দোজা, নাসিম ইকবাল (ছাত্র), সেকেন্দার ও সিরাজ (কর্মচারী)।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শহীদরা হলেন- কাজী নুরুন্নবী (৫ম বর্ষ), আবুল আমজাদ (৫ম বর্ষ), কাজল কুমার ভদ্র (৩য় বর্ষ), আবুল, আমজাদ, আলমগীর, সাইফুল, কাইয়ুম, মান্নান, মোস্তফা, মনসুর, সিরাজ, শামসুল।
রাজশাহী পুলিশ লাইন্সের শহীদরা হলেন- মামুন মাহমুদ (রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি; ৩রা মার্চ নিজ বাসভবনে কালো পতাকা ওড়ান; ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহর ডাকে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি), শাহ আব্দুল মজিদ পিএসপি (রাজশাহীর পুলিশ সুপার; ৩১শে মার্চ পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন সোলায়মান মাহমুদ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, এরপর আর ফিরে আসেননি)।
রাজশাহী শহরের অন্য শহীদরা হলেন— শহিদুজ্জামান সেলিম ও আসিমুজ্জামান (পিতা এডভোকেট আব্দুস সালাম; ঢাকার বুয়েট ও রাজশাহী কলেজের ছাত্র; ২৫শে মার্চ রাতে পাকসেনারা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে), সাইদুর রহমান মীনা (গবেষণা কর্মকর্তা) ও তাঁর ভগ্নীপতি হাসানুজ্জামান খোকা (সংস্কৃতি-কর্মী) (২৫শে মার্চ রাতে লক্ষ্মীপুরের বাড়ি থেকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে হত্যা করে), দেওয়ান সিদ্দিক হোসেন (রেভিনিউ অফিসার) ও তাঁর শ্যালক খন্দকার আলী আফজাল (২৫শে মার্চ রাতে পাকসেনা ও তাদের দোসররা রানিনগরের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে), আব্দুল হক (সিএন্ডবি সাব-ওভারসিয়ার ও এমএনএ এডভোকেট আব্দুল হাদীর ভাই; ২৫শে মার্চ রাতে পাকসেনারা বাড়ির ভেতরে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে), মো. মোক্তার হোসেন (সমাজকর্মী; ২৭শে মার্চ পাকসেনাদের নিক্ষিপ্ত মর্টার শেলে পুলিশ লাইনের প্রধান গেটের সম্মুখস্থ নিজ বাড়ির উঠানে খোঁড়া ট্রেঞ্চে এক ছেলে ও দুই প্রতিবেশীসহ শহীদ), মো. আব্দুল হালিম (আওয়ামী লীগ কর্মী; ২৮শে মার্চ পাকসেনারা ধরে নিয়ে সাতদিন অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে), এডভোকেট আমিন উদ্দিন (নাটোর; ২৬শে মার্চ পাকসেনারা ধরে নিয়ে ২৯শে মার্চ হত্যা করে), সুরেশ পাণ্ডে (রাজনীতিক; ২রা এপ্রিল রাতে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা ফুদকিপাড়ার বাড়িতে নির্মমভাবে হত্যা করে), ব্যবসায়ী দুই সহোদর ইলিয়াস উদ্দিন ও মিলিয়াশ উদ্দিন রবু (১৪ই এপ্রিল সকাল ১০টায় পাকসেনারা বাড়িতে ঢুকে গুলি করলে অপর একজনসহ শহীদ), আব্দুল হাফিজ, তাঁর চাচাত ভাই সোলাইমান ও ভারত থেকে আগত সোলাইমানের ভাই দিলজান খান (রায়পাড়া; ১৪ই এপ্রিল সোলাইমানের বাড়িতে পাকসেনাদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে আব্দুল হাফিজ ও দিলজান সঙ্গে-সঙ্গে শহীদ হন এবং সোলাইমান হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান), সাইফুল (কুষ্টিয়া; কাঠালবাড়িয়ায় শ্বশুর সমজানের বাড়ি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি রাজাকাররা ধরে এনে পদ্মার ওপারে নবীনগর চরে হত্যা করে), যদু শেখ (কাঠালবাড়িয়া; এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকসেনারা বাড়িতে আগুন দিলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে তিনি মারা যান), মো. জেকের আলী (টিকাপাড়া; এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং তার বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়), খলিলুর রহমান (সিআইবি-র সহকারী পরিচালক; ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি মেজর সালমান মাহমুদ নিজ বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং অমানবিক নির্যাতনের পর ২৯শে এপ্রিল সপুরা ক্যান্টনমেন্টে পাঞ্জাবি নায়েক সুবেদার হায়াত মাহমুদ সালমানের নির্দেশে হত্যা করা হয়), মোসলেম উদ্দিন (বশড়ি; নওগাঁ জেলার রানিনগরে ইপিএডিসিতে স্টোর কিপার পদে কর্মরত ছিলেন; ১৭ই জুন সকালে পাকসেনারা শ্যালক নাজমুল হকসহ তাকে ধরে নিয়ে বাড়ির পাশে নির্মমভাবে বেয়নট চার্জ করলে মোসলেম উদ্দিন শহীদ হন, তবে নাজমুল প্রাণে বেঁচে যান), মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইফুল ইসলাম ঠান্ডু (ছাত্র, পাঁচানী মহল্লা; মেজর শফিকের নির্দেশে চারঘাটের একটি অপারেশনে গিয়ে ২রা জুলাই শহীদ), আব্দুর রকিব (রায়পাড়া; পুলিশ কনস্টেবল, মুক্তিযুদ্ধকালে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানায় কর্মরত ছিলেন; মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে অংশ নেন এবং ১৭ই আগস্ট হানাদার বাহিনীর গুলিতে সেখানেই শহীদ হন), হাবু চৌকিদার ও আলী (হাডুপুর; রমজান মাসে আরো ৫ জনসহ ধরে নিয়ে কোর্টের পশ্চিম পাশে সিএন্ডবি ইটভাটায় গুলি করে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়), নওরোজ-উদ-দৌলা (গবেষক), তাঁর ভাগ্নে রমজান আলী ও ভাতিজা ফেরদৌস-উদ-দৌলা (মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওয়ারলেস তৈরি করে দিতেন; আলবদর ও রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা ২৫শে নভেম্বর নওরোজ-উদ-দৌলাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পদ্মাপাড়ের বধ্যভূমিতে এবং ২৬শে নভেম্বর রমজান আলী ও ফেরদৌস-উদ-দৌলাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে), বিদেশী নামে পরিচিত জনৈক ব্যক্তি (সাইরগাছা), মহিরুদ্দিন ভাল্লু (রায়পাড়া; ডিসেম্বর মাসে বিজয়ের আগে পাকসেনারা নিজবাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়, তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি), আজাহার আলী (বুলনপুর কোর্ট এলাকা; পাকসেনাদের দেখে বাড়ির পাশে নিজস্ব ইটভাটায় স্ত্রীসহ লুকানোর সময় পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ) এবং আলমগীর হোসেন (সমাজকর্মী; রাজাকাররা পাকসেনাদের হাতে তাকে তুলে দেয় এবং নিমতলায় শহীদ)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শহরের প্রায় সকল হিন্দু পরিবার এবং আওয়ামী লীগপন্থী পরিবার ভারতে গিয়ে জলঙ্গী, বহরমপুর, ভগবানগোলা, কাতলামারী প্রভৃতি শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় নেয়। কোনো-কোনো পরিবার ভারতে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও আশ্রয়গ্রহণ করে। রাজাকাররা রানিবাজার ও ঘোড়ামারাতে কয়েকটি বাড়ি দখল করে ক্যাম্প বসায়। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল কুঞ্জ মৈত্রের বাড়ি। রানিবাজার নাজ বোর্ডিংয়ের সামনে মিলিশিয়া বাহিনীর একটা ক্যাম্প ছিল। রেশমপট্টিতে আলবদররা ক্যাম্প করে। তাদের একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ছিল বোয়ালিয়া থানার সামনে মোসলেম সাহেবের বাড়িতে। এখানে নির্যাতন করে অনেককে হত্যা করা হয়। এর পেছনের পুকুর থেকে অনেক লাশ ও হাড়গোড় পাওয়া গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে পাকবাহিনীর একটি বড় ক্যাম্প ছিল। তিনতলাবিশিষ্ট এ ছাত্রাবাসের বিভিন্ন কক্ষে বন্দিদের আটকে রোখে নির্যাতন করা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে পাকবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা থাকত। সেখানেও অনেককে নিয়ে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হতো।
রাজশাহী শহরে অনেকগুলো বধ্যভূমি ও গণকবর আছে। সেগুলো হলো— পদ্মার চর বধ্যভূমি ও গণকবর জোহা হল সংলগ্ন বধ্যভূমি ও গণকবর, মন্নুজান হল বধ্যভূমি ও গণকবর, জুবেরী ভবন বধ্যভূমি ও গণকবর, কাজলা গেট বধ্যভূমি ও গণকবর, বিনোদপুর বধ্যভূমি ও গণকবর, তালাইমারী বধ্যভূমি ও গণকবর, হাদীরমোড় বধ্যভূমি ও গণকবর, অলোকা সিনেমা হল বধ্যভূমি ও গণকবর, বোয়ালিয়া থানা সংলগ্ন বধ্যভূমি ও গণকবর, ঘোড়ামারা বধ্যভূমি ও গণকবর, সাহেববাজার স্টার স্টুডিও সংলগ্ন বধ্যভূমি ও গণকবর, বোয়ালিয়া ক্লাব বধ্যভূমি ও গণকবর, কেন্দ্রীয় উদ্যান সংলগ্ন বধ্যভূমি ও গণকবর, পুলিশ কমিশনারের অফিস সংলগ্ন বধ্যভূমি ও গণকবর, পুলিশ লাইন্স সংলগ্ন বধ্যভূমি ও গণকবর, ডিসি বাংলো বধ্যভূমি ও গণকবর, সিএন্ডবি ইটভাটা বধ্যভূমি ও গণকবর, আজাহারের ইটভাটা বধ্যভূমি ও গণকবর, বিসমিল্লাহ মার্কেট বধ্যভূমি ও গণকবর, রাজশাহী সেনানিবাসের ১নং গেট বধ্যভূমি ও গণকবর, উপশহর কলেজ সংলগ্ন পূর্বড্রেন বধ্যভূমি ও গণকবর, হর্টিকালচার বধ্যভূমি ও গণকবর এবং রেলস্টেশন বধ্যভূমি ও গণকবর।
ভোটার তালিকা অনুযায়ী রাজশাহী শহরে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা চার শতাধিক। বর্তমানে ভাতা পান ২৬৭ জন। শহরের প্রতিটি মহল্লায় কমপক্ষে ২-৩ জন করে মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তবে তালাইমারী, রানিনগর, মোন্নাফের মোড় ও হাদীরমোড় মহল্লায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি ছিল। এডভোকেট আব্দুল হাদী এমপিএ-র বাসস্থান হাদীরমোড় হওয়ায় এখানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল সর্বাধিক।
রাজশাহী শহরের দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে পদ্মানদী প্রবাহিত হওয়ায় এখানে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ কম হয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে অনেক গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, সড়ক ও রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিসআকর্ষণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করা। ২৩শে জুন পুলিশ লাইন্স অপারেশন পরিচালিত হয়। ২৫শে জুন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাজশাহী টেলিফোন এক্সচেঞ্জে গ্রেনেড হামলা করে। ২৬শে জুন একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজশাহী শহরের কাছে অবস্থিত কাটাখালী ব্রিজ উড়িয়ে দেন। ২৭শে জুন মুক্তিযোদ্ধারা কাটাখালীস্থ বৈদ্যুতিক কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ৪টি ট্রান্সফরমারের ক্ষতিসাধন করেন। এ অভিযানে ৩ জন পাক মিলিশিয়া নিহত হয়। ১লা জুলাই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সাহেববাজারে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ৪ জন পাকসেনা, নওহাটাস্থ বিমান বন্দরে হামলা চালিয়ে ৬ জন পাকিস্তানি এজেন্ট এবং রাজশাহী শহরে ৫ জন বিহারি এজেন্টকে হত্যা করে। ২রা জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী টেলিফোন এক্সচেঞ্জে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে একজন পাকিস্তানি এজেন্টকে হত্যা ও একজনকে আহত করেন। ৩রা জুলাই বিহারি কলোনিতে পাকিস্তানি এজেন্ট আলাউদ্দিনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। ১৪ই জুলাই শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের এক হামলায় হানাদার বাহিনীর ৩ জন অবাঙালি এজেন্ট নিহত হয়। একই দিন তাঁরা নওহাটায় পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর হামলা চালিয়ে ৪ জন পাকসেনা ও তাদের দুজন এজেন্টকে হত্যা করেন এবং হরিয়ান সুগার মিলে গ্রেনেড হামলা চালান। ১৯শে জুলাই শহরে আজিমুদ্দিন নামের এক পাকিস্তানি এজেন্ট নিজ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। ২০শে জুলাই ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহরের ফুদকীপাড়ায় পাকবাহিনীর এক পেট্রোল পার্টির ওপর হামলা চালিয়ে ৪ জন পাক মিলিশিয়াকে হত্যা করেন। ২৪শে জুলাই একটি টহল দলের ওপর হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দুজন পাকসেনাকে হত্যা করেন। একই দিন কাটাখালীস্থ পাকসেনাদের সেন্ট্রি পোস্টে হামলা চালালে একজন পাকসেনা নিহত ও দুজন আহত হয়। ২২শে সেপ্টেম্বর কাটাখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মর্টার হামলা চালানো হয়। এতে দুজন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। ১১ই অক্টোবর আমনুরা-রাজশাহী রেলপথ অপারেশন-এ পাকসেনাদের বহনকারী একটি ট্রেন উড়িয়ে দেয়া হয়। এতে ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। নভেম্বর মাস থেকে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের বাইরে বিভিন্ন সড়ক ও রেলসেতু ধ্বংস করেন এবং ডিসেম্বর মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করে রাজশাহী শহরের দিকে অগ্রসর হন। ১৪ই ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনী নবাবগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চল মুক্ত করে। ফলে পাকবাহিনী মহানন্দা নদী অতিক্রম করে নবাবগঞ্জে সংঘবদ্ধ হয় এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করে। এমন সময় ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ- নবাবগঞ্জ শহর দখলমুক্ত করার উদ্দেশ্যে তাঁর বাহিনী নিয়ে মহানন্দা পার হয়ে শত্রুর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ইতোমধ্যে ঢাকায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি শুরু হলে এদিনই (১৪ই ডিসেম্বর) পাকবাহিনী নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী চলে আসে এবং ১৬ই ডিসেম্বর পুরো দল নাটোরে চলে যায়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেন। ১৭ই ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী রাজশাহী এসে পৌঁছান।
১৮ই ডিসেম্বর ভোরে পাকবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হল ক্যাম্প ছেড়ে নাটোরে চলে যায়। ফলে এদিনই রাজশাহী শহর হানাদারমুক্ত হয়। উত্তরাঞ্চলের সকল পাকসেনা নাটোরে সমবেত হয়ে ২০শে ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।
রাজশাহী শহরের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— এ কে মাহবুবুল আলম, বীর প্রতীক – (পিতা সুলতান উদ্দিন আহমেদ, হেতম খাঁ মহল্লা, বোয়ালিয়া), মো. বদিউজ্জামান টুনু, বীর প্রতীক> (পিতা আবদুল গফুর, লক্ষ্মীপুর ঝাউতলা মোড়) ও মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ, বীর প্রতীক> (পিতা আব্দুল খালেক, রাজশাহী শহর)।
রাজশাহী শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. সাইফুল ইসলাম ঠান্ডু (২রা জুলাই চারঘাট অপারেশনে শহীদ), আব্দুর রকিব (১৭ই আগস্ট ফুলছড়ি থানা যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল মান্নান আখন্দ (কাটাখালী ব্রিজ অপারেশনে শহীদ), গোলাম সারওয়ার খান সাধন (৬ই সেপ্টেম্বর নগরবাড়ি অভিযানের পর পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং ১০ই সেপ্টেম্বর নগরবাড়ির পাকক্যাম্পে শহীদ), মোশাররফ হোসেন রঞ্জু (ঢাকার রূপগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ)। এছাড়া বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৪ই ডিসেম্বর নবাবঞ্জ যুদ্ধে শহীদ হন।
রাজশাহী শহরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে নানারকম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে এ এইচ এম কামারুজ্জামান স্কোয়ার (রেলগেট) স্মৃতি অম্লান- স্মৃতিসৌধ (ভদ্ৰামোড়), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৯- এর গণঅভ্যুত্থানকালে ১৮ই ফেব্রুয়ারি শহীদ সামসুজ্জোহা সমাধি চত্বর, কাজলার মোড় মেইন গেইট সংলগ্ন সামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার স্থানে স্মৃতিফলক, বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বে দিক নির্জন স্থানে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ, সাবাস বাংলাদেশ স্মৃতিসৌধ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়), রাজশাহী পুলিশ লাইন্স স্মৃতিসৌধ, রাজশাহী বাবলাবন শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের নামফলক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার চত্বরে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, গণিতের শিক্ষক শহীদ হবিবুর রহমানের নামে একটি ছাত্রাবাস ও এর সম্মুখে স্মৃতিসৌধ, রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের নামফলক, জেলা প্রশাসকের চত্বরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার ও জেলা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক, রাজশাহী পুলিশ লাইন্স গণকবর স্মৃতিফলক, তালাইমারী গণকবর স্মৃতিফলক, রাজশাহীর ডিআইজি শহীদ মামুন মাহমুদের নামে প্রতিষ্ঠিত পুলিশ লাইন্স স্কুল ও কলেজ, শহীদ নজমুল হক সরকারের নামে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ বিদ্যালয় এবং শহীদ পুলিশ সুপার শাহ আবদুল মজিদ সড়ক অন্তর্ভুক্ত। [মো. মাহবুবর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড