You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে রাজস্থলী উপজেলা (রাঙ্গামাটি) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে রাজস্থলী উপজেলা (রাঙ্গামাটি)

রাজস্থলী উপজেলা (রাঙ্গামাটি) একটি পাহাড়ি জনপদ। রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা থেকে এর দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। এ উপজেলার আয়তন ১৪৫ বর্গকিলোমিটার। এর উত্তরে কাপ্তাই উপজেলা, দক্ষিণে বান্দরবান সদর, পূর্বে বিলাইছড়ি ও পশ্চিমে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় চন্দ্রঘোনা থানার অধীনে একটি ইউনিয়ন ছিল রাজস্থলী। পরবর্তীতে এটি উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। এটি মার্মা অধ্যুষিত এলাকা। মার্মা, চাকমা ও বাঙালি মিলে লোকসংখ্যা ৪-৫ হাজারের মতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি ১নং সেক্টরের অধীনে ছিল। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর সর্বত্র যখন আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল, তখনো পর্যন্ত রাজস্থলীতে তার কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েনি। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ পন্থী লোকজন এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন।
রাজস্থলীতে লোকসংখ্যা ছিল খুবই কম। স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে যে কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। তন্মধ্যে হাজী সৈয়দ আহমদ, হাজী সিদ্দিক আহমদ, কানা মিয়া তালুকদার, সাহাব মিয়া সওদাগর, আহমদ মিয়া, আবদুর রাজ্জাক, কুলা মিয়া, মো. ইউসুফ, রাজেন্দ্র কর্মকার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে ব্যবসায়ী ও দোকানদার আহমদ মিয়া খুব সক্রিয় ছিলেন। শীঘ্রই হাটে, বাজারে ও চায়ের দোকানে সর্বত্র স্বাধীনতার পক্ষে আলোচনা শুরু হয়। ২৬শে মার্চের পর রেডিওর মাধ্যমে স্থানীয়রা জানতে পারে যে, দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তখন লোকজনের মধ্যে অজানা ভয় ও আতঙ্ক কাজ করতে থাকে। স্থানীয় বয়স্ক নারী-পুরুষ দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য মিলাদ মাহফিলের আয়োজন এবং নফল রোজা রাখতেন। তবে এখানে দেশের অন্যান্য জেলা- উপজেলার মতো আন্দোলন-সংগ্রামের সমর্থনে মিছিল-মিটিং হয়নি। স্থানীয় লোকজনের আলোচনার মধ্যেই সব সীমাবদ্ধ থাকে।
১০ই এপ্রিল চট্টগ্রামের কালুরঘাটের পতনের পর শতশত ইপিআর, সেনা, পুলিশ, প্রশিক্ষণার্থী যোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা রাজস্থলী হয়ে কাপ্তাই এবং পরে বিলাইছড়ি হয়ে ভারতীয় সীমান্তের দিকে যেতে থাকেন। স্থানীয় লোকজন তাঁদের পথ দেখিয়ে দিত। প্রতিদিন বান্দরবান, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, পটিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া থেকে হাজার-হাজার শরণার্থী রাজস্থলীতে আসত এবং বর্তমান উপজেলা মাঠে তারা সমবেত হতো। স্থানীয়রা তাদের খাবারের ব্যবস্থা করত এবং সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিত। এ কাজে সহযোগিতা করতেন ফিরোজ রশিদ, আবদুল খালেক, ইউসুফ, সালেহ আহমদ, আহমদ মিয়া প্রমুখ। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় এসব লোকজন কাপ্তাই হয়ে বিলাইছড়ি যেত। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সীমান্তের দিকে চলে যেত। রাজস্থলী উপজেলার লোকজন শরণার্থীরা যাতে লুটপাটের শিকার না হয় এবং পথ ভুলে না যায় সেজন্য রাত জেগে পাহারা দিত। রাতের বেলা যারা এখানে আসত তাদের উপজেলা এলাকায় রাখা হতো। দিনের বেলা তাদের পথ দেখিয়ে দেয়া হতো। যেহেতু গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তাদের যাতায়াত করতে হতো, সেহেতু তারা যাতে নিরাপদে যেতে পারে সেজন্য স্থানীয় যুবকরাও তাদের এগিয়ে দিত। সে-সময় রাজস্থলী উপজেলায় যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ছিল নৌকা। তাই স্থানীয় মাঝিরা অনেককে নৌকায় করে কাপ্তাই হয়ে বিলাইছড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিত।
কাপ্তাই বাঁধে কর্মরত বিহারি ও অন্যান্য পাকিস্তানিরা ছিল এ এলাকার বাঙালিদের প্রধান শত্রু। এপ্রিলের প্রথম দিকে কাপ্তাইয়ে যখন অবাঙালিদের হত্যা করা হচ্ছিল, তখন তাদের ৪ জন পালিয়ে রাজস্থলী বাজারে চলে আসে এবং পথ ভুলে আখক্ষেতে ঢুকে পড়ে। তখন আহমদ মিয়া, আবদুর রাজ্জাক ও কুলা মিয়াসহ প্রায় ৩০-৪০ জন স্থানীয় লোক তাদের ঘিরে ফেলে এবং চারপাশে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে চারজনই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে করণীয় সম্পর্কে রাজস্থলী উপজেলায় স্থানীয় যুবকরা বয়স্কদের সঙ্গে পরামর্শ করে। পাকিস্তানি বাহিনী যাতে বাজারের দিকে আসতে না পারে সেজন্য তারা আলোচনা করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা এলে তাঁদের সহযোগিতার বিষয়েও আলোচনা হয়।
এপ্রিলের শুরুর দিকে বাঙ্গালহালিয়া স্কুল মাঠে যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। চন্দ্রঘোনা থানার এক সিপাহি পুলিশ তাদের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা ছিল ১০-১২ জন। কয়েকদিন প্রশিক্ষণ নেয়ার পর তারা চলে যান৷ অন্যদিকে ২৬শে মার্চের পর পার্বত্য অঞ্চলের জেলাপ্রশাসক এইচ টি ইমাম, অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক সৈয়দ আবদুস সামাদ, পুলিশ সুপার বজলুর রহমান এবং মহকুমা প্রশাসক এম আবদুল আলী স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের একত্রিত করে রাঙ্গামাটি স্টেশন ক্লাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এ প্রশিক্ষণে রাজস্থলীর মফিজ আহমদ তালুকদার (পিতা কানা মিয়া তালুকদার), সৈয়দ আহমদ ও ফিরোজ রশিদসহ কয়েকজন যুবক অংশ নেন। স্টেশন ক্লাবে কাঠের তৈরি বন্দুক দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। কিছুদিন পর তাঁদের খাগড়াছড়ির দিকে চলে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। খাগড়াছড়িতে রণবিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, দিদারুল আলম, আহমদ সৈয়দ, মোখলেছুর রহমান ও বেশ কয়েকজন হিন্দু যুবক ছিলেন। রাঙ্গামাটির প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষাণার্থী আবদুস শুক্কুর, এস এম শফি, কামাল ও আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে রাজস্থলীর ফিরোজ রশিদ, আবদুর রশিদ, সৈয়দ আহমদ ও মফিজও খাগড়াছড়ি চলে যান। তখন তারা সংখ্যায় ২৮ জন। সেখানে তাঁরা খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেন। এখান থেকে জেলাপ্রশাসক এইচ টি ইমাম ২০ জনের একটি দলকে সঙ্গে করে সীমান্তবর্তী রামগড়ে চলে যান। এ দলে ছিলেন ফিরোজ রশিদ, শফি, কামাল ও আবদুস শুক্কুর। এঁরা ছিলেন রাঙ্গামাটি এলাকার। ভারতে ট্রেনিং শেষে এঁরা রাঙ্গামাটিতে ফিরে এলে পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন এবং তাঁদের হত্যা করা হয়। আহমদ সৈয়দ, মফিজ প্রমুখ কয়েকজন বয়সে ছোট ছিল বলে তারা খাগড়াছড়িতে থেকে যান এবং পরে তাদের রামগড় ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মফিজ, সৈয়দ আহমদ ও মোখলেছুর রহমান শিক্ষিত হওয়ায় তাদের ওয়ারলেস অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিছুদিন পর সেখান থেকে কয়েকজন ভারতে চলে যান এবং আহমদ সৈয়দ ও মফিজকে মানিকছড়ির রাজবাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে দুমাস থাকার পর তাঁরা রাজস্থলীতে ফিরে আসেন।
বান্দরবানের রাজবিলা ক্যাম্পে ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধারা থাকতেন। রাজবিলার স্থানীয় বাঙালিরা চাঁদা তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াত। এখানকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেকে রাজাকারদের সহযোগিতা করত।
মূলত রাজস্থলীর পার্শ্ববর্তী বান্দরবানের রাজবিলা ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা রাজস্থলীতে তাঁদের কার্যক্রম চালাতেন। এ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মতিন। তাঁর অধীনে রাজস্থলীসহ আশপাশের শতাধিক ইপিআর, পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় তার অধীনস্থ হেডম্যানদের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর হয়ে কাজ করার নির্দেশ দেয়। তার নির্দেশে সকল হেডম্যানকে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর প্রধান করা হয়। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর প্রধান হিসেবে ৩৩৩নং ঘিলাছড়ি মৌজার হেডম্যান রেকগুচি তঞ্চঙ্গ্যা তালুকদার, ২নং গাইন্দ্যার ৩২৮নং পোয়াতু মৌজার হেডম্যান বুইজ্জ্যা, ৩৩৪নং কুইজ্জ্যাছড়ি ও ৩৩৫নং ধনুছড়ি মৌজার হেডম্যান অং থৈয়াই প্রু প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধের প্রথম দিকে রাজস্থলীতে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের দৌরাত্ম্য ছিল। এ উপজেলায় সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে। তারা রাজস্থলী বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় (বর্তমানে রাজস্থলী বাজার মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়)-এ ক্যাম্প স্থাপন করে। তাদের সঙ্গে মিজোরাও ছিল। স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর লোকজন তাদের সহযোগিতা করত। রাজস্থলী দখলে নেয়ার পর অস্ত্রকাঁধে পাকসেনারা পেট্রল দিত। তারা হাতি দিয়ে মালামাল আনা- নেয়া করত। নৌপথেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আনা-নেয়া করত। তারা কাপ্তাই হ্রদের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করত। আখক্ষেতে ৪ জন পাকিস্তানিকে পুড়িয়ে হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রাজস্থলীতে এসেই পাকসেনারা তৎপর হয়ে ওঠে। রাজাকাররা স্বাধীনতার সমর্থক আহমদ মিয়াকে পাকসেনাদের হাতে ধরিয়ে দেয়। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে পাকসেনারা বাজারের বটতলায় তাঁর দোকানের পাশে কবর খোঁড়ে। কিন্তু স্থানীয় মসজিদের একজন ইমামের হস্তক্ষেপে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এরপরেও স্থানীয় রাজাকাররা পাকসেনাদের নিয়ে আহমদ মিয়ার বাড়িতে বেশ কয়েকবার হামলা চালায়। একদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাকারদের সঙ্গে করে নিয়ে এসে আহমদ মিয়ার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। সেদিনও ঘটনার কিছু আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি ও বাড়ির অন্যরা প্রাণে রক্ষা পান। অন্য একদিন পাকসেনারা আহমদ মিয়া ও রাজেন্দ্র কর্মকারসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে তাদের বেদম প্রহার করা হয়। পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। স্থানীয় রাজাকারদের মধ্যে মমি মার্মা, কেতি মার্মা, কেলাচি মার্মা, মনিয়ম মার্মা, চাইচং মার্মা ও দাঁতভাঙ্গা মার্মা ছিল উল্লেখযোগ্য। চাকমা ও মার্মা মিলে ৩০-৩৫ জন রাজাকার ছিল। এরা অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করত এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক মালপত্র নিয়ে যেত। শরণার্থীদের পথ আটকে তাদের মালামাল লুট করত। পাকসেনারা রাজস্থলী বাজারে আসার পর তাদের দৌরাত্ম্য আরো বেড়ে যায়। তারা স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের দেখিয়ে দিত এবং ক্যাম্পে ধরে এনে পাকসেনাদের দ্বারা নির্যাতন করাত। রাঙ্গামাটিরবালুখালীতে গাইন্দ্যা ভান্তে নামে পাকবাহিনীর এক দোসর ছিল। সে ‘মেজর ভান্তে’ নামে পরিচিত ছিল।
আগস্ট মাসের দিকে মুক্তিযোদ্ধা মফিজ ও ফিরোজ রাজস্থলীতে এসে জানতে পারেন যে, এখানকার যেসব যুবক রাঙ্গামাটিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, পাকসেনারা তাদের তালিকা করছে। এতে সহযোগিতা করছে স্থানীয় রাজাকাররা। তাই তাঁরা ঘর থেকে বের হতে পারছিলেন না, আবার রাঙ্গামাটিও ফিরে যেতে পারছিলেন না। রাঙ্গামাটি গেলেও বিপদ, কারণ সেখানকার বিহারি আকবর আলী খান ছিল মফিজের পরিচিত। তার চাচা সোলায়মান মেম্বার ছিল কুখ্যাত রাজাকার। তারা পাকসেনাদের কাছে তাঁদের নাম বলে দিতে পারে। এসব চিন্তা করে তাঁরা রাজস্থলীতেই থেকে যান। সেপ্টেম্বরের দিকে মিজোরা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় হাজীপাড়া থেকে ৭-৮ জন এবং তালুকদার পাড়া থেকে মফিজ তালুকদারসহ ৪ জনকে ধরে পাকসেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। হাজীপাড়া থেকে যাদের ধরা হয় তাদের অনেক মারধর করা হয়। হানাদাররা ক্যাম্পের একটি কক্ষে তাদের বেঁধে রাখে। পরে তারা ছাড়া পায়।
স্থানীয় রাজাকাররা উপজেলার ধনী ব্যক্তি, বাঙালি ব্যবসায়ী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক এবং হিন্দুদের তালিকা তৈরি করে। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে এক বিহারি হাবিলদার স্থানীয় কয়েকজন রাজাকারসহ তালুকদার পাড়ার ব্যবসায়ী কানা মিয়ার কাছে ২৫০ টাকা চাঁদা দাবি করে। অনেক অনুনয়- বিনয়ের পর ১৫০ টাকা দিয়ে তিনি তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পান।
রাজস্থলী বাজারের আশপাশের স্থান থেকে মালামাল নিয়ে ব্যবসায়ীরা এখানে আসতেন। একদিন হাটের সময় রাজাকাররা চন্দ্রঘোনার ব্যবসায়ী মিলন দত্ত, বাজারের দোকানদার কিয়ামং মার্মা, মলার বাবা, হাজীপাড়ার আবুল বাশার সওদাগর ও নুরুন্নবীসহ ৭-৮ জনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের কাপ্তাইয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারি কর্মকর্তা ছগির আহমদ তালুকদার তখন রাঙ্গামাটি কোতয়ালি থানায় কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি কাপ্তাইয়ে যোগাযোগ করে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। এভাবে যতবারই পাকসেনারা রাজস্থলী উপজেলা ও রাঙ্গামাটির স্থানীয় লোকদের ধরে নিয়ে যেত, ততবারই তিনি তাদের ছাড়িয়ে আনতেন এবং সাধ্যমতো সহযোগিতা করতেন। তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন খবরাখবর দিতেন। কোথায় কখন পাকসেনাদের অপারেশন হবে এ খবর তিনি পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিতেন। এ কারণে রাজস্থলী উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের কোনোরূপ সমস্যায় পড়তে হয়নি। কাপ্তাই-চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত পাকসেনা ও রাজাকাররা রাজস্থলীর সীমান্তের লোকজনদের নির্যাতন করত। পাকসেনারা কাপ্তাই খালের পাড়ে ব্যবসায়ী মো. সোলায়মানকে গুলি করে হত্যা করে।
রাজস্থলী বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় (বর্তমানে রাজস্থলী বাজার মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়)-এ পাকসেনাদের ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন ও সন্দেহভাজনদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। এরপর কাউকে-কাউকে ছেড়ে দিত আবার অনেককে কাপ্তাই ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিত। সেপ্টেম্বর মাসে ইপিআর কমান্ডার খালেক কাপ্তাই থেকে রাজস্থলী আসার পথে ইপিআর ও পুলিশ সদস্যসহ একদল মুক্তিযোদ্ধাও তাঁর সঙ্গে আসেন। মুক্তিযোদ্ধা দলটি বাঙ্গালহালিয়ায় অবস্থান নেয়। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন ১০-১২ জন। বাঙ্গালহালিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা জানতে পেরে পার্শ্ববর্তী রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সুখবিলাস থেকে রাজাকাররা সেদিকে আসতে থাকে। বিষয়টি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে বাঙ্গালহালিয়ায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা দলটি জানতে পারে। ফলে উভয় দল মিলে রাজাকারদের দিকে এগিয়ে যায় এবং সুখবিলাস নামক স্থানে রাজাকারদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে ছয়জন রাজাকার নিহত হয়। এদিকে কমান্ডার আবদুল খালেক স্ত্রী-সন্তানসহ রাজস্থলীতে এসে রাজস্থলী বাজারের দিনমজুর ওমদা মিয়ার ঘরে আশ্রয় নেন। মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁর সঙ্গে খালেকের পূর্বপরিচয় ছিল। তখন সন্ধ্যা ৭টা হবে। খালেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ফিরোজ নিজ অবস্থানে ফিরে আসেন। এর পাঁচ মিনিট পরেই শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি এমন সময় পাশের এলাকার ছখিনার পিতা দৌড়ে মফিজদের বাড়ি এসে জানান যে, বাজারে ব্রাশ ফায়ার হচ্ছে। স্থানীয় কিছু যুবক পাহারা বসায়। কিন্তু তারা ছিল নিরস্ত্র। তাই বিপদের কথা ভেবে মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ ও মফিজ যুবকদের নিয়ে জঙ্গলে চলে যান এবং সেদিন জঙ্গলেই রাত কাটান। ঐদিনের গোলাগুলির কারণ ছিল রাজাকাররা ইপিআর কমান্ডার খালেকের সপরিবারে রাজস্থলী বাজারে এসে আশ্রয় গ্রহণের খবর পাকসেনাদের জানিয়ে দিয়েছিল। তখন তারা এসে ওমদা মিয়ার ঘর ঘেরাও করে এবং জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে বোমা নিক্ষেপ করে। কিন্তু বোমাটি বিস্ফোরিত হয়নি। সঙ্গে-সঙ্গে কমান্ডার খালেক রাইফেল নিয়ে দৌড়ে বাইরে এসে ফায়ার শুরু করেন। পাকসেনারা ব্রাশ ফায়ার করে। খালেক গুলি করতে-করতে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে খালেক এবং রাজস্থলীতে আশ্রয় নেয়া আরেক ইপিআর সদস্য সিরাজুল ইসলাম ভারতে চলে যান। এদিকে গোলাগুলির শব্দে খালেকের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাচ্ছিলেন। তার কোলে ছিল শিশুপুত্র রাসেল। গুলিতে খালেকের স্ত্রী মারা যান এবং রাসেলের ডানহাতে গুলি লাগে। পরের দিন স্থানীয় লোকজন খালেকের স্ত্রীকে উপজেলার কবরস্থানে দাফন করে। আর তাঁর শিশু পুত্র রাসেলকে লালন-পালন করার দায়িত্ব নেন সাবের আহমেদ নামে রাজস্থলী বাজারের এক বাসিন্দা। তিনি রাউজানের পাহাড়তলীর চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিয়নের চাকরি করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খালেক এসে তাঁর পুত্রকে নিয়ে যান।
৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমান বাহিনী সীমান্তবর্তী ভারতের কয়েকটি বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করলে ভারত সরাসরি পাকস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ঘটতে থাকে। স্থানীয় রাজাকাররা গা-ঢাকা দেয়। ৮ই ডিসেম্বর রাজস্থলী থেকে সব পাকসেনা চলে যায় এবং এদিনই উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
গাইন্দ্যা ইউনিয়নের ৪নং এলাকার একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধা সড়ক’। [ইয়াছিন রানা সোহেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড