You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজাকার বাহিনী - সংগ্রামের নোটবুক

রাজাকার বাহিনী

‘রেজাকার’ ফারসি শব্দ যার অর্থ ‘স্বেচ্ছাসেবক’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৭১-এর মে মাসে জামায়াতে ইসলামী দলের নেতা মাওলানা এ কে এম ইউসুফ খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন ও তাদের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং মুক্তিকামী মানুষদের দমন ও হত্যা করা ছিল রাজাকারদের কাজ। এছাড়া, ‘পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে স্থানীয় জনগণ রয়েছে’ এমন একটি ধারণা দেয়াও ছিল রাজাকার বাহিনী গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় শোচনীয়ভাবে পরাজিত জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, ডানপন্থী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা ও অনুসারী এবং মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতাদানে গঠিত তথাকথিত শান্তি কমিটির লোকজনের সমন্বয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এসব দল ও সংগঠনের ৯৬ জন ক্যাডার নিয়ে রাজাকার বাহিনীর যাত্রা শুরু। এর প্রধান নিযুক্ত হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা মোহাম্মদ ইউনুস। ছাত্র সংঘ ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিল। ইসলামী ছাত্র সংঘের জেলা প্রধানরা নিজ-নিজ জেলায় রাজাকার বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হয়েছিল। হেডকোয়ার্টার্স ছিল খুলনা শহরের খান জাহান আলী সড়কে অবস্থিত ভূতেরবাড়ি আনসার ক্যাম্প।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম আনসার বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। সেটি ছিল ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত। ১৯৭১ সালে এ বাহিনীর অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন বিধায় পাকিস্তানি শাসকরা বাকিদের ওপর আস্থা রাখতে পারছিল না। এমতাবস্থায়, আনসার বাহিনী বাতিল করে পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালে সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগী শক্তি (Auxiliary Force) হিসেবে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। জামায়াতে ইসলামী ও শান্তি কমিটির শীর্ষ নেতাদের আবেদন ও দেনদরবারের পরিপ্রেক্ষিতে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র গভর্নর ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খান ২৮শে মে ১৯৭১ ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স’ জারি করে। এ অর্ডিন্যান্সবলে ১৯৫৮ সালের ‘আনসার এ্যাক্ট’ বাতিল ও ‘আনসার বাহিনী’ বিলুপ্ত করা হয় এবং আনসার বাহিনীর সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, মূলধন ও দায় এবং রেকর্ডপত্র রাজাকার বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। যেসব আনসার এডজুটেন্ড মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি, তাদের রাজাকার এডজুটেন্ড হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। রাজাকার বাহিনীকে আনসার বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত করে এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয় ২রা আগস্ট ১৯৭১, আর ঐ বছরের ৭ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীকে সরাসরি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অধীনে ন্যস্ত করা হয়।
রাজাকার বাহিনীতে তিন ধরনের লোকজন অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। প্রথমত, যারা পাকিস্তান ও ইসলামকে রক্ষার নামে দেশের মানুষকে হত্যা ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধাচরণ করাকে কর্তব্য মনে করছিল; দ্বিতীয়ত, যুদ্ধকালীন সময়ে লুটপাট ও নারী-নির্যাতনের সুযোগ যারা নিয়েছিল; তৃতীয়ত, গ্রামের দরিদ্র মানুষ যারা সীমান্তের ওপারে যেতে পারছিল না, তাদের অনেকের ওপর বলপ্রয়োগ করে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে বা প্রলুব্ধ করে রাজাকার বাহিনীতে যুক্ত করা হয়েছিল।
৯৬ জন ক্যাডার নিয়ে রাজাকার বাহিনীর যাত্রা শুরু হলেও জুলাই মাস নাগাদ রাজাকারের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার, যদিও ঐ সময়ের মধ্যে ভারত থেকে স্বল্প প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ হাজার। ঐ বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ রাজাকারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ হাজার, অক্টোবরে তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫৫ হাজার। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশের গ্রামগঞ্জে রাজাকার বাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিল, সেজন্য ‘রাজাকার’ শব্দটি সকলের কাছে খুব দ্রুত পরিচিত হয়ে ওঠে।
রাজাকার বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে পাকিস্তানপন্থী ও ‘ইসলাম’-এর ধ্বজাধারী দলগুলোর ‘মতাদর্শিক উদ্দীপনা’ ছাড়াও অন্যান্য যেসব আকর্ষণ ছিল, তা হলো— নিয়মিত ভাতা ও রেশন; স্থানীয় ক্ষমতার ব্যবহার; আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী কর্মী-সমর্থক, স্বাধীনতাপন্থী মানুষজন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা ও তাদের ঘরবাড়ি ও বিষয়- সম্পত্তি, ধান-চাল-দোকানপাট লুটপাট ও ভোগদখলের অবাধ সুযোগ। এমনকি পারিবারিক শত্রুতার প্রতিশোধ নিতেও গ্রামের মানুষজনকে তারা হত্যা করেছে। এছাড়া অস্ত্রশস্ত্রের সুবিধা ছিল, দ্রুত চলাচলের যানবাহন ছিল এবং সহজে তারা তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের বেকায়দায় ফেলতে পারত। মূলত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নির্বিঘ্ন চলাচলের ব্যবস্থা করা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি ও অবস্থানের বিষয়ে খবরাখবর রাখার ব্যাপারে রাজাকারদের কাজে লাগানো হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান-এর সংগঠক সেলিম মানসুর খালেদ কর্তৃক উর্দু ভাষায় লিখিত ও লাহোর থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ আলবদর থেকে রাজাকার প্রসঙ্গে জানা যায়। তাতে বলা হয়েছে, রাজাকারদের কাজ ছিল পুলিশের সহায়তায় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিহত করা, সেতু পাহারা দেয়া ইত্যাদি। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর আওতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলেও প্রথম দিকে তারা প্রধানত শহর এলাকা এবং সেনা ক্যাম্পের আশপাশের অঞ্চলে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও নিপীড়ন চালাত। তাদের হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন ও ধ্বংসলীলা গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে স্থানীয় পর্যায়ের লোকজন নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠিত হওয়ার পর। রাজাকাররা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে রাস্তাঘাট ও জনপদ চিনিয়ে দিয়ে শহরের পাশাপাশি মফস্বল এলাকা ও গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক গণহত্যা পরিচালনা ও পাকিস্তানি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে এবং ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসাত্মক কাজে যুক্ত থাকে। এভাবে দেশকে ও মানুষজনের জীবনকে তারা চরম নিরাপত্তাহীন করে তোলে।
রাজাকারদের সামরিক প্রশিক্ষণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো। ঢাকা শহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম ও কলাভবন সংলগ্ন মাঠ এবং মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ মাঠ ছিল রাজাকারদের প্রধান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল দেড় থেকে দুই সপ্তাহ। প্রশিক্ষণ শেষে রাজাকারদের হাতে থ্রি- নট-থ্রি রাইফেল তুলে দেয়া হতো। এছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সার্টিফিকেট ও ব্যাজ প্রদান করা হতো।
রাজাকার হাইকমান্ড : ১. এ এস এম জহুরুল হক (ডাইরেক্টর), ২. মফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া (এসিসটেন্ট ডাইরেক্টর), ৩. এম আই মির্ধা, তমঘা-ই-খিদমত (এসিসটেন্ট ডাইরেক্টর), ৪. এম এ হাসনাত (এসিসটেন্ট ডাইরেক্টর, সেন্ট্রাল রেঞ্জ), ৫. ফরিদ আহাম্মদ (ঢাকা শহর এডজুটেন্ট), ৬. মোহাম্মদ ইউনুছ (কমান্ডার-ইন-চিফ) ও ৭. মীর কাসেম আলী (চট্টগ্রাম কমিটির প্রধান)
রাজাকার ক্যাম্পগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীর জাঁদরেল অফিসাররা নিয়মিতভাবে যাতায়াত করত এবং অপারেশনের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করত। খুলনায় রাজাকার হেডকোয়ার্টার্স (ভূতেরবাড়ি আনসার ক্যাম্প) ছিল তাদের প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র। এছাড়া, প্রথম পর্যায়েই খুলনার শিপইয়ার্ড ও খালিসপুরে রাজাকার ক্যাম্প গঠন করা হয়েছিল। ঢাকার বৃহত্তম রাজাকার ক্যাম্পটি ছিল নবাবপুরের বিসিসি রোডের একটি বাড়িতে। লোকজন ধরে এনে জবাই করে ঠাটারীবাজার মৎস্যপট্টির পেছনে লাশ ফেলে দিত। সেখানে একটি বধ্যভূমি রয়েছে।
রাজাকার বাহিনী খুলনায় যে ব্যাপক নৃশংসতা চালিয়েছিল, তার চিহ্ন ঐ অঞ্চলের প্রচুর সংখ্যক পরিবার এখনো বহন করে চলছে। মাওলানা এ কে এম ইউসুফ ছাড়াও মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর- ছিল রাজাকার বাহিনীর অন্যতম সংগঠক। জামায়াত-মুসলিম লীগের লোকজন রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে সারাদেশে ধর্ষণ, লুণ্ঠন, জ্বালাও- পোড়াও ও ধ্বংসের মহাযজ্ঞ চালায়। যশোর রোডের পার্শ্ববর্তী খুলনার গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকা দৌলতপুর ও শিরোমনিতে রাজাকারদের উদ্যোগে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছিল। শিরোমনিতে বাদামতলার কাছে মে মাসের শেষদিকে ১৫ জন পানচাষি মাথায় পানের বোঝা নিয়ে হাটে যাচ্ছিল, যারা ছিল বারুই সম্প্রদায়ের লোক। স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে জানায়, ‘এরা হিন্দু, এরা পাকিস্তানের শত্রু, অতএব এদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই’। দখলদার বাহিনী তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। সঙ্গে-সঙ্গে ১৩ জন শহীদ হন। দুজন আহত অবস্থায় ‘জল’ ‘জল’ বলে চিৎকার করতে থাকে। এ ধরনের অসংখ্য গণহত্যা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রয়েছে। শারীরিক নির্যাতন ও অত্যাচার করে রাজাকাররা অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে। খুলনার খালিশপুরে ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত চরেরহাটের হত্যাকাণ্ড বা মুন্সিবাড়ীর হত্যাকাণ্ড ৭১-এ খুলনায় রাজাকারদের বীভৎসতার দুএকটি ঘটনামাত্র। খুলনার চুকনগর গণহত্যা ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে অন্যতম বৃহৎ ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড, যাতে অন্তত ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। ভারত গমনের পথে এখানে সাময়িকভাবে অবস্থান নেয়া মানুষজনের খবর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছানোর কাজটা রাজাকাররাই করেছিল। যশোর- খুলনা মহাসড়ক শ্রমিকদের প্রধান সংগঠক ছিলেন ফুলতলার শেখ মোহাম্মদ রফি। তিনি অত্র এলাকায় ৭১-এ পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধের মূল সংগঠকও ছিলেন। সুলতান মল্লিকের নেতৃত্বে রাজাকাররা তাকে আটক করে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। নদীর ঘাটে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যার পর রাজাকাররা তার লাশ থেকে মাথা আলাদা করে ৬-৭ দিন যশোর-খুলনা সড়কের ফুলতলা মোড়ে রাস্তায় মাথা ঝুলিয়ে রাখে। এমন বিকৃত-বীভৎস ছিল রাজাকারদের অত্যাচারের নমুনা।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে রাজাকাররা যেসব যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেছিল, তার প্রমাণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি প্রকাশিত গোপন দলিলেও মেলে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি)-র উপ-প্রশাসক ১৯৭১ সালের ৫ই ডিসেম্বরের গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘কাউকে বাঁচিয়ে রাখা হবে নাকি মেরে ফেলা হবে, সে সিদ্ধান্ত রাজাকাররা নিজেরাই নিতে সক্ষম। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর তারা নির্বিঘ্নে অত্যাচার চালায়, লুটপাট করে। গ্রামাঞ্চলে তারা রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সেনাবাহিনী তাদের বাঁধা দেয় না।’ মাগুরার স্কুল শিক্ষিকা ও বামপন্থী সংগঠক লুৎফুন নাহার হেলেন—কে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অভিযোগে দলবল নিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যায় রাজাকার রেজাউল করিম ওরফে রিজু ও তার সহযোগী হাসান কবির। হেলেনের শিশু সন্তানটির বয়স তখন মাত্র দুবছর। রাজাকার রিজু তাঁকে পাকিস্তানি সেনা কমান্ডারের হাতে তুলে দেয়। সেখানে তিনি চরমভাবে অত্যাচারিত হন। এরপর হেলেনকে সামরিক জিপের পেছনে রশি দিয়ে বেঁধে সারা শহরে টেনে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এরপর হেলেনের মৃতদেহ পার্শ্ববর্তী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এভাবে মাগুরায় ১৩৬৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল রিজু রাজাকার ও তার বাহিনী।
জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম ‘রাজাকার বাহিনীর কৃতিত্ব’ শিরোনামে প্রকাশিত (১০ই আগস্ট ১৯৭১) প্রতিবেদনে এ বাহিনীর সাফল্যের প্রশংসা করে এবং এ বাহিনীর ব্যাপ্তি ও শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য শান্তি কমিটি ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানায়। প্রতিবেদনে মুক্তিবাহিনীকে ‘আগ্নেয়াস্ত্রধারী ডাকাত’ ও ‘ভারতীয় দালাল’ আখ্যা দিয়ে বলা হয় যে, ‘প্রদেশে’র বিভিন্ন অঞ্চলে রাজাকার বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্রধারী ডাকাত ও ভারতীয় দালালদের বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছে এবং এভাবে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র প্রতিটি ইউনিয়নে রাজাকার বাহিনী গঠিত হলে ‘প্রদেশে’র যোগাযোগ সেতু ও স্বাভাবিকতা বিনষ্টের ‘সকল ভারতীয় চক্রান্ত’ ব্যর্থ হতে বাধ্য। ঐ একই পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় রাজাকারদের ‘সফল অভিযানে’ দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার বিবরণ প্রকাশিত হয়। এমনকি ৭১-এর ডিসেম্বর মাসে অবধারিত পরাজয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও গোলাম আযম ‘পূর্ব পাকিস্তানিদের ওপর আস্থা স্থাপনের আবেদন’ জানায় এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতকে আঘাত করার ও, তার ভাষায়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র সকল ‘দেশপ্রেমিক’, শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার এবং আলবদর ও আলশামসদের উন্নত মানের ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত করার আহ্বান জানায় (দৈনিক আজাদ, ২রা ডিসেম্বর ১৯৭১)।
১৯৭১ সালে অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, নারীধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধকর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রাজাকারদের নাম। পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে যে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছিল, ঐ বাহিনী আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-র ৩ (২) ধারার সংজ্ঞা অনুযায়ী যাবতীয় অপরাধ সংগঠনে যুক্ত ছিল। রাজাকাররা বাংলাদেশ ও দেশের মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছিল, তা আজো দেশের মানুষ বিস্মৃত হয়নি, মনে রেখেছে, ঘৃণাভরে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এ দেশীয় এসব দালাল- সহযোগীদের শুধু তাই নয়, অনেক স্থানে তাদের লাশ পর্যন্ত ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা মাটিতে কবর না দেয়ার জন্য সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ৭৫-পরবর্তী জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনাসলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক রেজাউল করিম ওরফে রিজু (মাগুরার কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার ও লুৎফুন নাহার হেলেনসহ অসংখ্য হত্যার জন্য দায়ী) ২০০৭ সালে মারা যায়। তাঁর লাশ মাগুরায় কবর দিতে চাইলে সেখানকার জনগণ এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে সেখানে দাফন করতে না পেরে তার লাশ নেয়া হয় শ্বশুরবাড়ি ফেনীতে এবং দ্রুত সেখানে কবর দেয়া হয়। খবরটি জানাজানি হলে ফেনীবাসীর অনেকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং লাশ প্রতাহারের জন্য আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন।
এভাবেই রাজাকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মতিউর রহমান নিজামী (হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালসের বিচারিক রায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)-এর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার লোকজন তার নাম দিয়েছিল ‘মইত্যা রাজাকার’। ৭১-এ চট্টগ্রাম জুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালসের বিচারিক রায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)। তখন তার পরিচয় ছিল খোকন রাজাকার নামে। মানুষ হত্যা, স্বাধীনতাপন্থী ও হিন্দুদের ঘরবাড়ি পোড়ানো ও লুটপাট, জল্লাদখানা তৈরি, নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যাসহ তার বিরুদ্ধে ছিল অসংখ্য অভিযোগ। দেশ স্বাধীনের পরে রাজাকার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাউজান থানায় মামলা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালসের দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন রাজাকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে এবং আরো অনেকের বিচার চলছে। [মেসবাহ কামাল ও জান্নাত-এ-ফেরদৌসী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড