রাজাকার মঞ্জিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর)
রাজাকার মঞ্জিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদাররা এখানে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিভিন্ন হিন্দু মন্দির ও নির্দশনগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল। শ্রীশ্রী আন্দময়ী কালীবাড়িতে স্থাপন করা হয়েছিল রাজাকার ক্যাম্প। বাড়িটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয়েছিল ‘রাজাকার মঞ্জিল’। বাড়ির ফটকে যেখানে পাথরে খোদাই করে নাম লেখা ছিল ‘শ্রীশ্রী আন্দময়ী কালীবাড়ি’, তা ভেঙে সেখানে বাংলা ও উর্দু হরফে লেখা হয়েছিল ‘রাজাকার মঞ্জিল, রহমানবাড়ি’। এমনকি ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামটিও পরিবর্তন করে ‘রহমানবাড়ি’ করা হয়েছিল। মেড্ডাস্থ কালভৈরব মূর্তি এবং মন্দির ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সর্বত্র হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরগুলো রাজাকার এবং শান্তি কমিটি-র সদস্যরা লুট করে নিয়েছিল। বড়বড় বাজারে হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও তারা দখল করে নিয়েছিল। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন শ্রীশ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়িটি দখল করে ওখানেই স্থাপন করা হয়েছিল ‘রাজাকার মঞ্জিল’। রাজাকাররা সন্দেহজনক লোকজনকে ধরে এনে রাজাকার মঞ্জিলে আটকে রেখে দিনের পর দিন অত্যাচার করেছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেও এখানে আটকে রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
২৪শে অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নন্দনপুর এলাকায় সংঘটিত যুদ্ধে আহত ভৈরব বাজারের মুক্তিযোদ্ধা আশুরঞ্জন দে-কে রাজাকার মঞ্জিলে আটকে রেখে তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা প্রতিদিন তাঁকে লাঠিপেটা করেছে। পাঁচদিন পর্যন্ত আশুরঞ্জনকে রাজাকার মঞ্জিলে আটক রাখা হয়। এ-সময় তাঁকে কোনো খাবার দেয়া হয়নি। তাঁর পায়ের ক্ষতস্থান থেকে অবিরাম রক্ত পড়েছে। চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়নি। আশুরঞ্জন পানি পান করতে চাইলে একজন রাজাকার পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থেকে রসিকতা করেছে। অন্য একজন আশুর মুখের দিকে প্রস্রাব করে ‘পানি খেতে’ বলেছে। এমনিভাবে তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। শান্তি কমিটির সদস্যরা আশুরঞ্জনের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গোপন তথ্য জানতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি একটি কথারও জবাব দেননি। তাঁকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে বলা হয়েছে। তিনি চিৎকার করে বলেছেন ‘জয় বাংলা’। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তিনি আরো বলেছেন, ‘মরণে আমার কোনো ভয় নেই … স্বাধীনতা মন্ত্রে আমরা দীক্ষিত। আমার রক্ত যেখানে পড়েছে, সে স্থান পবিত্র …সে স্থান স্বাধীন হবেই। ২৮শে অক্টোবর শেষরাতে আশুরঞ্জন দে-কে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দক্ষিণ পাশে কুরুলিয়া খালে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাজাকার মঞ্জিলে এমনিভাবে দিনের পর দিন নির্যাতন ও অত্যাচার চালানো হয়েছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ এখানে বন্দি ছিলেন। [জয়দুল হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড