You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজাপুর গণহত্যা (শরণখোলা, বাগেরহাট)

রাজাপুর গণহত্যা (শরণখোলা, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ১৩ই নভেম্বর। এতে ২০-৩০ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
বাগেরহাট জেলার শরণখোলা থানা সদরের রায়েন্দা বাজারে মাওলানা এ কে এম ইউসুফের নিয়ন্ত্রণাধীন রাজাকার বাহিনী ক্যাম্প গঠন করার পর থেকে এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের তাণ্ডব বৃদ্ধি পায়। রাজাকাররা তার নির্দেশে বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগ-এর সমর্থক ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড শুরু করে।
রাজাপুর শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গ্রাম। গ্রামটি ‘বড় রাজাপুর’, ‘ছোট রাজাপুর’, ‘উত্তর রাজপুর’, ‘দক্ষিণ রাজপুর’ এরূপ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। গ্রামটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এবং ভোলা নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত। নদীর পশ্চিম তীরে সুন্দরবনের বিশাল ও গভীর অরণ্য। সুন্দরবন জুড়ে সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি ছিল। রাজাপুর গ্রামে তখন একটি ছোট হাট (বাজার) ছিল, যেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতেন। ১৩ই নভেম্বর ভোরে রায়েন্দা বাজার থেকে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শতাধিক সদস্যের একটি দল বৃহত্তর রাজাপুর গ্রামে হানা দেয়। তারা বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীদের নির্যাতন করে। এদিন তাদের গুলিতে ২০-৩০ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। রাজাকারদের একটি দল প্রথমে রাজাপুর গ্রাম থেকে নুরুজ্জামান আকন (পিতা আ. গণি আকন; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র), মোজাম্মেল হক আকন (পিতা কাসেম আলী আকন), আ. গণি আকন (পিতা ছবেদ আলী আকন), সেকেন্দার আলী খাঁ, মো. কাসেম হাওলাদার প্রমুখকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে ওয়াপদা রাস্তার ওপরে নিয়ে যায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা ভোলা নদীর পশ্চিম পাড় ও সুন্দরবনের ভেতর থেকে রাজাকারদের উদ্দেশ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। গুলির শব্দে রাজাকারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা বেঁধে আনা লোকদের দ্রুত গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
এ হত্যাকাণ্ডের পর ভোলা নদী পাড় হয়ে সুন্দরবন থেকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সুবেদার আ. গফ্ফারের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজাপুর এলাকায় আসে। মুক্তিযোদ্ধারা নিহতদের কবর দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এ সময় সুবেদার আ. গফ্ফারের সঙ্গী অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন- ইউসুফ আলী শিকদার, হারুন-অর রশিদ, ইস্কান্দার, আ. রব ধলু, আবু হানিফ মোল্লা, চাঁন মিয়া, আ. মমিন জোমাদ্দার, সামছু মুন্সী, রাঙ্গা ইউসুফ, আ. রশিদ, মো. ইসমাইল খান, আ. মালেক জোমাদ্দার, আ. খালেক বেপারী প্রমুখ। রাজাকারদের অন্য একটি দল আমড়াগাছিয়া-নলবুনিয়া হয়ে ছুটু খাঁ-র বাজার দিয়ে রাজাপুরের পথে ছিল। ধানসাগরের দিক দিয়ে উত্তর রাজাপুরের মধ্য দিয়ে শ্রীপুর নামে একটি খাল আঠারোগাঁতি খালে মিশেছে। এখানে ভাণ্ডারিয়া ও রাজাপুরের ৮ জন কৃষক নৌকায় ধান বোঝাই করে শ্রীপুর খাল দিয়ে রায়েন্দার দিকে যাচ্ছিলেন। কৃষকদের ৭ জন ছিলেন ভাণ্ডারিয়ার ও অন্য জন রাজাপুরের। রাজাকাররা ৮ জনের সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। ভাণ্ডারিয়ার নিহত কৃষকদের মধ্যে ৫ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- আবুল হাসেম তালুকদার, কেরামত শিকদার, হারুন হাওলাদার, আ. লতিফ ও হাসেম খান। এখানে রাজাপুরের নেছার উদ্দিন নামে একজন নিহত হন। রাজাকাররা ফেরার পথে আমড়াগাছিয়ার গোপালচন্দ্র নামে একজনকে হত্যা করে।
রাজাপুরে গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতনে হানাদার বাহিনীর সহযোগীদের মধ্যে ছিল রাজাকার আ. লতিফ পঞ্চায়েত, রফেজ পহলান, আ. আজিজ, লুৎফর, জহুর আলী, ক্বারী আ. খালেক, আ. হক আকন, মতি তালুকদার, জয়নাল, আ. হামিদ ফরাজী, তোফাজ্জেল আকন, দেলোয়ার, ইউসুফ আলী, এজাহার খাঁ প্রমুখ। [আবু জাফর জব্বার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!