You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা (চট্টগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা (চট্টগ্রাম)

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা (চট্টগ্রাম) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই রাঙ্গুনিয়ায় আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি আলোচিত হতে থাকে। এরপর ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপটে ২৭শে মার্চ ইছাখালীর বিআরডিবি ভবনে ছাত্র-যুবকদের উপস্থিতিতে রাঙ্গুনিয়া থানা আওয়ামী লীগ-এর সহ-সভাপতি নজীর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা খলিলুর রহমান চৌধুরী, নজির আহমদ চৌধুরী (শিলক), নুরুল হক চেয়ারম্যান (শিলক), ডা. আমির হোসেন (পারুয়া), প্রফেসর আব্দুল হাই (পারুয়া), ইফতেকার হোসেন (পারুয়া), ছৈয়দ আহমদ (লাইন্সম্যান ছৈয়দ) (রাজানগর), ডা. ছালেহ আহমদ সিকদার (মরিয়মনগর) প্রমুখ নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন। এঁদের তত্ত্বাবধানে সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে রাঙ্গুনিয়ার স্বাধীনতাকামী ছাত্র-যুবকসহ সর্বস্তরের জনগণ অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। রাঙ্গুনিয়ার খিলমোগল, পদুয়া, ছিপছড়ি, কাউখালী, সরফভাটা, পোমরা, বেতাগী, কোয়েপাড়া, রাঙ্গুনিয়া কলেজের পশ্চিম পার্শ্বে, কোদালা, শিলক ও উত্তর রাঙ্গুনিয়ার গোপন ঘাঁটিসমূহে বন্দুক, রাইফেল, ডামি রাইফেল ও এলএমজি সহযোগে প্রশিক্ষণ চলে। ইপিআর সুবেদার মেজর টি এম আলীর নেতৃত্বে একটি দল পদুয়ার গভীর অরণ্য ছিপছড়ির বাঙালি সেনাক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু করে। মো. নুরুল আলম (হোসনাবাদ), ছালেহ আহমদ, সেনাবাহিনীর ল্যান্স নায়েক আবুল হাশেম প্রমুখের নেতৃত্বে খিলমোগলের পূর্বপার্শ্বে নিশ্চিন্তপুরের গভীর জঙ্গলে, আলমের নেতৃত্বে ইছাখালী গোডাউনের পাহাড়ি এলাকায় এবং ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে বেতাগী পাহাড়ি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধারা খিলমোগল রসিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন এনে পদুয়ার গভীর অরণ্যে প্রচারপত্র ছাপিয়ে সর্বত্র বিলি করেন, যা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ অঞ্চলের তরুণ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছালেহ আহমদ, মোহাম্মদ ইউসুফ (স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এমপি) প্রমুখ এবং ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা ভারতে প্রশিক্ষণে অংশ নেন। তাছাড়া ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে এ এলাকার আরো অনেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এ উপজেলায় উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত আরো যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা হলেন- খোদা বক্স, আল্লা বক্স, কাশেম চিশতী, ইফতেখার হোসেন, স্বপন চৌধুরী- (কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ-এর প্রচার সম্পাদক; ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ-এর প্রস্তাব উত্থাপনকারী; মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), শচীন দেওয়ানজী, নুরুন্নবী (স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ), অশোক কারবারী, ন্যাপনেতা মিলন প্রবাস বড়ুয়া, আবুল হায়াত চৌধুরী, কমিউনিস্ট পার্টির আবদুস ছাত্তার (কৃষকনেতা) প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন করিম ও সুবেদার মেজর টি এম আলী (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ)।
পাকবাহিনী ১৪ই এপ্রিল রাঙ্গুনিয়ায় প্রবেশ করে প্রথমে রাঙ্গুনিয়া কলেজ এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে ইস্টার্ন কেমিক্যাল (ভবানী মিল), ধামাইর হাট উত্তর রাঙ্গুনিয়া কলেজ, রাজার Saved কোদালা চা বাগান, সরফভাটা ও চন্দ্রঘোনা মাদ্রাসার ক্যাম্প স্থাপন করে।
রাঙ্গুনিয়ায় পাকবাহিনীর সহায়তার জন্য রাজাকারসহ তিনশতাধিক স্বাধীনতাবিরোধী সক্রিয় ছিল। রাজাকারদের মধ্যে বেশি তৎপর ছিল হাফেজ চৌধুরী (পোমরা), কোববাদ চৌধুরী (রানীরহাট), মো. সৈয়দ (পারুয়া), ছৈয়দুল হক (বেতাগী), নুরুল আলম (চন্দ্রঘোনা), ইমাম শরীফ, মোহাম্মদ আলী (মরিয়মনগর), সোনা মিয়া (মরিয়মনগর), নুরুল ইসলাম (রাজানগরের ধামাইর হাট এলাকা), আবদুস সোবহান (হোচনাবাদ), সুলতান আহমেদ (নিশ্চিন্তাপুর), আব্দুস সালাম (খিলামোগল) প্রমুখ। রাঙ্গুনিয়ায় ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা মৌলানা শামসুল হক ও মৌলানা আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে আলশামস বাহিনী গড়ে ওঠে। মুসলিম লীগ-এর অধিকাংশ নেতা শান্তি কমিটিতে যোগ দেয়। এ তিন বাহিনীর সদস্য ও তাদের সহযোগীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে রাঙ্গুনিয়া কলেজ ক্যাম্পে নির্মমভাবে নির্যাতন করত, কখনো গুলি করে পাশের মুন্দরী খালে এবং কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দিত। তারা গানপাউডার দিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত।
রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগরে মোহাম্মদ শাহ ও আহম্মেদ শাহ নামে দুই ভাইকে পাকসেনারা স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীদের সহযোগিতায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। তারা কুলকুরমাই দুর্গাপুরে ৫ জন নিরীহ মানুষকে ধরে এনে কলেজ ক্যাম্পে হত্যা করে। ২১শে জুলাই পোমরায় মধুরাম তালুকদার পাড়া থেকে ১৫ জনকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে এবং গর্ত খুঁড়ে লাশগুলো কবর দেয়। এ ঘটনা পোমরা গণহত্যা নামে পরিচিত। ১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দবাড়ি, দুর্গাপুর হিন্দুপাড়া, মোগলের হাট হিন্দুপাড়া, সাবেক রাঙ্গুনিয়া, শান্তিনিকেতন, চন্দ্রঘোনা শ্যামাপাড়া ও ধামাইরহাট এলাকায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করে। তারা কোদালা চা বাগানের নিরীহ শ্রমিকদের ঘরবাড়িও পুড়িয়ে দেয়।
রাঙ্গুনিয়া কলেজ ক্যাম্প, ইস্টার্ন কেমিক্যাল (ভবানী মিল), উত্তর রাঙ্গুনিয়া কলেজ ক্যাম্প, ধামাইরহাট, রানিরহাট আর্মি ক্যাম্প ও চন্দ্রঘোনা মাদ্রাসা ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। এসব স্থানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরীহ লোকদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
রাঙ্গুনিয়ায় তিনটি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলে- চন্দ্রঘোনা বধ্যভূমি ও গণকবর, রাঙ্গুনিয়া কলেজ দীঘিরপাড় বধ্যভূমি ও গণকবর এবং পোমরা উচ্চ বিদ্যালয় বধ্যভূমি ও গণকবর। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা চন্দ্রঘোনা পাওয়ার স্টেশন ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবস্টেশন সংলগ্ন এলাকার আশপাশ থেকে বহু লোককে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে কবর দেয়। এছাড়া রাঙ্গুনিয়া কলেজের পশ্চিম দীঘির পাড়ে এবং পোমরা উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশেও অনেককে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয়।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে পোমরা গেরিলা যুদ্ধ, আগস্টের শেষে সুবেদার মেজর টি এম আলীর নেতৃত্বে রাঙ্গুনিয়া থানা অপারেশন ও নভেম্বেরের শেষে তাঁর নেতৃত্বে দশমাইল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এছাড়া নুরুল আলমের নেতৃত্বে হোসনাবাদ যুদ্ধ, পোমরা পাওয়ার লাইন অপারেশন, গুমাইবিলের বিদ্যুৎ টাওয়ার অপারেশন, কর্ণফুলী নদীতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর এম্বুশ, মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৭টি টাওয়ার অপারেশন রাণীরহাট ব্রিজ ধ্বংস ও মিলিশিয়া ক্যাম্প আক্রমণ পরিচালিত হয়। কমান্ডার নুরুল আলম ও কমান্ডার ছালেহ আহমদের যৌথ নেতৃত্বে সেপ্টেম্বর মাসে রাণীরহাট ইউনিয়ন রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও কমান্ডার অশোক মিত্র কারবারীর নেতৃত্বে ১৪ই ডিসেম্বর কোদালা চা বাগানে আর্মি ক্যাম্প আক্রমণ হয়। ১৪ই ডিসেম্বর রাঙ্গুনিয়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় চারশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা শহীদ হন তাঁরা হলেন- সুব্রত সাহা (পিতা কমল কৃষ্ণ সাহা, স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া), শঙ্কর শাহ রায় (পিতা অম্বিকা চরণ রায়, কসবা-কুমিল্লা), মো. নুরুন নবী (পিতা আব্দুস সাত্তার, খিলমোগল), সচিন্দ্র দেওয়ানজী (পিতা বিমল বিহারী দেওয়ানজী, দেওয়ানজীপাড়া), সালেহ আহম্মদ (পিতা নাজির আহম্মেদ, সৈয়দবাড়ি), আলী আকবর (পিতা সায়েদ হোসেন, সরফভাটা), আবুল হোসেন (পিতা আব্দুল জলিল, থিন সৌদিয়া), মফিজুর রহমান (পিতা একলাসুর রহমান, পোমরা), দুধু মিয়া (পিতা হাজী রাশেদ, পোমরা), হাবিবর রহমান (পিতা একলাসুর রহমান, পোমরা), সুবেদার মেজর টি এম আলী (ইপিআর সদস্য) এবং স্বপন চৌধুরী (ছাত্রনেতা)। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযোদ্ধা কুতুবউদ্দিন আবসার (পিতা মৌলভী সায়েদ হক, ডিংগেল নওগা) ১ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন এবং জুরাছড়ি ক্যাম্প যুদ্ধে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় শহীদ সালেহ আহম্মদের নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [সৈয়দ মনজুর মোরশেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড