রাজগঞ্জ যুদ্ধ (বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী)
রাজগঞ্জ যুদ্ধ (বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী) সংঘটিত হয় ২৬শে সেপ্টেম্বর। এতে ২৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। রাজগঞ্জ বাজারটি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলাধীন রাজগঞ্জ ইউনিয়নে অবস্থিত। এলাকাটি বেগমগঞ্জের আওতাধীন হলেও এটি নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদী থেকে মাত্র ৫ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত।
সেপ্টেম্বরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র ও দক্ষতায় অনেক সুসংগঠিত হয়ে ওঠেন। ইতোমধ্যে বহু মুক্তিযোদ্ধা উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। সেই সঙ্গে তাদের হাতে আসে ভারী অস্ত্র, গোলাবারুদসহ নানা সামরিক সরঞ্জাম।
২১শে সেপ্টেম্বর রাজগঞ্জ এলাকার ‘সি’ জোনের সুসংগঠিত মুক্তিযোদ্ধারা ৬টি দল নিয়ে রাজগঞ্জের চারদিকে পাকবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য ওঁৎ পেতে থাকেন। এ সময় রাজগঞ্জ বাজারে টেলিফোন একচেঞ্জ ছিল। রাজগঞ্জ বাজার থেকে টেলিফোনে মাইজদীর পিটিআই-তে অবস্থিত পাকবাহিনীর সেনা ঘাঁটিতে জানানো হয় যে, মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। ২৬শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি চলতে থাকে। হানাদার বাহিনী তখনো রাজগঞ্জে পৌছেনি। ঐদিনই গভীর রাতে জরুরি প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের ৫টি ট্রুপসকে প্রত্যাহার করে বিভিন্ন স্থানে অপারেশনের জন্য পাঠানো হয়। এ খবর পাকবাহিনী তাদের দালালদের মাধ্যমে জানতে পারে। এই সুযোগে পাকবাহিনী ২৬শে সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৩টার দিকে রাজগঞ্জ বাজারে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালায়। সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ কমান্ডার মো. হাসেমের নেতৃত্বে রাজগঞ্জে অবস্থান করছিল। একই সময়ে পাকবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রুপস নোয়াখালীর মাইজদী বাজার থেকে ছয়ানী রাস্তা দিয়ে রাজগঞ্জ অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল। তারা ২ ইঞ্চি মর্টার গান দিয়ে ফায়ার করতে-করতে এগুতে থাকে। এরই মধ্যে ছয়ানী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাজগঞ্জে এসে কমান্ডার হাসেমের দলের সঙ্গে যোগ দেয়।
পাকবাহিনী ইতোমধ্যে রাজগঞ্জ পৌঁছে যায়। শুরু হয় দুপক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। ট্রুপস কমান্ডার হাসেম-এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর মোকাবেলা করতে থাকেন। ২৭শে সেপ্টেম্বর সকাল ৭.৩০টা পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাকবাহিনীর ২৩ জন সেনাকে ঘটনাস্থলে হত্যা করতে সক্ষম হন। সম্মুখ যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে কমান্ডার হাসেমের সাহায্যকারীরা চাহিদা মোতাবেক গোলাবারুদ সরবরাহ করতে সুযোগ পাননি। গোলাবারুদের অভাবে তাঁরা কিছুক্ষণ নীরবে অবস্থান করেন। পাকবাহিনী এই নীরবতার কৌশল বুঝতে পেরে চারদিক থেকে কমান্ডার হাসেম ও তাঁর দলকে ঘিরে ফেলে। কমান্ডার হাসেমকে লক্ষ করে তারা গুলি করে এবং তিনি শহীদ হন। একই সময়ে পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধা সবুজ (পিতা ছিদ্দিক উল্যা, মান্দারী, লক্ষ্মীপুর) ও রবি (পিতা হরি মোহন সাহা, ভবানীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর)-কে ধরে ফেলে এবং তাঁদের মাইজদী জেনারেল হাসপাতালে অবস্থানরত পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। রাজগঞ্জের উত্তর দিকে বাবুপুর হয়ে হানাদার বাহিনীর যে ট্রুপস আক্রমণ চালায়, তারা মুক্তিযোদ্ধা গোলাম হায়দার এবং শফিকুর রহমানকে ধরে ফেলে। গোলাম হায়দারকে তারা গুলি করে হত্যা করে। সফিকুর রহমানকে মাইজদী পিটিআই ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এ সময় পাকবাহিনী ৬ জন সাধারণ মানুষকেও গুলি করে হত্যা করে। তাদের মাইজদী হাসপাতালের দিঘির পূর্বপাড়ে গণকবর দেয়া হয়। কমান্ডার হাসেমের লাশ এলাকাবাসী পরদিন তাঁর নিজ বাড়িতে দাফন করে। শহীদ গোলাম হায়দারের লাশ এলাকাবাসী বাবুপুর হাইস্কুলের পশ্চিম পাশে দাফন করে। [মো. ফখরুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড