You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে রাঙ্গাবালী উপজেলা (পটুয়াখালী)

রাঙ্গাবালী উপজেলা (পটুয়াখালী) বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে পটুয়াখালী জেলার নবগঠিত উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধকালে পটুয়াখালী জেলার একটি থানা ছিল গলাচিপা। রাঙ্গাবালীর তিনটি ইউনিয়ন, যথা বড় বাইশদিয়া, রাঙ্গাবালী ও মৌডুবি ছিল গলাচিপার অন্তর্গত। ১৯৮৩ সালে গলাচিপা উপজেলায় পরিণত হওয়ার পর রাঙ্গাবালী এ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১১ সালের ১৪ই মার্চ গলাচিপা থেকে আলাদা হয়ে রাঙ্গাবালী উপজেলার আত্মপ্রকাশ ঘটে। পূর্বের ৩টি ইউনিয়ন ভেঙ্গে ৫টি ইউনিয়ন করা হয়। সেগুলো হলো- রাঙ্গাবালী, বড় বাইশদিয়া, ছোট বাইশদিয়া, চর মোনতাজ ও চালিতাবুনিয়া। মূলত চারদিকে নদী বেষ্টিত এ উপজেলাটি একটি দ্বীপাঞ্চল। এর পশ্চিমে রামনাবাদ নদী। এ নদীর পশ্চিম চ্যানেলে (কলাপাড়া) তৈরি হচ্ছে পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, উত্তরে খরস্রোতা আগুনমুখো নদী ও গলাচিপার চরবিশ্বাস ইউনিয়ন, পূর্বে বুড়া গৌরঙ্গ নদী ও চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরিমুকরি ইউনিয়ন এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। উত্তাল তরঙ্গবিক্ষুব্ধ ও ৪-৫ কিলোমিটার চওড়া নদীপথ পাড়ি দেয়া ছাড়া এ উপজেলায় প্রবেশের আর কোনো সুযোগ নেই। এ উপজেলায় এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি।
রাঙ্গাবালী দ্বীপাঞ্চল হলেও এখানকার অধিবাসীরা গোড়া থেকেই শিক্ষিত ও রাজনৈতিক সচেতন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হাদী তালুকদার (দশমিনা) এমএনএ এবং আবদুল বারেক মিয়া (গলাচিপা) এমপিএ নির্বাচিত হন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নিরঙ্কুশ বিজয়ী দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে সারা দেশের ন্যায় এখানকার মানুষও ক্ষুব্ধ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ — এ অঞ্চলের মানুষ রেডিওর মাধ্যমে পরের দিন শুনতে পায়। অগ্নিঝরা মার্চের উত্তাল তরঙ্গ এ দ্বীপেও এসে লাগে। দেশের মূল ভূখণ্ডের মতো এখানকার মানুষও স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সমগ্র দেশব্যাপী উপজেলা পর্যন্ত গঠিত সংগ্রাম পরিষদের ন্যায় রাঙ্গাবালীতেও সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। হাজী মুজাফফর হোসেন আকন্দ সভাপতি এবং নুরুল ইসলাম হাওলাদা এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন, মোসলেম উদ্দিন, এছাহাক হাওলাদার প্রমুখ। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর উপজেলার কাছিয়াবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে ৫০ জনের একটি দল বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রথম মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করে। ইপিআর কমান্ডার সেরাজ পণ্ডিত এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নেতৃত্ব দেন। এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ১৬ দিন স্থায়ী হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরনের আয়োজন পর্যাপ্ত নয় ভেবে আগ্রহী ১১ জনের একটি দল ভারতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ ১১ জন হলেন- রাঙ্গাবালীর মো. শুকুর হাওলাদার ওরফে সানু মিয়া, ডা. জহির উদ্দিন (বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান), মানিক হাওলাদার, কাজী আবদুল মালেক, নজরুল ইসলাম, আ. আজিজ ফরাজি, ডা. নুরুল ইসলাম, মো. মালেক মাস্টার, আ. হাই ফরাজি, বাহেরচরের আবু তালেব এবং ছোট ভাইজদার এলাকার শহীদ মুন্সি। এ দলটি মে মাসের শেষদিকে ভারতের উদ্দেশে রওনা দিয়ে খুলনা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সেখানে বাধা পেয়ে এবং উপযুক্ত সোর্স না পেয়ে তাঁরা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। ভারতে না গিয়ে তাঁরা গলাচিপার চরকাজল ও চরবিশ্বাসে অবস্থান নেন। সেখানে তাঁরা ২৮ দিন ট্রেনিং গ্রহণ করেন। এখানে ঐ ১১ জনের সঙ্গে রাঙ্গাবালীর আরো ৪ জন যোগ দেন। তাঁরা হলেন- শাহাব উদ্দিন, মোজাম্মেল হক, সামসুল আলম ও রফিকুল ইসলাম। ট্রেনিংয়ের সম্বল ছিল পুলিশ সদস্য মাইনুদ্দিন মিয়ার একটিমাত্র রাইফেল। সরদার জাহাঙ্গীরের কমান্ডে এখানে খেপুপাড়া, গলাচিপা ও বাউফলের মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম দিকে এ এলাকার কমান্ডার ছিলেন কে এম নুরুল হুদা (বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার)। পরবর্তীতে সরদার জাহাঙ্গীর, ডা. জহির উদ্দিন আহমদ এবং হাজী মো. মনিরুল ইসলাম কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। পটুয়াখালী জেলা প্যারা মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শুক্কুর হাওলাদার ওরফে সানু মিয়া, কাজী আবদুল মালেক, নজরুল ইসলাম ও ডা. নুরুল ইসলাম ছিলেন রাঙ্গাবালীর সন্তান।
সমুদ্র বেষ্টিত রাঙ্গাবালী অঞ্চলে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৫-৬ জনের একটি দল শুধু একবার পটুয়াখালী থেকে গানবোটে ৪-৫ কিলোমিটার চওড়া আগুনমুখো নদী পাড়ি দিয়ে রাঙ্গাবালীর দাড়ছেরা নদীতে নোঙ্গর করে, কিন্তু কিনারে ওঠেনি। তখন আগুনমুখো এবং দাড়ছেরা নদী এতটাই খরস্রোতা ছিল যে, সহজে এ নদী কেউ পাড়ি দিতে সাহস পেত না। আগুনমুখো নদীর চেহারা আগুনের মতোই ভয়ঙ্কর ছিল, আর দাড়ছেরা নদীতে এত স্রোত ছিল যে, স্রোতে মাঝিদের দাড় (বৈঠা) ভেঙ্গে যেত বা ছিঁড়ে যেত। এই দাড় বা বৈঠা ছেঁড়া থেকে নদীর নাম হয় ‘দাড়ছেরা নদী’। সুতরাং একবার এসে নদীর অগ্নিমূর্তি দেখে হানাদার বাহিনী আর কখনো এমুখো হয়নি এবং এখানে কোনো কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করেনি।
স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা ও কর্মী-সমর্থকদের নেতৃত্বে রাঙ্গাবালী উপজেলায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। আলী আকবর হাওলাদার এবং হারুন- অর-রশিদ হাওলাদার শান্তি কমিটির যথাক্রমে চেয়ারম্যান ও সম্পাদক ছিল। বাহেরচরের আবদুস সাত্তার, দক্ষিণ কাজির হাওলার চোরা কাদের প্রমুখ ছিল শান্তি কমিটির সদস্য। শান্তি কমিটির পৃষ্ঠপোষকতায় রাজাকার কমান্ডার বারেক মৃধার নেতৃত্বে উপজেলায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় নানা ধরনের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল।
শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য আবদুস সাত্তার ও চোরা কাদেরের অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ ছিল। বিভিন্ন বাড়িতে চুরি করা, ছিনতাই করা, মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপস্থিতে তাদের সম্পদ লুটপাট করা ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। তাদের নেতৃত্বে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয়। আগস্ট মাসের শেষদিকে আমতলী থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৪ জনকে নৌকায় করে ধরে এনে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে দাড়ছেরা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। নভেম্বর মাসের শেষদিকে এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা বাহেরচরে গণআদালতের রায় অনুযায়ী আবদুস সাত্তার ও চোরা কাদেরকে জবাই করে হত্যা করে। উপজেলায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো যুদ্ধ হয়নি। তবে রাঙ্গাবালীর মুক্তিযোদ্ধারা এখানে কোনো যুদ্ধ না করলেও গলাচিপা, খেপুপাড়া প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধে তাঁরা অংশ নেন এবং বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেন। ৫ই ডিসেম্বর রাঙ্গাবালী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
এ উপজেলায় সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা কাজী আ. মালেকের উদ্যোগে নেতা বাজার থেকে সামুদাবাদ পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সড়ক। [এম এ হালিম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!