রাঙ্গামাটি যুদ্ধ (ঝিনাইগাতী, শেরপুর)
রাঙ্গামাটি যুদ্ধ (ঝিনাইগাতী, শেরপুর) সংঘটিত হয় ৬ই জুলাই। এ-যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসানসহ ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার একটি গ্রাম রাঙ্গামাটি। ঝিনাইগাতী থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণ- পূর্বে এ গ্রামটি অবস্থিত। সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটাতে সীমান্তের সড়ক যোগাযোগ রক্ষাকারী শেরপুর জেলার কাটাখালী ব্রিজ ও তিন আনী ফেরি ধ্বংস করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বিএসএফ-এর ক্যাপ্টেন বালজিত সিং এ ব্রিজ ও ফেরি ধ্বংস করার জন্য কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসান ও আব্দুল গণিকে দায়িত্ব দেন। তাঁরা তাদের দুটি কোম্পানি থেকে ৫১ জন মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করে ঐ অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করেন। সিদ্ধান্ত হয় তাঁরা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কমান্ডার নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে তাঁর কোম্পানির ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধা কাটাখালী ব্রিজ ও কমান্ডার আব্দুল গণির নেতৃত্বে তাঁর কোম্পানির ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধা তিন আনী ফেরি ধ্বংস শেষে রাঙ্গামাটি গ্রামে হাইড-আউট করবেন। এজন্য দুটি গ্রুপে ৪টি এলএমজি-সহ অন্যান্য প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, প্রয়োজনীয় গুলি এবং ব্রিজ ও ফেরি ধ্বংসের জন্য এক্সপ্লোসিভ সরবরাহ করা হয়। ৪ঠা জুলাই কমান্ডারগণ তাদের নির্দিষ্ট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভারতের মাচাংপানি ক্যাম্প থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেন। তাঁরা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নয়াবিল ও বারোমারী হয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যার- যার অপারেশন এরিয়ায় চলে যান। ৫ই জুলাই রাত দ্বিপ্রহরের পর তাঁরা যার-যার নির্দিষ্ট স্থানে অপারেশন চালান এবং সফল হন।
অতঃপর ৬ই জুলাই ভোরে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা তাঁদের সহযোদ্ধাদের নিয়ে শেরপুর ও ঝিনাইগাতীর মাঝামাঝি রাঙ্গামাটি গ্রামের নঈম উদ্দিনের বাড়িতে হাইড- আউট করেন। বাড়ির মালিক মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রামের জন্য তার কয়েকটি ঘর ছেড়ে দেন এবং তাৎক্ষণিক খাবারের ব্যবস্থা করেন। এরপর সেন্ট্রি ডিউটি নির্দিষ্ট করে দিয়ে কমান্ডারগণ মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রামে যেতে বলেন। ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ-কেউ অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধারা রাঙ্গামাটি গ্রামে অবস্থান করছে এ সংবাদ ঐ গ্রামের পাকবাহিনীর দালাল জালাল মিস্ত্রী কোয়ারি রোড ও শেরপুরে স্থাপিত হানাদার ঘাঁটিতে জানিয়ে দেয়। রাঙ্গামাটি গ্রামটির উত্তরে হাসলি বিল, দক্ষিণে নদী, পূর্বদিকে নঈম উদ্দিনের বাড়ির ২০০ গজ পরেই একটি খাল এবং পশ্চিমে সমতল ভূমি। সকাল আনুমানিক ১০টায় পাকবাহিনীর বিশাল একটি গ্রুপ নদীপথে নৌকাযোগে এসে তিনদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। কমান্ডারদের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারাও তাৎক্ষণিক পজিশনে গিয়ে পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকেন। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলিবিনিময় চলে। পাকবাহিনীর আক্রমণের প্রচণ্ডতায় মুক্তিযোদ্ধারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটা ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। পিছু হটার একমাত্র পথ হাসলি বিল সাঁতরে যাওয়া। এ পরিস্থিতিতে কমান্ডারগণ মুক্তিযোদ্ধাদের বিল সাঁতরে নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে পিছু হটার নির্দেশ দেন।
পাল্টা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে মুক্তিযোদ্ধারা হাসলি বিলের মধ্য দিয়ে পেছাতে থাকেন। এ বিলের কোথাও-কোথাও কোমর পর্যন্ত, কোথাও বুক পর্যন্ত, কোথাও অথৈই পানি। ইতোমধ্যে পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ নৌকাযোগে গুলি করতে-করতে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু নেয়। কিছুদূর যেতেই পাকবাহিনীর ছোড়া একটি গুলি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জব্বারের কপালে বিদ্ধ হয়। কমান্ডার নাজমুল আহসান তাঁর গামছা দিয়ে জব্বারের ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়ে গুলি করতে-করতে পেছাতে থাকেন। ইতোমধ্যে পাকবাহিনীর এলএমজির একঝাঁক গুলি এসে বিদ্ধ হয় নাজমুল আহসানের বুকে এবং তিনি সঙ্গে- সঙ্গে শহীদ হন। তাঁকে ধরতে গিয়ে তাঁরই চাচাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনও পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। এমতাবস্থায় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা অতি কষ্টে বিল পাড়ি দিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। শহীদদের লাশ তাঁরা নিয়ে যেতে পারেননি। রাঙ্গামাটি যুদ্ধে শহীদরা হলেন- কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসান (পিতা সেকান্দর আলী, বরুয়াজানী, নালিতাবাড়ি), মোফাজ্জল হোসেন (পিতা আহসান উল্লাহ, বরুয়াজানী, নালিতাবাড়ি) ও আলী হোসেন (পিতা আবদুল মোতালেব, বরুয়াজানী, নালিতাবাড়ী)। এ-যুদ্ধে আহত হন কোম্পানি কমান্ডার আবদুল গণি (পিতা ওয়াহেদ আলী, ছাতুগাঁও, হালুয়াঘাট), আবু সাঈদ বিএসসি (বরুয়াজানী হাই স্কুলের শিক্ষক), আবদুল জব্বার প্রমুখ।
রাঙ্গামাটি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ওয়াল্টার স্ট্রং (জলছত্র, মধুপুর), সুশীল মানখিন (জলছত্র, মধুপুর), দিপসন সাংমা (ধাইরপাড়া, ধোবাউড়া), পরিমল রেমা (মান্দাতলী, ধোবাউড়া), পুলক রাংসা (গোবরাকুড়া, হালুয়াঘাট), প্রদীপ তজু (মোজাখালী, হালুয়াঘাট), সমরাজ রিছিল (গোবরাকুড়া, হালুয়াঘাট), ম্যানুয়েল চিগিচাক (পূর্ব গোবরাকুড়া, হালুয়াঘাট), সুশীল ঘাগ্রা (কুমুরিয়া, হালুয়াঘাট), নকান্ত সাংমা (বনখালী, ঝিনাইগাতী), কনডেট সাংমা (পশ্চিম বারোমারী, ঝিনাইগাতী), চাঁন মিয়া (নালিতাবাড়ি, শেরপুর), দীপক সাংমা (কুমুরিয়া, হালুয়াঘাট), আবুল কালাম আজাদ (জিগাতলা, ধোবাউড়া), অন্দ্রিয় মারাক (কুমুরিয়া, হালুয়াঘাট), অধীর মারাক (গান্ধিগাঁও, ঝিনাইগাতী), সুবোধ দেবনাথ (মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা), আলেক মারাক (খয়রাকুড়ি, হালুয়াঘাট), খালেদ জাহাঙ্গীর (কোয়ারী, ফুলপুর), সোহরাব হোসেন (ইসলামপুর, জামালপুর), মফিজ উদ্দিন (পাবিয়াজুড়ি), আলতাব হোসেন (নেত্রকোনা), সদরুল কবির (মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা), মজিবুর রহমান (বারহাট্টা, নেত্রকোনা), বজলুর রশিদ (ঠাকুরাকোনা, হালুয়াঘাট), সিরাজুল ইসলাম (ঠাকুরাকোনা, হালুয়াঘাট), পলেন সাংমা (জয়রামকুড়া, হালুয়াঘাট), আবদুল জব্বার (কেয়ারী, ফুলপুর), আবদুল আজিজ (গোবরাকুড়া, হালুয়াঘাট), জিয়াউল হক প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড