স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ‘রফিক বাহিনী’ (বাগেরহাট সদর)
রফিক বাহিনী (বাগেরহাট সদর) স্থানীয় একটি মুক্তিবাহিনী। এর প্রধান ছিলেন রফিকুল ইসলাম খোকন (পিতা সায়েলউদ্দিন, চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুর)।
রফিক বাহিনীর সংগঠক ছিলেন বাগেরহাট মহকুমার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) ও ছাত্র ইউনিয়ন- মেনন গ্রুপের বিশিষ্ট নেতা রফিকুল ইসলাম খোকন। তিনি বাগেরহাট পি সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন এবং এলএলবি-তে ভর্তি হন। কিন্তু রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ায় তিনি এলএলবি সমাপ্ত করতে পারেননি। তিনি ১৯৬৭-৬৮ সালে খুলনা জেলা ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৯ই মার্চ বাগেরহাট মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির তত্ত্বাবধানে মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে উঠতে থাকে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রফিকুল ইসলাম বাগেরহাট সংগ্রাম কমিটি নিয়ন্ত্রিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সমান্তরাল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি বাহিনী গঠন করেন। বাগেরহাট শহরের উত্তর দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদীর অপর তীর থেকে প্রায় ৬ কিমি উত্তরে অবস্থিত চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুর গ্রাম ছিল রফিক বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এ বাহিনীর প্রধান কমান্ডার ছিলেন রফিকুল ইসলাম খোকন স্বয়ং। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন শেখ আনিছুর রহমান ও প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন শেখ আমজাদ আলী গোরাই। প্রথমদিকে এ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ছিল প্রধানত বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছাত্র ও যুব কর্মিগণ। পরবর্তীতে দল-মত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধারা এ বাহিনীতে যোগ দেন। এ বাহিনী গঠনের শুরুতে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী আসাদের সরবরাহকৃত একটি রিভলবারই ছিল একমাত্র সম্বল। এরপর পিরোজপুরের ফজলু বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া ১৯টি ৩০৩ রাইফেল, ২৭শে এপ্রিল বাগেরহাট শহরে টহলরত একটি পুলিশ দলকে আক্রমণ করে সংগৃহীত ৫টি রাইফেল এবং এক আনসার সদস্যের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া ১টি রাইফেল নিয়ে বাহিনীর অস্ত্রবল তৈরি হয়। এছাড়া এ বাহিনীর সদস্যদের বিস্ফোরক তৈরি ও গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল শিক্ষা দেয়া হয় শুরু থেকেই। অস্ত্রের ঘাটতি দূর করার জন্য এ বাহিনীর সদস্যরা এক ধরনের পাইপ বোমাও তৈরি করতেন। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন থানা আক্রমণ, রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ এবং শত্রুসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের অস্ত্র-গোলাবারুদ দিয়ে রফিক বাহিনীর অস্ত্রাগার সমৃদ্ধ হয়। প্রাথমিক অবস্থায় এ বাহিনী সরাসরি প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু অস্ত্রবল ও দক্ষ লোকবলের অভাবের কারণে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর তাঁরা গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করেন। এছাড়াও রফিক বাহিনী স্থানীয় অন্য মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ যথা— কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বাধীন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, মানস ঘোষের বাহিনী, হবি বাহিনী প্রমুখ বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এ বাহিনী ছোট-বড় কমপক্ষে ২০টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১লা মে এ বাহিনী বাগেরহাট সদর থানা আক্রমণের মাধ্যমে প্রথমে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধে থানার কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়। ১০ই জুলাই এ বাহিনী কুখ্যাত রাজাকার রজব আলীর বিরুদ্ধে অপারেশন চালায়। এতে রজব আলীর কয়েকজন সঙ্গী নিহত হয়। ২৪শে জুলাই রাজাকারদের বহনকারী রূপসা থেকে বাগেরহাটগামী ট্রেনে রফিক বাহিনী এবং মানস ঘোষের বাহিনী আক্রমণ চালায়। এতে অনেক রাজাকার হতাহত হয় এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা- বারুদ এ বাহিনী হস্তগত করে। ৭ই আগস্ট এ বাহিনীর গেরিলারা মাধবকাঠী মাদ্রাসায় হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ-যুদ্ধে ৩ জন পাকসেনা এবং কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। ৯ই সেপ্টম্বর চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুরের গেরিলা ঘাঁটিগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য হানাদার বাহিনী আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের যুদ্ধে ১৬ জন পাকসেনা এবং কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। এ-যুদ্ধ পানিঘাটের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৩ই সেপ্টেম্বর দেপাড়া ব্রিজের নিকট হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এ বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা বিজয় পাল শহীদ হন এবং কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। ৯ই নভেম্বর বাবুরহাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে এ বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে এ বাহিনী প্ৰায় ১৫০ বর্গ কিমি এলাকা নিজ দখলে রাখতে সক্ষম হন। তাঁদের নেতৃত্বে বাগেরহাটের মুনিগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে চিতলমারী পর্যন্ত এক বিরাট এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ছিল গোটাপাড়া, বিষ্ণুপুর, চিতলমারী, ধোপাকালী, বেমজা, সন্তোষপুর, চরবানিয়া প্রভৃতি অঞ্চল। রফিক বাহিনীর প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন গোলাম মোস্তফা হিল্লোল। এ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৪ শতাধিক। [মিথুন সাহা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড