You dont have javascript enabled! Please enable it!

১নং সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম রফিকুল ইসলাম

রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪৩) বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ১নং সেক্টর কমান্ডার। ১৯৪৩ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার নাওড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম আশরাফ উল্লাহ এবং মাতা রহিমা বেগম। তিনি পিতা-মাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান৷ ১৯৫৯ সালে তিনি অন্নদা মডেল হাইস্কুল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে বিজ্ঞান শাখায় প্ৰথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬১ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৬৩ সালের শুরুর দিকে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে পাকিস্তান আর্মির ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে নিয়োগ লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁকে আর্টিলারি কোরে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৬৮ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বদলি হয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে আসেন এবং রেজিমেন্টের এডজুট্যান্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্-এর চট্টগ্রামস্থ হেডকোয়ার্টার্সে এডজুট্যান্ট পদে যোগ দেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬-দফা ভিত্তিক বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম, এর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে ১নং আসামী করে আইয়ুব সরকারের আগরতলা মামলা দায়ের, ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টমেন্টে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধু ও মামলার অন্যান্য আসামিদের বিচার, প্রতিক্রিয়ায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন ও নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ বিজয়, ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মার্চ মাস জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন গোপনে পাকিস্তানিদের যুদ্ধ প্রস্তুতি ইত্যাদি ঘটনার প্রতি সেনাবাহিনীর চাকরিতে নিয়োজিত থাকা অবস্থায়ও তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে আসছিলেন। ঘটনা প্রবাহ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণ অত্যাসন্ন। এমনি পরিস্থিতিতে করণীয় সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ তিনি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা পান। তাই ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট – শুরুর পূর্বেই তিনি তাঁর অধীনস্থ ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিক ও জেসিওদের নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে অনেক হানাদার সৈন্যকে হত্যা কিংবা বন্দি করতে সমর্থ হন। তখন ৮ ইস্ট বেঙ্গলের সিনিয়র বাঙালি অফিসার মেজর জিয়া তাঁর ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশমতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সোয়াত জাহাজে করে আসা অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে পোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়। চট্টগ্রাম শহর ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর) রফিকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং ২৮শে মার্চ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এর ভেতর পাকিস্তানি সৈন্যরা কুমিল্লার দিক থেকে চট্টগ্রামে অগ্রসর এবং হেলিকপ্টারে অবতরণ করে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রাম শহরের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। ফলে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ও এর পার্শ্ববর্তী স্থানে তাদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বাধীন ইপিআর সদস্যদের সংঘর্ষ চলে। প্রতিকূল অবস্থায় যুদ্ধের দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহে তিনি ২রা এপ্রিল আগরতলায় চলে যান। তিনি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ১নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। এর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম। জুন মাসে জিয়ার নেতৃত্বে ‘জেড’ ফোর্স গঠিত হলে মেজর রফিকুল ইসলাম ১নং সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর হেডকোয়ার্টার্স ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমের হরিণায়। যুদ্ধের সুবিধার্থে তাঁর সেক্টরকে ৫টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়, যথা- ঋষিমুখ, শ্রীনগর, মনুঘাট, তবলছড়ি ও ডিমাগিড়ি। এ সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিল ২ হাজার ১০০ ও অনিয়মিত বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁর এ দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তাঁকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
উল্লেখ্য, ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পিলখানার ইপিআর হেডকোয়াটার্সের সুবেদর মেজর শওকত আলী ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামের হালিশহরস্থ তাঁর ইপিআর ঘাঁটিতে প্রেরণ করেন। এ ভাবে তা চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকট ও দেশের অন্যত্র পৌঁছায়।
মেজর রফিক, বীর উত্তম ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নেন। এরপর তিনি বিভিন্ন সংস্থায় কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে গঠিত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনি উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি নিজ এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদে সদস্য নির্বাচিত হন এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯৯ সালের ১১ই মার্চ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ওপর ইংরেজি ভাষায় A Tale of Millions (Dhaka, Adeyle Brothers) গ্রন্থ রচনা করেন, যার বাংলা সংস্করণ ১৯৮১ সালে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ (ঢাকা, ছায়াপথ প্রকাশনী) শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এটি মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি আকর গ্রন্থ। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র : রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে – মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১, ঢাকা, ছায়াপথ প্রকাশনী ১৯৮১; হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয় ১৯৮৪, পৃ. ১-৫৮; মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তমএর সাক্ষাৎকার ২৬.১০.২০১৮ ও ২৮.১০.২০১৮।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!