You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.15 | রংপুর গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা) - সংগ্রামের নোটবুক

রংপুর গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

রংপুর গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা) সংঘটিত হয় ১৫ই এপ্রিল। এতে বেশ কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন রংপুর। ডুমুরিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে এর অবস্থান। এ ইউনিয়নের রংপুর গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। পার্শ্ববর্তী বেশকিছু গ্রামও ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। সম্প্রদায়গত এ জনবিন্যাসের কারণে এ এলাকার অধিবাসীরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের আক্রমণের ঝুঁকিতে ছিল। রংপুর ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রাম বসেরাবাদ। বসেরাবাদ রংপুর গ্রামের সন্নিকটবর্তী এবং ফুলতলা উপজেলা সীমানার ঠিক পাশে অবস্থিত। ১০ই এপ্রিল বন্দুক ও বোমার ভয় দেখিয়ে ফুলতলা থানার কিছু দুর্বৃত্ত বসেরাবাদ গ্রামের কয়েকটি বাড়ি দখলের চেষ্টা করে। দখলদারদের মূল হোতা ছিল ফুলতলার লখাই ডাকাত। লখাইয়ের সঙ্গে এলাকার স্বাধীনতাবিরোধীদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। লখাই ডাকাত তার বাহিনী নিয়ে এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বসেরাবাদ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন সংঘবদ্ধ হয়ে লখাই ডাকাত ও তার চার-পাঁচজন সহকারীকে পাকড়াও করে। পরে গণপিটুনিতে তারা মারা যায়। সংঘবদ্ধ এ প্রতিরোধে রংপুর গ্রামের কিছু মানুষও অংশ নিয়েছিল।
বসেরাবাদের মতো হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় এ জাতীয় সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের ঘটনার কারণে স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। বসেরাবাদে মারা যাওয়া লখাই ডাকাত ছিল ফুলতলার দামোদরের স্বাধীনতাবিরোধী সরোয়ার মোল্লার অন্যতম সহযোগী। সরোয়ার মোল্লা এবং ডুমুরিয়া ও ফুলতলা থানার কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধী রংপুর গণহত্যায় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
১৫ই এপ্রিল ছিল বাংলা নববর্ষ। এদিন সকাল ৯টার দিকে দুটি গাড়িতে চেপে পাকিস্তানি সেনারা রংপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী শলুয়া বাজারে আসে। শলুয়া থেকে ২০ জন পাকিস্তানি সেনা পায়ে হেঁটে রংপুর গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামে প্রবেশের মুখে তারা ভোন্ডল মণ্ডল নামক একজন মানসিক প্রতিবন্ধীকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর পাকসেনারা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন বাড়ি থেকে লোকজনকে ধরে আনতে শুরু করে রংপুর কালীবাটী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাসকে ধরার পরপরই তারা বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাস এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএ এবং ১৯৪৬ সালে কলকাতার ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি পাশ করেন। ১৯৪৩-৫৩ সালে তিনি রংপুর ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন।
পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩০ জন মানুষকে ধরে একত্র করে স্থানীয় জোদ্দার বাড়িতে নিয়ে লাইনে দাঁড় করায়। সবাইকে মাঠের মধ্যে উপুড় করে শুইয়ে দেয়। এরপর তাদের ওপর উপর্যুপরি বেয়নেট চার্জ করে। বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত হয়েও কেউ-কেউ উঠে দৌড়ে পালিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এভাবে পালাতে থাকা প্রায় সকলেই গুলিতে প্রাণ হারায়। উল্লেখ্য, এখানে লাইনে দাঁড় করানো অনেকেই ছিলেন ষাট ও সত্তরোর্ধ মানুষ। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার মতো শারীরিক অবস্থা তাদের ছিল না। সেদিন নীহার ও রতন নামে দুই সহোদর মোটর সাইকেলে চড়ে শলুয়া বাজারের দিকে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনারা তাদের আটক ও নির্যাতন করে। পরে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রংপুর গণহত্যায় শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাওয়া যায়নি। স্থানীয় ১২ জন ও বহিরাগত ১ জনসহ মোট ১৩ জন শহীদের নাম ও পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- রংপুর গ্রামের প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাস (পিতা ফৌজদার বিশ্বাস), ইন্দুভূষণ বিশ্বাস (পিতা বিনোদবিহারী বিশ্বাস), ভোন্ডল মণ্ডল (পিতা লালচাঁদ মণ্ডল), মথুর ঢালী (পিতা হরিবোলা ঢালী), রাইচরণ মণ্ডল (পিতা হরষিত মণ্ডল), অমূল্য মণ্ডল (পিতা উপেন্দ্ৰনাথ মণ্ডল), লালচাঁদ বিশ্বাস (পিতা হরিচরণ বিশ্বাস), মহেন্দ্রনাথ ঢালী (পিতা বিশ্বম্বর ঢালী), অমূল্য জোদ্দার (পিতা দ্বিজবর জোদ্দার) এবং শলুয়া গ্রামের নির্মল ঢালী (পিতা সিদ্ধিরাম ঢালী), দুই সহোদর রতন কুমার বিশ্বাস ও নীহার রঞ্জন বিশ্বাস (পিতা অবিনাশ চন্দ্র বিশ্বাস) এবং বিশ্বনাথ কাবরা। রংপুর গণহত্যার দিন বেয়নেট ও গুলিতে আহত হয়েছিলেন অন্তত ২৪ জন। তারা হলেন- রংপুর গ্রামের যোগেশ চন্দ্ৰ রায়, পরিমল মৈত্র, শিবপদ ঢালী, বিনোদ বিহারী বিশ্বাস, পুলিন বিহারী বিশ্বাস, মন্তরাম বিশ্বাস, সুভাষ বিশ্বাস, প্রবোধ বিশ্বাস, অতুল মণ্ডল, বৈদ্যনাথ জোদ্দার (বুদ্ধদেব), কেতু জোদ্দার, হরেন্দ্রনাথ জোদ্দার, প্রমথ জোদ্দার, কালীপদ জোদ্দার (ম্যানেজার), অধর জোদ্দার, খগেন্দ্রনাথ জোদ্দার অশ্বিনী জোদ্দার, বুচো কীর্তনীয়া, বিজয় কীর্তনীয়া, মহাদেব জোদ্দার, লালচাঁদ বিশ্বাস নালা ও উপেন্দ্রনাথ ঢালী। আহত অপর দুজন হলেন দেডুলি গ্রামের দিলীপ মণ্ডল এবং ফুলতলা উপজেলার চিত্তরঞ্জন গাইন (গ্রাম ডাকাতিয়া)। [দিব্যদ্যুতি সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড