You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে রংপুর সদর উপজেলা

রংপুর সদর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধে রংপুর সদর উপজেলার স্বাধীনতাকামী জনতা ত্যাগে ও সংগ্রামে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ- বৃহত্তর রংপুর জেলার ১২টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে ২২টি আসনে জয় লাভ করে। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে রংপুরবাসী পাকিস্তানি শাসন- শোষণের শৃঙ্খল ভেঙ্গে জাতির মুক্তির প্রত্যয় ব্যক্ত করে।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি – সারাদেশের মতো রংপুরবাসীর রাজনৈতিক চেতনায় বিশেষ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বেই আওয়ামী লীগ এক মজবুত ভিত্তি লাভ করে। আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনে দলীয় নেতা-কর্মীরা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হন। এসব আন্দোলনে রংপুরের বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর সারা দেশের মানুষের মতো রংপুরবাসীও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক্ষায় উন্মুখ ছিল। কিন্তু জাতীয় পরিষদের সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতকরণের সংবাদ বেতারের মাধ্যমে শোনামাত্র রংপুর সদরসহ জেলার প্রতিটি থানা সদরে বিক্ষোভ মিছিল হয় এবং জনগণের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ পর্যায়ে ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে রংপুর প্রেসক্লাবের ছাদে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলনের পর সেন্ট্রাল রোডের পাংগা হাউজের ছাদে একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ৩রা মার্চ হরতাল ও সম্ভাব্য আন্দোলনের পরিস্থিতি আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। জেলা ছাত্রলীগ-এর সাবেক সভাপতি আব্দুর রউফ ছাড়াও রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম গোলাপ, সাধারণ সম্পাদক মমতাজ জাকির আহমেদ সাবু, ছাত্রনেতা হারেস উদ্দিন সরকার, অলক সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, আবুল মনসুর আহমেদ, মাহবুবুল বারী, মুখতার ইলাহী, জিয়াউল হক সেবু, জায়েদুল, নুরুল হাসান প্রমুখ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
৩রা মার্চ পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাপকভাবে হরতালের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রংপুর′ সদরসহ জেলার সর্বত্র হরতালে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। সর্বস্তরের জনতার অংশগ্রহণে বের হওয়া মিছিলে আবু সোলায়মান মণ্ডল এমএনএ, মো. সিদ্দিক হোসেন এমপিএ, রফিকুল ইসলাম গোলাপ, অলক সরকার, খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল, মুখতার ইলাহী প্রমুখ নেতৃত্ব দেন। “ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, “তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ ইত্যাদি জ্বালাময়ী স্লোগানে রংপুর শহর মুখরিত হয়ে ওঠে। শান্তিপূর্ণ মিছিলটি আলমনগর খাদ্য গুদামের কাছে পৌছলে আকস্মিকভাবে মিছিলের ওপর অবাঙালি সরফরাজ খানের বাড়ি থেকে গুলি বর্ষিত হয়। গুলিতে ১২ বছরের কিশোর শঙ্কু সমজদার মারাত্মকভাবে আহত হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে সে মারা যায়। সেদিন রংপুর কলেজের ছাত্র আবুল কালাম আজাদ ও ওমর আলী নামে আরো দুজন নিহত হন। শঙ্কুর মৃত্যু ও অন্যান্য ঘটনা রংপুর শহরে এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি প্রশাসন রংপুরে সান্ধ্য আইন জারি করে। ৩রা মার্চ থেকেই মূলত রংপুরবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এও রংপুরের কথা উচ্চারিত হয়েছে। এরপর থেকেই প্রতিবাদ-আন্দোলন আরো তীব্র হতে থাকে। সাধারণ জনতার অংশগ্রহণে অসহযোগ আন্দোলন সর্বাত্মক রূপ নেয়। এলাকার মানুষ পাকিস্তানিদের সবরকম খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়৷
৩রা মার্চ থেকে ৫ই মার্চ পর্যন্ত রংপুরে কারফিউ জারি হয়। সাতই মার্চের ভাষণের পর রংপুর সদরসহ বিভিন্ন স্থানে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হতে থাকে। ৮ই মার্চ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের প্রস্তুতি চলে। ১৬ই মার্চ রংপুর শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ জেলার সর্বত্র মিছিল, মিটিং হয়। ১৭ই মার্চ রফিকুল ইসলাম গোলাপ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ইশতেহার ও মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকার নমুনা গ্রহণ করেন। ২৩শে মার্চ তিনি ডিসির বাসভবনে, ইলিয়াস আহমেদ ডিসি অফিসে এবং মাহফুজ আলী জররেজ নবাবগঞ্জ বাজারে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে রংপুরবাসীর পাকিস্তানি প্রশাসনের প্রতি অসহযোগের ধারাবাহিকতায় ২৪ তারিখ বাঙালির ক্রোধের এক ভিন্ন মাত্রার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেদিন রংপুর সেনানিবাস থেকে লে. আব্বাস ৩-৪ জন সেনাসহ পার্শ্ববর্তী নিসবেতগঞ্জ হাটের কাছে খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যান। পাকসেনাদের আগমনের সংবাদে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রামবাসী প্রতিশোধের প্রস্তুতি নেয়। তারা বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে থাকে। লে. আব্বাসের গাড়িটি দামোদরপুর বড়ময়দান ঈদগাহ বরাবর এলে শাহেদ আলী, বাদশা, সালাম, রফিকসহ আরো কয়েকজন গাড়ির কাছে চলে আসেন। শাহেদ আলী আকস্মিকভাবে লাফ দিয়ে গাড়ির বনেটে উঠে এক সেনার কাছ থেকে এলএমজি ছিনিয়ে নেন। লে. আব্বাসকে মুহূর্তেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেন। অন্যরাও সঙ্গে আসা পাকিস্তানি সেনাদের কোপাতে থাকেন। গুরুতর আহত হয়ে পাকিস্তানি সেনারা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ খবর পেয়ে রংপুর সেনানিবাস থেকে বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা ঘটনাস্থলে আসে এবং গণেশপুর গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। রাত ১১টায় লে. আব্বাসের মৃত্যু হলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। লে. আব্বাসের জানাজায় অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে চলে আসেন লে. জেনারেল জানজুয়া, লে. জেনারেল মিটঠা, জেনারেল নজর হোসেন শাহসহ উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তারা। এই জানাজার অন্তরালে তারা গোপন বৈঠক করেন। ব্রিগেডিয়ার মালিককে বাঙালি হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন ও পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। ২৫শে মার্চ রংপুর শহরে বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন থাকে। রাত ১২টার দিকে ঢাকার মতো রংপুর সেনানিবাসে বাঙালি ইপিআরদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। পাকবাহিনী শহরের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র জনতার ওপর আক্রমণ চালায়; শুরু করে ধরপাকড়, নির্যাতন, হত্যা ও অগ্নিসংযোগ। বাঙালি ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে কুড়িগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। রংপুরের অধিকাংশ ছাত্র-যুবকরা কুড়িগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। পাটগ্রাম, বুড়িমারী, টাপুরহাট যুব প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে রংপুরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করে।
২৫শে মার্চ বাঙালি ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ রংপুর সেনানিবাস থেকে ইপিআর গার্ড নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রংপুর শহর ছাড়ার পূর্বে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়ার রহমান ও মাহিগঞ্জের মোল্লা মাস্টারের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও বিষয়ে আলাপ করেন। আন্দোলনরত কর্মীদের কাছে দ্রুত একথা ছড়িয়ে যায় যে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনতা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ে সফল হলে বাঙালি সৈন্যরা অস্ত্র নিয়ে জনতার সঙ্গে যোগ দেবেন। মো. সিদ্দিক হোসেন এমপিএ, আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন, আব্দুল গণি, মজিবর মাস্টারসহ আরো অনেক নেতাকর্মীর উদ্যোগে প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। উল্লেখ্য যে, ২৬শে মার্চ আলোচনার কথা বলে মো. নূরল হক এমএনএ, মো. আজিজুর রহমান এমএনএ, আবু সোলায়মান মণ্ডল এমএনএ-কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জিপে করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৭শে মার্চ আইনজীবী ও সংস্কৃতিকর্মী মাহফুজ আলী জররেজ মিয়াকেও সেনা সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। এসব করাণে রংপুর শহরের পরিবেশ পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। এর মধ্যেই গোপনে চলতে থাকে রংপুর সেনানিবাস আক্রমণের প্রস্তুতি।
২৮শে মার্চ মুক্তিকামী জনতার রংপুর সেনানিবাস আক্রমণ- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ, গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া উপজেলাসহ উত্তরাঞ্চলের নানা প্রান্ত থেকে লোকজন সেনানিবাসের নিকটবর্তী এসে জড়ো হতে থাকে। বলদিপুকুর, মিঠাপুকুর মানজাই, তামফাট, জয়রাম, পালিচড়া, বুড়িরহাট, গঙ্গাচড়া, শ্যামপুর, গণেশপুর, সাহেবগঞ্জ ও বাহার কাছনাসহ রংপুরের বিভিন্ন এলাকার সমবেত মানুষের মধ্যে সেদিন লক্ষ করা গেছে সেনানিবাস আক্রমণের স্বতঃস্ফূর্ততা। তাদের সঙ্গে বাঁশের লাঠি, বল্লম, তীর-ধনুক প্রভৃতি দেশীয় অস্ত্র। জিতেন দত্ত, ছয়ের উদ্দিন, শংকর বসু প্রমুখ সাহসী নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় সেদিন তৃণমূল কৃষকদের সঙ্গে বুদুওঁরাও এর নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক আদিবাসীও সেনানিবাস আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। ছয়ের উদ্দিন, আব্দুল গণি, নুরুল ইসলাম, “ছাত্রনেতা বলরাম, নারায়ণ, তৈয়বুর রহমান প্রমুখ নিজনিজ এলাকার নেতৃত্ব দেন। আক্রমণের মূল স্থানটি নিসবেতগঞ্জের ঘাটপাড় থেকে সেনানিবাসের পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বেলা এগারটায় সেনানিবাসের দিকে অগ্রসরমাণ হাজার-হাজার জনতার ওপর আকস্মিক পাকবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালালে মুহূর্তেই অসংখ্য মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ছত্রভঙ্গ হয়ে প্রতিরোধে অংশগ্রহণকারীদের অনেকে পিছু হটতে থাকে। ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে আক্রমণের কর্মসূচি চলে। এরপর পাকসেনারা অগণিত বাঙালির লাশ এক জায়গায় জড়ো করে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
রংপুর সদর উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা হলেন- মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ ফারুক (পিতা ড. আইন উদ্দিন আহমেদ, ধাপ), অপিল উদ্দিন আহমেদ (পিতা শমসের উদ্দিন, শালবন), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা সাবিল উদ্দিন, বাহারকাছনা), গোলাপ হোসেন (পিতা আব্দুর রহমান, পুটিমারী) ও পানওয়ার রহমান ভূঁইয়া পিন্টু (পিতা মতিয়ার রহমান ভূঁইয়া, মুন্সীপাড়া)।
পূর্ব থেকেই রংপুর সদর উপজেলার সন্নিকটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৩ ব্রিগেড সদর দপ্তর ছিল। রংপুর সেনানিবাস ছাড়াও পাকবাহিনী রংপুর টাউন হল, রংপুর বেতার ভবন, রংপুর সাহিত্য পরিষদ, রংপুর প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘর, রংপুর কলেজ ছাত্রাবাস ও রংপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে।
মে মাসেই রংপুর সদর উপজেলায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে। রংপুর সদর উপজেলার কিছু সংখ্যক পাকিস্তান অনুরাগী ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ মাঠে গিয়ে রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় ফিরে আসে। পাকবাহিনী তাদের সহযোগিতায় হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এদের মধ্যে এ টি এম আজহারুল ইসলাম (আলবদর প্রধান, রংপুর; মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত), নাছির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (আলবদর, রবার্টসনগঞ্জ), সিরাজুল ইসলাম (~মুসলিম লীগ নেতা, রংপুর জেলা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক), মওলানা রুহুল আমিন (রাজাকার সংগঠক, হরকলি), রইচ উদ্দিন আহমেদ (শান্তি কমিটির সদস্য, হারাগাছ), এডভোকেট মনির উদ্দিন (মুচিপট্টি), সেরাজ উদ্দিন খন্দকার (দালাল, পিডিপি নেতা), আফতাব উদ্দিন আহম্মদ (আনসার কমান্ডার, রংপুর), সরফরাজ খান (আলমনগর), মশিউর রহমান যাদু মিয়া (ন্যাপ নেতা; রাধাবল্লভ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহায়তায় যুদ্ধের ৯ মাস মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে। তারা লালবাগ এলাকায় শাহেদ আলী (লে. আব্বাসের হত্যাকারী প্রতিরোধযোদ্ধা)-কে নির্মমভাবে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকে অসংখ্য স্বাধীনতাকামী মানুষ এবং বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সেনানিবাসে এনে হত্যা করে। রংপুর ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানি মেজর বশির স্থানীয় দালালদের সহায়তায় নারীদের ধরে এনে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। এছাড়াও কেল্লাবন্দের সিও বাজার সংলগ্ন পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের বাসায় পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে নারীদের ধরে এনে নির্যাতন করত। তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে নির্বিচারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
২৩শে মে ৬-৭ জন দালাল সদর থানার লিচু বাগান এলাকার শৈলেন দত্ত, পূর্ণচন্দ্র সরকার ও শংকর বণিককে বাসা থেকে ডেকে শৈলেন দত্তকে জিপের পেছনে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে হত্যা করে। অপর দুজনকে নিসবেতগঞ্জ হাটের কাছে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। রংপুর টাউনহল সংলগ্ন এলাকায় তারা গড়ে তোলে টর্চার সেল। অসংখ্য নারী-পুরুষকে এখানে এনে হত্যা করা হয়। টাউন হলের ভেতরে ও পেছনে গড়ে ওঠে নারীনির্যাতন কেন্দ্র। পাকিস্তানি সেনাদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য রাজাকাররা সেখানে বিছানাপত্র পর্যন্ত সাজিয়ে দেয়। তারা অক্ষম-অসুস্থদেরকেও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে টাউন হলের পাশের ইঁদারা ও বড় গর্তে ফেলে দিত। স্বাধীনতার পরপর ওসব এলাকায় ছড়িয়ে- ছিটিয়ে থাকা ছায়া, শাড়ি, সালোয়ার, কামিজ, লেপতোষকের বিছানা ও অসংখ্য নারীপুরুষের হাড়গোড়, মাথার খুলি ও তরুণীদের লম্বা বেণীগাঁথা চুল পাওয়া যায়। টাউন হলের ভেতরে কোনো এক নির্যাতিতা নারী তার শরীরের রক্তে লিখে রেখেছিলেন ‘আমি বাঁচতে চাই।’
৩রা এপ্রিল মধ্যরাতে পাকবাহিনী দখিগঞ্জ শ্মশানে রংপুরের বিশিষ্ট নাগরিক মাহফুজ আলী জররেজসহ ১০ বাঙালিকে হত্যা করে, যা দখিগঞ্জ গণহত্যা নামে পরিচিত। সেদিন মন্টু নামে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে কৌশলে বেঁচে যান।
রংপুর শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে সাহেবগঞ্জ গ্রামটি তপোধন ইউনিয়নের অন্তর্গত। ১লা মে মধ্যরাতে সাহেবগঞ্জের বীরচরণে ১৯ জন বাঙালি সৈন্যকে পাকবাহিনী ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে, যা সাহেবগঞ্জ গণহত্যা নামে অভিহিত। ৭ই মে জুমার নামায শেষে লাহিড়ীরহাট পুকুর পাড়ে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। স্থানীয় মসজিদে নামায শেষ হতেই মসজিদের সামনে পাকবাহিনীর ৪টি ট্রাক এসে থামে। মুসুল্লিরা প্রাণভয়ে দিগবিদিক ছুটলেও ৩২ জন মুসুল্লি তাদের হাতে ধরা পড়েন। ধৃতদের পিঠমোড়া করে বেঁধে পার্শ্ববর্তী পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়, যা লাহিড়ীর হাট গণহত্যা নামে পরিচিত। ২৪শে মে মধ্যরাতে পাকবাহিনী ঘাঘট নদীর তীরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় খাকি পোশাকপড়া ৫০-৬০ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ঘাঘটতীরের গণহত্যায় শহীদ সকলেই ছিলেন ইপিআর বাহিনীর বাঙালি সদস্য।
১২ই এপ্রিল রাতে পাকবাহিনী রংপুর ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ- পশ্চিমে বালারখাইল নামক স্থানে নৃশংস গণহত্যা চালায়। তারা সৈয়দপুর থেকে ৩টি ট্রাকযোগে চোখ ও হাত-পা বাঁধা মানুষদের এখানে এনে গুলি করে হত্যা করে, যা বালারখাইল গণহত্যা নামে পরিচিত। বালারখাইলে পাকবাহিনী সেদিন ডা. জিকরুল হক এমপিএ-কেও হত্যা করে। ৩০শে এপ্রিল গভীররাতে কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, সুনীলবরণ চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন রায়, কালাচাঁদ রায় ও তার স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়কে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়। তাদের কারমাইকেল কলেজ থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে দমদমা ব্রিজের পশ্চিম পাশে গুলি করে হত্যা করে। ২৩শে মে পাকবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বের গ্রাম নিসবেতগঞ্জে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে ৫০ জনকে হত্যা করে। এটি নিসবেতগঞ্জ গণহত্যা নামে পরিচিত। এখানে ২৫শে মে গুপ্তপাড়ার আইনজীবী বিজয় চন্দ্র মৈত্রেয় (পাখি মৈত্রেয়), লিচু বাগান এলাকার আইনজীবী পূর্ণচন্দ্র সরকার ও ব্যবসায়ী শংকর বণিককেও হত্যা করা হয়। ১০ই জুন রংপুর ক্যান্টনমেন্টের সন্নিকটবর্তী রংপুর-সৈয়দপুর সড়কের জাফরগঞ্জ ব্রিজের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানের অভিযোগে রংপুর বেতারের আশপাশ এলাকা থেকে ২৪০ জন নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই ব্রিজেই যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন ধরে এনে গুলি করে হত্যা করার পর লাশ নদীতে ফেলে দিত। এটি জাফরগঞ্জ ব্রিজ বধ্যভূমি নামে পরিচিত। ব্রিজের উত্তর-পূর্বে মহাসড়কের পাশেই তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের সিপাহী সাবের মিয়া ও সিপাহী নুর মোহাম্মদকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে হত্যা করে।
রংপুর সেনানিবাস, রংপুর টাউন হল, রংপুর কলেজ ছাত্রাবাস, রংপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও কেল্লাবন্দ সিও বাজার সংলগ্ন পাকিস্তানি অফিসারদের বাসা নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
রংপুর সদর উপজেলায় ৪টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো— দমদমা ব্রিজ বধ্যভূমি, লাহিড়ীর হাট বধ্যভূমি, নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমি ও জাফরগঞ্জ ব্রিজ বধ্যভূমি। ২৮শে মার্চ রংপুর সেনানিবাস ঘেরাওয়ের পরবর্তীতে সারা রংপুর জুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হলে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃবন্দের অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিরাপদ অঞ্চলে চলে যান। ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে রংপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তাঁরা অপারেশন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁরা ৮ই জুন রংপুর বেতার সম্প্রচার ভবনের সামনে এবং ৯ই জুন ওরিয়েন্টাল সিনেমা হলের সামনে গ্রেনেড হামলা চালান। ১৭ই ডিসেম্বর রংপুর সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম (পিতা আইন উদ্দিন আহমেদ, স্টেশন রোড), মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, বীর বিক্রম (পিতা আব্দুস সাত্তার, রিন্নাটারী), মো. আব্দুস শুকুর, বীর বিক্রম (পিতা মো. আনোয়ার আলী, কামালকাছনা), মমতাজ উদ্দিন, বীর প্রতীক (পিতা ওমর আলী, মুন্সিপাড়া), মো. আবদুল মজিদ, বীর প্রতীক (পিতা কছিমউদ্দিন আহমেদ, ঘাঘটপাড়া)৷
রংপুর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- খোন্দকার মুখতার ইলাহী (পিতা খোন্দকার দাদ ইলাহী, ধাপ), বাদশা মিয়া (পিতা হরমান আলী, মাহিগঞ্জ), মো. মোবারক হোসেন (পিতা আব্দুল কাদের, শালবন), আ. মু. চান্দ মিয়া (পিতা আব্দুল কাদের, মাহিগঞ্জ), মো. আজাহার আলী (পিতা আব্বাস আলী, কিশামত বিষু মোনজাই), মো. আলী মণ্ডল (পিতা আব্দুল কাদের, নিউ জুম্মাপাড়া) ও আনোয়ারুল ইসলাম (পিতা আবুল কালাম, বাহার কাছনা)। রংপুর জেলা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে শহরের সুরভী উদ্যানে শহীদ স্মৃতি নামফলক, রংপুর সেন্ট্রাল রোড ও স্টেশন রোডের সংযোগস্থলে ‘মুক্ত পায়রা’ স্মৃতিস্তম্ভ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। শহীদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী স্মরণে স্টেশন রোডের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ মুখতার ইলাহী সরণি। তাঁর নামে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েয়েছ। গণহত্যায় শহীদ মাহফুজ আলী জররেজ-এর নামে রংপুর পৌরসভার সামনে একটি মার্কেটের নামকরণ করা হয়েছে। দখিগঞ্জ শ্মশানে শহীদদের স্মরণে দখিগঞ্জ স্মৃতিসৌধ, লাহিড়ীর হাট গণহত্যার স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে রক্ত গৌরব- নামে একটি স্মৃতিসৌধ, রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ১নং গেইটের নামকরণ করা হয়েছে বীর উত্তম শহীদ মান্নান তোরণ, একই গেইটের এক স্থানে অংশুমান – ভাস্কর্য, রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের পাশে মর্ডান মোড়ে ‘অর্জন’ নামে একটি ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। রংপুর টাউন হলের পেছনে ইন্দারার পাশে স্থাপিত হয়েছে ‘একাত্তরের বধ্যভূমি’ স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়া প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ শাহেদ আলীর নামে আমজাদের মোড় থেকে বড়বাড়ী পর্যন্ত একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। [গীতিময় রায়]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!