You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.10.26 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | শেরে বাংলার জন্ম শতবার্ষিকী | বাংলাদেশ-জাপান যুক্ত ইশতেহার | নোবেল পুরস্কার কমিটি এতোদিনের শ্রদ্ধা হারালেন | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৬শে অক্টোবর, শুক্রবার, ৯ই কার্তিক, ১৩৮০

শেরে বাংলার জন্ম শতবার্ষিকী

আজ শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের জন্ম শতবার্ষিকী। শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হক একটি নাম। একটি ইতিহাস। এ নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে এদেশের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের সংগ্রাম ও সাধনার ইতিহাস। এ ইতিহাস একটি ভাগ্য বিড়ম্বিত জাতির ইতিহাস। আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাস।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হক এ দেশের অগণিত মানুষের মুখের ভাষা দেবার জন্য বুকে আশার আলো আলাবার জন্য যে সংগ্রাম করে গেছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তার সংগ্রামবহুল জীবন নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোন ইতিহাসের রচিত হয়নি। একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক এদেশের মাটিতে জন্ম গ্রহণ না করলে আত্ম চেতনায় উদ্দীপ্ত হবার পথ প্রশস্ত হতো না। শেরে বাংলা কর্মবহুল জীবনের প্রতি পদে পদে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে গেছেন যে, জনতাই হল সকল প্রেরণা সংগ্রাম ও সাধনার উৎস। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এ মহাবাণীকে সামনে রেখেই তিনি মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তার হৃদয়ে ছিল সাধারণ মানুষের চিরন্তন আসন। সাধারণ মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ শেরেবাংলা সম্পর্কে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন, “রাজনীতি আমি বুঝি না। এ সব দিয়া আমি ফজলুল হককে বিচার করি না। আমি তাকে বিচার করি গোটা দেশ ও জাতির স্বার্থ দিয়া। একমাত্র ফজলুল হককে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বাঁচাতে পারে, সে মাথার চুল হতে পায়ের নখ পর্যন্ত বাঙালি।”
বাংলা মায়ের দামাল বাঙালি সন্তান এ, কে, ফজলুল হকের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়েই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঔপনিবেশিক শৃংখল মুক্ত হয়েছে। বাংলার মুক্ত স্বাধীন মাটিতে আজ আমরা তার জন্মশতবার্ষিকীতে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তার কর্মবহুল জীবন আমাদের চলার পথের পাথেয় হোক এই কামনাই করছি আমরা।
পরিশেষে আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করব যে, শেরে বাংলার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সারাদেশব্যাপী তার স্মৃতিচারণ, জন্ম উৎসব ও আলোচনা সভার আয়োজন করা উচিত ছিল। অথচ তেমনটি হয়নি। কেন হয়নি তার কারণ বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ না করেও আমরা বলব, আত্মতৃপ্তির অর্থই হলো অপমৃত্যু। এ অপমৃত্যু যেন আমাদের না হয় সেদিকে অবশ্যই সকলকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বাংলাদেশ-জাপান যুক্ত ইশতেহার

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোন্নত দেশ জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সৌহার্দ্য ও সহযোগিতা আজকের নতুন নয়। বহু আগে থেকেই আমাদের সঙ্গে জাপানের অটুট বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলে এসেছে।
এমনকি, আমাদের বিগত বিভীষিকাময় মুক্তিসংগ্রাম চলাকালেও জাপান ও জাপানিরা আমাদের মুক্তি-সংগ্রামে স্বার্থহীন সমর্থন জানিয়ে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের তৎকালীন আভ্যন্তরীণ অবস্থার এক নগ্ন চিত্র তুলে ধরে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানবতার মুক্তির সংগ্রাম কে সমর্থন জানাতে। এজন্য আমরা সত্যিই তাদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। সম্প্রতি, এ উভয় দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার অস্থায়ী ও ইস্পাতকঠিন হয়েছে আমাদের গৌরব প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছ’দিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় জাপান সফরের মাধ্যমে।
সফর শেষে গত বুধবার বিমানবন্দরে অবতরণ কালে এক সাংবাদিক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত গর্বের সাথে জানান যে, তার ও তার সঙ্গীদের এ সফর অত্যন্ত সফল ও ফলপ্রসূ হয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ-জাপানের একটি যৌথ ইশতেহারও প্রকাশিত হয়েছে। ইশতেহারে জানা যায় যে, বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়নে জাপান সব রকমের আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য দান করবে। দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে যাতে আরো সম্প্রসারিত হয় সেজন্য আলাপ আলোচনা চালাতে শিগগিরই একটি জাপানি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসছেন।
ইশতেহারে বলা হয়েছে যে, জাপান বাংলাদেশকে অত্যন্ত সহজ শর্তে ৯’শ কোটি ইয়েন বা প্রায় ২৫ কোটি টাকা জাপানি ঋণ দেবে। আর এমন সহজ শর্তে জাপান অন্য কোন উন্নয়নকামী দেশকেই এ পর্যন্ত ঋণ দান করেনি। এ সম্পর্কে যাবতীয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিতে শিগগিরই দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বৈঠক বসবে।
উভয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এশিয়ায় শান্তি বজায় রাখা এবং উন্নয়নমূলক কর্মকর্তা বৃদ্ধির জন্য ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ব্যাপারেও একমত হয়েছেন।
ইশতেহারে জাপানের প্রধানমন্ত্রী মিঃ তানাকা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে জরুরি ভিত্তিতে চাল সরবরাহ ও কৃষি উন্নয়নে জাপানি সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। ইতিপূর্বে সময় মতো বাংলাদেশকে চাল সরবরাহ করার জন্য বঙ্গবন্ধু জাপানি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেশের জোট নিরপেক্ষ আবাদ পররাষ্ট্র নীতির কথা উল্লেখ করে বলেন যে, সার্বভৌম ক্ষমতা, কারো আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক মতৈক্য এই নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের সমস্ত দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অসামান্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও ব্যক্তিগত পরিশ্রমের ফলে জাপানের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার যে নতুন দিগন্ত আজ উন্মোচিত হলো তার সর্বতোভাবে সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হয়ে বাংলাদেশের যাবতীয় সুখ সমৃদ্ধি আসুক এবং উভয় দেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক আমরা সর্বাস্তকরণে সেই কামনাই করি।

নোবেল পুরস্কার কমিটি এতোদিনের শ্রদ্ধা হারালেন

উত্তর ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা কমরেড লী ডাক থো সম্প্রতি দেয় নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিশ্ব শান্তির দূত হিসেবে লী ডাক থো ও ডঃ হেনরি কিসিঙ্গারকে যৌথভাবে নির্বাচিত করে নোবেল পুরস্কার প্রচার করা হয়েছিল। নোবেল পুরস্কারের এ হেন প্রহসন ঘোষিত হওয়ার পরই বিশ্বের বিবেকবান মানুষের মনে একটা বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। আমরাও আশঙ্কা করেছিলাম যে, সত্যিকারের মুক্তিকামী মানুষের নেতা ও শান্তির দূত লী ডাক থো নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করবেন। বিশ্বের নিরবচ্ছিন্ন শান্তির প্রত্যক্ষ শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কূটনীতিক ডঃ হেনরি কিসিঙ্গার এর সঙ্গে যুদ্ধ করে বীর ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা লী ডাক থো কে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা যে একটি নির্ভেজাল প্রহসন তা আমরা পূর্বাহ্নেই ব্যক্ত করেছিলাম। এবং তখনই আমরা সন্দেহ পোষণ করেছিলাম যে, সত্যিকারের শান্তিকামী ও মুক্তি সংগ্রামী নেতা লী ডাক থো আর যাই হোক হেনরি কিসিঙ্গার এর সঙ্গে যুক্তভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করবেন না। শেষ পর্যন্ত লী ডাক থো সেটাই করেছেন। লী ডাক থোর এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে নিঃসন্দেহে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। লী ডাক থো নোবেল পুরস্কার কমিটির কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে বলেছেন, সারগন কর্তৃপক্ষ ও তার মার্কিন দোসররা যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সে অবস্থায় তার পক্ষে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করা সম্ভব নয়। যখন প্যারিস চুক্তি সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়িত হবে সাম্রাজ্যবাদীদের কামান যখন ভিয়েতনামের মাটিতে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবে এবং শান্তি সুনিশ্চিত হবে কেবল তখনই তার পক্ষে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের ব্যাপারটি বিবেচনা করা সম্ভব।
যুদ্ধবাজ মার্কিন সাম্রাজ্যের যুদ্ধংদেহী নীতি সম্পর্কে বিশ্বের কোন মানুষের আজ আর কোনো সংশয় নেই। ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন পেন্টাগনের আগ্রাসন নীতি যখন নিদারুণ ভাবে মার খাচ্ছে তখন নিক্সন সরকার রণ ময়দান থেকে কূটনীতির টেবিলে আশ্রয় নিচ্ছে। প্যারিস শান্তি চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে মার্কিনের আগ্রহের চেয়ে পরাজয় ঢাকবার প্রচেষ্টাই বেশি। এখানে মার্কিন প্রতিনিধি ডঃ হেনরি কিসিঙ্গারের কোন কৃতিত্ব রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। সে ক্ষেত্রে উত্তর ভিয়েতনামের প্রতিনিধি লী ডাক থোর প্রভাব ও আগ্রহ ঐতিহাসিক। সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্যারিস শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের আগ্রহ শান্তিকামী মানুষের যেমন অত্যন্ত বেশি তেমনি আগ্রহ ভিয়েতনামেরও। কিন্তু মার্কিন আগ্রাসনবাদীদের চার বার অভিসন্ধি মুলক আচরণের জন্যই তার সম্ভব হয়নি। এবার প্যারিস শান্তি চুক্তিতে স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধের আশাবাদ নিয়ে সই করেছেন লী ডাক থো ও হেনরি কিসিঙ্গার। নোবেল পুরস্কার কমিটি বোধ করি একারণেই উল্লিখিত দু’জনকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের কথা বিবেচনা করেছেন। আর এই সিদ্ধান্তের দরুনই বোধহয় কমিটির দু’জন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। অবশ্য বিস্তারিত কোন সংবাদ এ ব্যাপারে আজো পাওয়া যায়নি। নোবেল পুরস্কার কমিটির ও বিশ্বের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের প্রতি মানুষের একটি স্বাভাবিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত কূটনীতিক যুদ্ধবাজ হেনরি কিসিঙ্গারকে নোবেল পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে নোবেল পুরস্কার কমিটির বিশ্বের বিবেকবান মানুষের শ্রদ্ধা হারিয়েছেন। নিঃসন্দেহে কমিটির প্রভুতুষ্টির মনোভাব এই সিদ্ধান্তের মধ্যে নিহিত বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা লী ডাক থোর নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান এর এই বিপ্লবী সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন