You dont have javascript enabled! Please enable it!

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে। এটি ছিল পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের বিরুদ্ধে এ নির্বাচন ছিল বাঙালিদের ব্যালট বিপ্লব। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ-এর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের কারণে বাঙালিদের এ বিজয় স্থায়ী হয়নি।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ নির্বাচন (১৯৪৬)-এর ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠিত এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচন থেকে হিসাব করলেও ৫ বছর শেষে ১৯৫১ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু নানা অজুহাতে শাসকগোষ্ঠী তা বিলম্বিত করে। ক্ষমতাসীন মুসিলম লীগের পরাজয়ের আশঙ্কা ছিল নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার প্রধান কারণ। ফলে পাকিস্তানের ২৪ বছরে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে এবং সে নির্বাচনে শাসকগোষ্ঠী সমর্থিত দলের পরাজয় ঘটে (দেখুন সত্তর সালের নির্বাচন)। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে টাঙ্গাইলের একটি শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে সরকারি দল মুসলিম লীগের প্রার্থী টাঙ্গাইলের বিখ্যাত জমিদার পরিবারের খুররম খান পন্নি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপ সমর্থিত তরুণ নেতা ও পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক (টাঙ্গাইলের শামসুল হক নামে খ্যাত)-এর নিকট পরাজয় বরণ করেন। এরপর পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের ৩৪টি আসনের উপনির্বাচন শাসকগোষ্ঠী বছরের পর বছর স্থগিত রাখে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচন পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাধীনে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক পরিষদের মোট ৩০৯টি আসনের মধ্যে (মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৫টি সহ) ২৩৭টি আসন (৯টি মহিলা আসন) মুসলমান সম্প্রদায় এবং ৭২টি আসন (৬টি মহিলা আসনসহ) অমুসলিমদের জন্য নির্ধারিত ছিল। ১৫টি মহিলা আসনের মধ্যে ৯টি মুসলমান, ১টি বর্ণহিন্দু, ২টি তফসিলি হিন্দু, ১টি খ্রিস্টান ও ২টি বৌদ্ধ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়।
ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনের প্রাক্কালে (ডিসেম্বর ১৯৫৩) সমমনা ৪টি বিরোধী রাজনৈতিক দল নিয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে একটি নির্বাচনী জোট গঠন করা হয়। জোটের শরিক দলসমূহ হচ্ছে- মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি (১৯৫৩), মওলানা আতাহার আলীর নেজাম-ই-ইসলাম এবং হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দল। গণতান্ত্রিক, মধ্যপন্থী, ইসলামিক, বামপন্থী ইত্যাদি নিয়ে যুক্তফ্রন্ট সত্যিকার অর্থে একটি ব্যাপকভিত্তিক জোটের রূপ লাভ করে। মুসলিম লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানি আধিপত্যের বিরোধিতা ছিল জোটের সাধারণ ভিত্তি। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর কর্ণধার। নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম যুক্তফ্রন্ট এমনি ২১টি দফা সম্বলিত একটি নির্বাচনী কর্মসূচি বা ইশতেহার গ্রহণ করে। এটি যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা নামে ইতিহাসখ্যাত। ২১-দফা কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ-
১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান।
২. বিনা ক্ষতিপূরণে সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিতকরণ এবং ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ।
৩. পাট ব্যবসার জাতীয়করণ। মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলে পাট সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির তদন্ত ও শাস্তি বিধান।
৪. কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন।
৫. লবণ তৈরির কারখানা স্থাপন। মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলে লবণ কেলেঙ্কারির তদন্ত ও শাস্তি বিধান।
৬. শিল্প ও কারিগর শ্রেণির মোহাজেরদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
৭. খাল খন ও সেচের ব্যবস্থা করে দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করা।
৮. শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা। আইএলও-র মূলনীতি অনুযায়ী শ্রমিকদের সকল প্রকার অধিকার নিশ্চিত করা।
৯. দেশের সর্বত্র একযোগে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন।
১০. কেবল মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করে একই পর্যায়ভুক্ত করা। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।
১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি কালাকানুন বাতিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ব্যবস্থা।
১২. শাসন ব্যয় হ্রাস করা। বেতনভোগীদের বেতনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান। মন্ত্রীর বেতন এক হাজারের বেশি না হওয়া।
১৩. ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করার লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৪. জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ করা। বিনাবিচারে আটক বন্দিদের মুক্তি দেয়া। সংবাদপত্র ও সভা- সমিতি করার অধিকার নিশ্চিত করা।
১৫. বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা।
১৬. পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর বাসভাবন ‘বর্ধমান হাউস’কে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে ‘বাংলাভাষার গবেষণাগারে’ পরিণত করা (বর্তমানে এটি বাংলা একাডেমি)।
১৭. ৫২-এর ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ।
১৮. ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা।
১৯. ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা। দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সবকিছু পূর্ব বাংলার সরকারের হাতে ন্যস্ত করা। আত্মরক্ষার স্বার্থে পূর্ব বাংলায় অস্ত্র নির্মাণ কারখানা স্থানান্তর করা।
২০. যুক্তফ্রন্টের সরকার কোনো অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ৬ মাস পূর্বে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
২১. আইন পরিষদের কোনো আসন শূন্য হলে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা পূরণ করা।
উল্লিখিত ২১-দফা কর্মসূচির মধ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন’ ও ‘পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি’ ছিল যুক্তফ্রন্টের প্রধান নির্বাচনী ইস্যু। প্রতীক ছিল নৌকা। যুক্তফ্রন্টের নেতারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর শাসন-শোষণ-নিয়ন্ত্রণ, দুই অংশের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্য এবং ভাষা-আন্দোলন- কালে ৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের সময় ছাত্র হত্যার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে ভোটারদের সম্মুখে তুলে ধরেন। এছাড়া তাঁরা একই মুসলিম লীগ সরকারের সময় ‘লবণ কেলেঙ্কারি’র ঘটনাও প্রচারণায় নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, তখন দুই থেকে তিন আনার প্রতি সের লবণের দাম বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ টাকা পর্যন্ত হয় এবং তা ভোটারসাধারণকে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করে। পক্ষান্তরে শাসকদল মুসলিম লীগের সুনির্দিষ্ট কোনো আর্থসামাজিক কর্মসূচি ছিল না। যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে এ দলের প্রচারনায় ‘ইসলাম বিপন্ন’, ‘পাকিস্তান বিপন্ন’, ‘কমিউনিস্ট’, ‘ভারতীয় চর’ ইত্যাদি বক্তব্য প্রাধান্য পায়।
নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন (প্রধান শরিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ এককভাবে ১৪৩টি) এবং প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৬৪ ভাগ ভোট লাভ করে। সরকারি দল মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন এবং শতকরা ২৭ ভাগ ভোট। নির্বাচনের পর স্বতন্ত্র প্রার্থী ফজলুল কাদের চৌধুরী মুসলিম লীগে ফিরে এলে এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০৯ আসনের মধ্যে ১০টি। বাকি ৫টি মুসলিম আসনের ৪টি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবং ১টি খেলাফতে রব্বানী পার্টির প্রার্থী লাভ করেন।
নির্বাচনের পর ৩রা এপ্রিল (১৯৫৪) শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ১৫ই মে ঐ মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করে আরো ১০ জন সদস্যকে তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন নতুন এ মন্ত্রিদের অন্যতম।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হাতে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। বস্তুত ঐ নির্বাচন ছিল কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির রাজনৈতিক শক্তির উত্থান। এ শক্তি যাতে সুসংহত হতে না পারে সেজন্য শুরু থেকেই শাসকগোষ্ঠী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় মাত্র ৫৬ দিনের ব্যবধানে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২(ক) ধারাবলে ৩০শে মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত এবং পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন কায়েম করে। এ ঘটনা বাঙালিদের প্রচণ্ডভাবে বিক্ষুব্ধ করে। পরবর্তী ঘটনাবলি বাঙালিদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: হারুন-অর-রশিদ, বাংলাদেশ : রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন, ১৭৫৭-২০১৮, ঢাকা, অন্যপ্রকাশ ২০১৮

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!