যুদ্ধশিশু
মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধসমূহের একটির ফসল ‘যুদ্ধশিশু’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বাংলাদেশী নারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যৌন অপরাধের ফলে জন্মলাভ করে যুদ্ধশিশু।
৭১-এর অক্টোবরের শুরু থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত গোপন স্থানে নবজাত সন্তানের জন্ম দিয়েই হতভাগ্য জন্মদাত্রী মাতাদের অনেকে সন্তান ত্যাগ করে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যান। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে শিশুদের অনুমিত পিতারা মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং কয়েক মাসের মধ্যে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতে চলে যায়।
যুদ্ধশিশুরা অবৈধতার কালিমা বহন করছিল। তাদের দেখা হয়েছিল ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া অবাঞ্ছিত শিশু হিসেবে। এর কারণ, তারা জন্মেছিল ভিকটিমের সম্মতি ব্যতীত জোরপূর্বক গর্ভধারণের ফলে। নবজাতকদের বিভিন্ন অভিধায় সম্বোধন করা হতো, যেমন ‘শত্রুর সন্তান’, ‘অবৈধ শিশু’, ‘মিশ্র রক্তের সন্তান’, ‘অপকর্মের সন্তান’, ‘বাজে বীজের বিযুক্তকরণ’ এবং আরো ঘৃণাভরে ‘জারজ সন্তান’।
সকল যুদ্ধশিশুই (পাকিস্তানি সামরিক সদস্য কর্তৃক ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া) ‘যুদ্ধ এতিম’, আবার যুদ্ধশিশু ছিল না। এর কারণ, যুদ্ধকালে কোনো শিশুকে পিতামাতা পরিত্যাগ করলে বা পিতামাতার মৃত্যু হলেই শিশুটি যুদ্ধশিশু হয়ে পড়ে না, এবং সকল ‘যুদ্ধ- এতিমই ‘অধিকৃত বাংলাদেশ’-এ সেনাসদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়নি।
ভিকটিমদের ধর্ষণ, যৌন আক্রমণ বা দাসত্বের যে সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তার কোনো দালিলিক প্রমাণ ছিল না। তবে সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘সেবাসদনে’ (ধর্ষণের শিকার নারীদের পুনর্বাসনে নারী পুনর্বাসন বোর্ড কর্তৃক সমগ্র বাংলাদেশে স্থাপিত ক্লিনিক ও ডেলিভারি কেন্দ্র) যে-সকল যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছিল, তাদের জন্ম, মৃত্যু বা পরিত্যক্ত হওয়ার শারীরিক ও বৈষয়িক প্রমাণ ছিল। তাই সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ‘শিশু সদন’ ও অন্যান্য এতিমখানা আমাদের একটি পথনির্দেশ প্রদান করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের কর্তৃক ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল; আর ২ লক্ষাধিক নারীকে হানাদারদের শিবিরসমূহে ধর্ষণ করা হয়েছিল, যার একটি বড় অংশের জোরপূর্বক গর্ভধারণ ঘটেছিল। আর এসব ধর্ষণের ফলে ২ থেকে ৪ হাজার যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছিল।
ধর্ষণের ঘটনা: অধিকৃত বাংলাদেশে ‘জোর যার মুলুক তার’- এর ভিত্তিতে নিষ্ঠুর ও বর্বর পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের কর্তৃক ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ ছিল একটি প্রাত্যহিক ঘটনা। তবে, কত সংখ্যক বাঙালি নারী সে সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে ঐকমত্য নেই।
দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৭০ দিন বাংলাদেশে অবস্থান করেছিল। এর ভিত্তিতে বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন কর্মসূচি একটি সমীকরণের মাধ্যমে হিসাব কষেছিল। তাদের হিসাবটা ছিল এরূপ: ৪৮০ (থানা) x ২৭০ (দিন) x ২ (নারী) = ২৬৮,২০০ (নারী)। তবে মোটা দাগে ২ লক্ষ সংখ্যাটি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। তখন থেকে এটাই তথ্যসূত্র ও সরকারি সংখ্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত সংখ্যা পর্যালোচনা করে ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড প্যারেন্টহুড ফেডারেশন (আইপিপিএফ)-এর তৎকালীন পরিচালক ড. জিওফ্রে ডেভিস যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, সংখ্যাটি আরো অনেক বৃদ্ধি পেতে পারে।
যে ১ কোটি শরণার্থী ভারতে চলে গিয়েছিল তাদের বাদ দিলে অধিকৃত বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ কোটি। এর মধ্যে ১১ লক্ষের মতো নারী ছিল প্রজননক্ষম বয়সের। ড. ডেভিস যুক্তি তুলে ধরেন যে, তাদের মধ্যে এক- তৃতীয়াংশকে যদি ধর্ষণ করা হয়ে থাকে, তাহলে ভিকটিমের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লক্ষ। বিডব্যুআরপি’র তৎকালীন সভাপতি বিচারপতি কে এম সোবহান ড. ডেভিসের হিসাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছিলেন।
জোরপূর্বক গর্ভধারণের ঘটনা: ধর্ষণের শিকার নারীদের সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা জানা না থাকায় তাদের মধ্যে কতজন গর্ভধারণ করেছিলেন তা নির্ণয় করা আরো কষ্টসাধ্য। ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী ছিলেন প্রথম ধর্ষিতা যিনি জনসমক্ষে সংবাদমাধ্যমের নিকট প্রকাশ করেছিলেন কী বিপজ্জনক পরিবেশে আটক নারীদের যৌনদাসী হিসেবে রাখা হতো।
গর্ভধারণের ফলে অথবা যৌনব্যাধিগত কারণে যখন তাদের আর ব্যবহারোপযোগী মনে হয়নি, তখন ধর্ষণের শিকার অনেক নারীকে সেনাসদস্যরা ছেড়ে দিয়েছিল। যদি ৪৮০টি থানার অর্ধেকের জন্য প্রতি থানায় ১৫০০ জনের হিসাবটি অনুমিত হয়, তাহলে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার সংখ্যাটি উঠে আসে, যার সঙ্গে ড. ডেভিস একমত হয়েছিলেন।
তবে এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে ও মনে রাখতে হবে যে, যেসব ধর্ষিতা নারী আত্মহত্যা করেছিলেন অথবা সেনাসদস্য দ্বারা নিহত হয়েছিলেন তাদের বিষয়ে ড. ডেভিসের নিকট কোনো তথ্য ছিল না। তাছাড়া ড. ডেভিসের হিসাবে তৎকালীন বাংলাদেশের ১৭ জেলার সবকয়টি সম্পর্কে তথ্য ছিল না। তাই ধর্ষণের শিকার ও গর্ভধারণ করা নারীর প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় এবং তা ৫ লাখের মতো হবে।
গর্ভপাতের ঘটনা: সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে গর্ভধারণের বিষয়টি ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধির ৩১২ ও ৩১৩ ধারা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ছিল। তাতে বলা ছিল যে, যদি কোনো নারীর গর্ভপাত ঘটানো হয় এবং তা যদি নারীর জীবন রক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিশ্বাসে সংঘটিত না হয়, তাহলে শাস্তি পেতে হবে। আইনটির অস্পষ্টতা এবং তার এলোমেলো প্রয়োগের ফলে কোনটা আইনসম্মত আর কোনটা আইনবিরোধী তা নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য ছিল।
প্রতিটি শহরের ডেপুটি কমিশনার, সিভিল সার্জন ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার স্বাক্ষরে প্রেরিত প্রতিবেদন ছিল গর্ভপাত বিষয়ক তথ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। চিকিৎসক হালিমা হানুম আখতার, মোহাম্মদ এ বাসেদ, বিরল মল্লিক প্রমুখের সাক্ষাৎকার থেকে এসব প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করা সম্ভব ছিল।
আবার, ড. ডেভিস অনুমান করেছিলেন যে, ধর্ষণের শিকার অধিকাংশ নারীকে ধাত্রী, হাতুড়ে বা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার চিকিৎসা দিয়েছিল। ফলে শেষপর্যন্ত গর্ভবতী নারীর সংখ্যা হয়তো অল্পই ছিল। যখন তিনি দূরবর্তী গ্রামসমূহ সফর করেন, তখন তিনি তাঁর বিশ্বাসের চেয়ে কমসংখ্যক অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের প্রমাণ পেয়েছিলেন, যদিও যৌন সহিংসতা শুরু হয়েছিল ৭১-এর ২৫শে মার্চ রাত থেকেই। ধর্ষণের শিকার নারীরা ৭১-এর অক্টোবর থেকেই জন্মদান শুরু করেন। ড. ডেভিসের মতে, সকল গর্ভধারণের ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পূর্বেই ডেলিভারি সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশে সংঘটিত গর্ভপাতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা ধার্য করা অসম্ভব ছিল, কারণ সেগুলো ঘটানো হয়েছিল অন্যদের অজান্তে।
আরেকটি প্রচলিত কথা আছে যে, বাংলাদেশ পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী কর্তৃক অধিকৃত থাকা অবস্থায় অনেক পরিবারের ধর্ষণের শিকার গর্ভধারিণী নারীরা ভারতে গিয়ে গর্ভপাত ঘটিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরও অনেক পরিবারেই এ প্রথা প্রচলিত ছিল, তবে তা সর্বোচ্চ মাত্রায় গোপনীয়তা বজায় রেখে।
জন্মদানের ঘটনা: একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যুদ্ধশিশুরা জন্মলাভ করেছিল। এটা সেসব মায়েদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল যারা সময়মতো গর্ভপাত না ঘটাতে পেরে তাদের গর্ভধারণকে পূর্ণ মেয়াদে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। যদিও অধিকাংশ গর্ভধারিণী মা সফলভাবে গর্ভপাত ঘটিয়েছিলেন, তারপরও অনেকে এক্ষেত্রে ব্যর্থও হয়েছিলেন। আবার অনেকে গর্ভপাত ঘটানোর বিরোধী ছিলেন। সরকার বলেছিল, যারা গর্ভপাত ঘটাতে চায় তাদের যেন সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষার মাধ্যমে সে ধরনের সুযোগ দেয়া হয়। যদি কোনো গর্ভধারিণী মায়ের গর্ভপাত ঘটাতে বিলম্ব হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে নবজাতকের জন্ম দিয়ে শিশুটিকে সরকারের কাছে হস্তান্তরের জন্য মাকে উৎসাহ দেয়ার কথা বলা হয়েছিল।
ফ্রেড ও বনি কাপুচিনোর নেতৃত্বে একটি কানাডীয় দল ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিল কিছুসংখ্যক যুদ্ধশিশুকে কানাডীয় নিবাস বা সদনে দত্তক হিসেবে নেয়ার জন্য। এটা ছিল তথ্যের আরেকটি উৎস। যদিও ধারণা করা হয়েছিল যে, ৫ হাজার যুদ্ধশিশুর জন্ম হবে, তবে স্বাধীনতা অর্জনের পর সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। জেনেভাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিস (আইএসএস)-এর পরামর্শক নিশ্চিত করেছিলেন যে, এ ধরনের শিশুদের সংখ্যা অজানাই থেকে যাবে। এ কারণে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কালিমা লেপনের আশঙ্কায় তৎকালীন পরিস্থিতিতে যুদ্ধশিশু ও তাদের মায়েদের দেখা না দেয়ার একটি ভিত্তি গড়ে ওঠে।
শিশু ভবনের দলিলাদি পরীক্ষা করতে গেলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হতো। কারণ তাদের বিবরণীতে ‘এতিম’, ‘পরিত্যক্ত’ ও ‘অবৈধ’ শিশুদের পিতারা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানি সেনাসদস্য ছিল না। যেহেতু এ সংখ্যার কোনো কঠিন প্রমাণ ছিল না, তাই এ উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যে, বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের সংখ্যা ২-৩ হাজার ছিল।
মৃত্যুবরণের ঘটনা: ১৯৭২-এর শুরুর দিকে সংবাদ মাধ্যম যুদ্ধশিশুদের জন্ম ও মৃত্যুর বিষয়টি অবিশ্রান্তভাবে তুলে ধরে। তারা অনেক ছোট শিশুর গলিত লাশের কথা উল্লেখ করে, যেগুলো মানুষ রাস্তায় খুঁজে পেয়েছিল। জন্মের সময় মৃত এবং অত্যন্ত দুর্বল ও অকালে জন্ম নেয়া অনেক শিশুর কাহিনী প্রচলিত ছিল যারা জন্মের পরপরই মারা যায়। তাছাড়া লজ্জা ও অপমান এড়ানোর জন্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক শিশুদের বস্তায় ভরে গোপনে দাফনেরও গুজব রটেছিল। এসব ক্ষেত্রে কোনো মানসম্মত বা ধর্মীয় দাফন- পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। অনেক শিশুকে কেবল কাপড় দ্বারা মোড়ানো হয়েছিল এবং গর্তে চাপা দেয়া অথবা নিকটবর্তী খাল বা নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। সরকারি পরিসংখ্যানের অভাবে সে-সময় মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাতের পরিস্থিতি বিবেচনায় সাধারণ ঐকমত্য ছিল যে, বৈরি পরিবেশে শিশুদের ন্যূনতম চিকিৎসা সেবা প্রদানও সম্ভব হয়নি। ফলে অনেককেই জন্মের সঙ্গে-সঙ্গেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।
বিষয়টিকে যেকোনোভাবেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হোক না কেন, যুদ্ধশিশুদের জন্ম ও মৃত্যুর সংখ্যাগত বিবরণী প্রস্তুত করা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে। দুঃখজনকভাবে, বেপরোয়া মায়েরা গর্ভপাতের মাধ্যমে প্রাণনাশের যে চেষ্টা করেছিলেন, তা কালক্রমে শিশুর জন্মের অব্যবহিত পর মৃত্যুর মাধ্যমে বাস্তব রূপ পেয়েছিল। এ মৃত্যুর কোনো কঠিন সংখ্যা পাওয়া যায়নি বা তা অনুমান করাও সম্ভব হয়নি।
পরিত্যাগ করার ঘটনা: শিশুর প্রকৃত পিতার অবর্তমানে অনেক জন্মদাত্রী মাতা শিশুকে নিরুপায় হয়ে পরিত্যাগ করেছিলেন। আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে এর অর্থ ছিল, শিশুর জৈবনিক পিতা (যে আশেপাশে ছিল না) এবং মাতা (যে ত্যাগ করতে চেয়েছিল) কর্তৃক শিশুটিকে পরিত্যাগ করা, যার ফলে তাদের অভিভাবকত্বের অধিকার বিনষ্ট হয়ে পড়ে।
এক্ষেত্রে কেউ পরিসংখ্যান প্রাক্কলন করতে গেলে তাকে ধর্ষণের ঘটনা, জোরপূর্বক গর্ভধারণ করানো এবং যুদ্ধশিশুদের জন্ম ও মৃত্যুর সংখ্যা নিরূপণের মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এটা জানা কথা যে, অনেক যুদ্ধশিশুকে এতিমখানার বাইরে ঝুড়ির মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছিল। সম্পদ ও লোকবলের সংকটে জর্জরিত অতিরিক্ত বোঝা বহনকারী এতিমখানাগুলোর কর্মচারীরা নবজাতকদের পুনর্বাসন করতে আন্তর্জাতিক সহায়তার আশায় মরণপণ কাজ চালিয়ে গিয়েছিল। যে পরিস্থিতিতে পরিত্যাগের ঘটনাগুলো ঘটেছিল, সেটা বিবেচনায় নিলে ধর্ষণের ফলে যুদ্ধশিশুদের জন্ম, পরিত্যাগ ও দত্তক নেয়ার সংখ্যা নির্ধারণ সমস্যাসংকুলই থেকে যায়।
আন্তর্দেশীয় স্তরে পোষ্য প্রদানের জন্য সরকারি উদ্যোগ: রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের ক্ষতিকর রাজনীতির ফলে আরো কালিমা লেপন হবে এ আশঙ্কায় সরকার আইএসএস ও অন্যান্য মুখ্য অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে বাস্তবসম্মত সমাধানের লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে গিয়েছিল। এ কর্মসূচিগুলো ছিল ভবিষ্যৎমুখী ও পরিবর্তনকামী। এর অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল ‘শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা করা’। আইএসএস অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আন্তর্দেশীয় দত্তক প্রদানকে একটি ভালো ও ভবিষ্যৎমুখী বিকল্প হিসেবে দেখেছিল। সরকার সমাজ ও তার অগ্রাধিকারের অদ্ভুত উদ্যোগকে মেনে নিয়েছিল এবং বিষয়টি মোকাবেলায় কুশলী হয়েছিল। যুদ্ধশিশুদের বিদেশে দত্তক হিসেবে প্রদানের ব্যাপারেও সরকার সম্মত ছিল। এর কারণ ছিল, নিজ পরিবারের সঙ্গে বন্ধনবিহীন যুদ্ধশিশুর সর্বোত্তম গৃহ-পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার থাকা, এমনকি তা ভিনদেশে বা এমন অভিভাবকের গৃহে হলেও যার জাতিগত পরিচয় ভিন্ন।
সরকার ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে নতুন রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করতে সমর্থ হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল The Bangladesh Abandoned Children (Special Provisions) Order, 1972 [বাংলাদেশ পরিত্যক্ত শিশু (বিশেষ বিধান) আদেশ, ১৯৭২]। সময়ের বিচারে এটা ছিল মূলত একটি বিশেষ আইন। তবে একটি ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৮৪ সালের ২৪শে মার্চ এটি বাতিল করা হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দত্তক গ্রহণ: বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার দত্তক গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যেমন অভিভাবকত্ব এবং আনুষ্ঠানিক পোষ্য গ্রহণ, যেগুলো আবশ্যিকভাবে পশ্চিমা দেশসমূহের অনুরূপ নয়। ‘বিধিবদ্ধ অভিভাবকত্ব’ গ্রহণ করে সিস্টার মার্গারেট মেরী দম্পতিদের পিতৃ-মাতৃত্ব বজায় রেখে কালিমা লাঘবের প্রয়াস চালিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সেটা স্থানীয়ভাবে করার ক্ষেত্রে সফল হননি। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাগ্রসর নাগরিকদের মনে দত্তক গ্রহণের ব্যাপারে হয়তো পরিবর্তন ঘটছিল, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেশটি একটি বদ্ধ ছাঁচেই আবদ্ধ ছিল।
কেউ এ দেশে যুদ্ধ শিশুকে দত্তক নেয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে, এমন কথা কখনো শোনা যায়নি। কেউ যদি এসেও থাকে, তার কোনো দলিল নেই। বরং পরিত্যাগ করার উচ্চহার দেখে বিশ্বব্যাপী অনেক দম্পতি কিছু বাংলাদেশী যুদ্ধশিশুকে পোষ্য হিসেবে গ্রহণের সুযোগটি কাজে লাগায়।
পোষ্য গ্রহণের ব্যাপারে যাদের প্রবল আপত্তি ছিল, তারা বিষয়টিকে দেখেছে ‘অনাহূত’ শিশুদের ‘সর্বোচ্চ স্বার্থে’ পরিবার সৃষ্টির সরকারি উদ্যোগ হিসেবে। একে কেউ-কেউ দেখেছে ‘বিদেশে পোষ্য প্রদান-এর নামে সরকারি ঔদাসীন্য ”এবং দায়িত্ব এড়িয়ে তা অন্যের ওপর চাপানো হিসেবে। যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়ার কানাডীয় উদ্যোগ: ঢাকাভিত্তিক Missionaries of Charity-তে মাদার তেরেসা ও তাঁর সহকর্মীদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং মন্ট্রিল-ভিত্তিক অলাভজনক আন্তর্দেশীয় দত্তক এজেন্সি Families For Children (FFC)-এর প্রয়াসের ফলে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় কানাডীয় গৃহে যুদ্ধশিশুদের দত্তক গ্রহণ সম্ভবপর হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে কানাডা ছিল বিশ্বের প্রথম দেশ যারা ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে যুদ্ধশিশুদের ১৫ জনের প্রথম দলটিকে দত্তক হিসেবে কানাডীয় নিবাসে গ্রহণ করেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, দি নেদারল্যান্ড্স, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশও হোল্ট এডপশান প্রোগ্রাম ইন্ক এবং তেরে দেস হোম্স-এর মাধ্যমে বাংলাদেশী যুদ্ধশিশুদের দত্তক হিসেবে গ্রহণ করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুদ্ধশিশুদের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ অথবা দত্তক হিসেবে তাদের পরিণতির কোনো দালিলিক প্রমাণ আজ অবশিষ্ট নেই।
যুদ্ধশিশুদের জন্ম, মৃত্যু, পরিত্যাগ বা পোষ্য হিসেবে গ্রহণ সম্পর্কে তথ্য খুঁজতে গেলে মৌখিক সংখ্যা ব্যতীত বাংলাদেশে আর কোনো নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যাবে না। ফলে জন্ম ও দত্তক প্রদান সম্পর্কিত যে-কোনো পরিসংখ্যান ইতিহাসের আলোকেই মূল্যায়ন করতে হবে। [মুস্তফা চৌধুরী]
তথ্যসূত্র: Geoffrey Davis “The Changing Face of Genocide Bangladesh”, Proceedings of the Medical Association for Prevention of War, vol. 2, Part 7, June 1973; মুস্তাফা চৌধুরী, ‘৭১- এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস, ঢাকা, একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি ২০১৫; ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিস (আমেরিকান ব্রাঞ্চ), কনসাল্ট্যান্ট’স রিপোর্টস, ১৯৭২, রেফারেন্স # ১১১৫/বাংলাদেশ
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড