যুব শিবির
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ছাত্র-যুবক- তরুণ-কিশোরদের নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে ৩২টি যুব শিবির স্থাপিত হয়েছিল। এসব শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রহ, বাছাই, উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হতো। প্রধানত বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে ছাত্র-যুবকদের এসব শিবিরে আনা হতো। এসব শিবির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য শক্তির উৎস ছিল।
পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার মুখে সীমান্ত অঞ্চলে যেসব স্থান দিয়ে সকল পর্যায়ের জনগণ, বিশেষত যুব-কিশোর সম্প্রদায় সীমান্ত অতিক্রম করত, সেসব স্থানেই অধিকাংশ যুব শিবির স্থাপিত হয়। এসব শিবির অভ্যর্থনা শিবির হিসেবেও গণ্য হতো। কারণ, সীমান্ত পার হয়েই সকলে এসব শিবিরে তাদের নাম লেখাত। অভ্যর্থনা শিবির প্রকৃত অর্থে উদ্বাস্তুদের একটি স্থান হিসেবে পরিগণিত হতো।
যুব শিবির সম্পর্কে ধারণাটি ড. হাবিবুর রহমানের। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ছদ্মনাম ছিল ড. আবু ইউসুফ। তিনি জিওলোজিক্যাল সার্ভে অব পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি আগরতলায় বসে প্রথম এ সম্বন্ধে ভাবনা-চিন্তা করেন। তাঁর ধারণা (concept) ছিল সহজ ও যুক্তিপূর্ণ। ভারতে আগত শরণার্থীদের সে দেশের সরকার আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা দিচ্ছিল। সেজন্য প্রয়োজন ছিল বিপুল পরিমাণ তাঁবু ও রেশন এবং কিছু অর্থ।
বাংলাদেশ সরকার-এর তরফ থেকেও সাধ্যমতো সবরকম সাহায্য করা হচ্ছিল। এ শরণার্থীদের মধ্যে বিরাট একটি অংশ ছিল ছাত্র, যুবক, কৃষক, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মী (আওয়ামী লীগ- ও ছাত্রলীগ-এর সংখ্যা ছিল সর্বাধিক)। এরা আশ্রয়ের জন্য ভারতে যায়নি, গিয়েছিল দেশমাতৃকার ডাকে, দেশকে মুক্ত করার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে। তার জন্য প্রয়োজন ছিল শৃঙ্খলা, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদানেই শেষ নয়, তার চেয়ে বড় বিষয় সর্বোচ্চ শৃঙ্খলাবোধের সঙ্গে নিয়ম-নীতির মধ্যে থেকে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ। অন্য কথায়, একটি শৃঙ্খলা-ক্রমে (chain of command) থেকে নির্ধারিত সমরকৌশল অবলম্বন করে যুদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক।
যে ধারণাটি ড. আবু ইউসুফ উপস্থাপন করেন তা ছিল এ- রকম: (ক) আশ্রয়গ্রহণকারীদের মধ্যে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য ভিন্ন শিবির স্থাপন; (খ) প্রথম স্তরে যে-শিবিরে তাদের নেয়া হবে সেগুলো হবে অভ্যর্থনা শিবির (reception camp)। এখানে তাদের শারীরিক শিক্ষা (physical training), মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণ (motivation) এবং শৃঙ্খলাবোধ (discipline) সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে; (গ) প্রশিক্ষণ শেষে বাছাইকৃত উপযুক্ত ব্যক্তিকে যথাপোযুক্ত ক্ষেত্রে নিয়োগ করা হবে। একদল যাবে মূল বাহিনীতে (base training); আরেক দল যাবে নিয়মিত বাহিনীর (regular force) সঙ্গে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিতে; কোনো দল যাবে তথ্য সংগ্রহ ও রেকি (intelligence reconaissance) করতে; অন্য আরেকটি বিশেষ দলকে, যারা ছাত্রলীগের সদস্য, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে ছাত্র- যুবনেতাদের কমান্ডে; (ঘ) যুব শিবির ভারত সরকারের জন্য অতিরিক্ত বোঝা হবে না, এজন্য বাড়তি খরচও হবে না। যে তাঁবু আর রেশন শরণার্থী শিবিরে পাওয়া যাবে তা অন্যত্র পৃথক অভ্যর্থনা শিবিরে সরবরাহ করলেই চলবে; (ঙ) উদ্বুদ্ধকরণ (motivation) এবং শৃঙ্খলা সম্বন্ধে জ্ঞানদান ও শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব হবে বাংলাদেশ সরকারের; (চ) পরবর্তীকালে মিলিটারি প্রশিক্ষণ (অধিকাংশই গেরিলা) এবং অস্ত্র সরবরাহ করার দায়িত্ব থাকবে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের ওপর যৌথভাবে। সেক্টর কমান্ডাররা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন।
প্রয়োজনের তুলনায় শিবিরগুলোর কর্মপরিধি বেশ সীমিত ছিল। নানাবিধ সীমাবদ্ধতার মাঝেও যুব শিবিরের কাজ থেমে থাকেনি। যুব শিবিরগুলো সব সময় সক্রিয় ছিল। প্রধানত যেসব যুব শিবিরে প্রাথমিক কাজকর্ম চালু রাখা হয়, সেগুলো হলো- ১. হরিণা শিবির: এখানে এক হাজার তরুণকে প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা ছিল। এ শিবির ঠিক সীমান্ত বরাবর ছিল না, সীমান্ত থেকে কিছু দূরে ছিল। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান এ শিবিরের প্রধান ছিলেন; ২. ছোটখোলা শিবির (একিনপুর সংলগ্ন): এ শিবির সীমান্ত-সংলগ্ন হওয়ায় আরো অভ্যন্তরে সরানোর কথা ভাবা হয়। এখানে ৪০০ তরুণকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সুযোগ ছিল। এ শিবিরের প্রধান ছিলেন নোয়াখালী- ২ আসন থেকে নির্বাচিত এমএনএ খাজা আহমেদ; ৩. রাজানগর যুবশিবির: নোয়াখালী-৭ আসন থেকে নির্বাচিত এমএনএ অধ্যাপক এ হানিফ ছিলেন এর প্রধান। এ শিবিরে ১ হাজার তরুণের প্রশিক্ষণ দেয়ার মতো সুবিধা ছিল। প্রাথমিকভাবে ৪০০ তরুণকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বহু প্রতিকূলতার মধ্যে এ শিবিরের কাজকর্ম পরিচালিত হয়; ৪. সোনামুড়া যুবশিবির: সোনামুড়া এলাকায় ৪টি শিবির স্থাপন করা হয়েছিল, যেমন- কাঁঠালিয়া, হাতিমারা, বক্সনগর ও মেলাঘর শিবির। কুমিল্লা-১৯ থেকে নির্বাচিত এমপিএ জালাল আহমেদ, কুমিল্লা-৯ আসন থেকে নির্বাচিত এমপিএ এম এ রশিদ ও অধ্যাপক এ রউফ (অধ্যক্ষ, অজিত গুহ কলেজ, কুমিল্লা) যথাক্রমে কাঁঠালিয়া, হাতিমারা ও বক্সনগর শিবিরের প্রধান ছিলেন। মেলাঘর যুবশিবির সেক্টর-২-এর সঙ্গে যুক্ত থাকায় প্রথমদিকে এ শিবিরের কোনো প্রধান ছিলেন না; ৫. উদয়পুর যুবশিবির: স্থানীয় এডিশনাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মি. ব্যানার্জীর সহযোগিতায় এ শিবিরের কার্যক্রম খুব দৃশ্যমান ছিল। ক্যাপ্টেন আলী এমএনএ এ শিবিরের প্রধান ছিলেন। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী এ শিবির স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল; ৬. মোহনপুর যুবশিবির: এ শিবিরের প্রধান ছিলেন ঢাকা-১৬ আসন থেকে নির্বাচিত এমপিএ শরীফুদ্দিন আহমেদ। এ শিবিরের প্রাথমিক সমস্যা সমাধানে ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী বিশেষ ভূমিকা পালন করেন; ৭. সিলেট যুবশিবির সিলেট সেক্টরে তিনটি অভ্যর্থনা শিবির ছিল। এগুলো পাথরকান্দি, খোয়াই ও কৈলাশহর শিবির নামে পরিচিত ছিল। এ ৩ শিবিরের প্রধান ছিলেন যথাক্রমে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মোমেন, সিলেট-১৭ আসন থেকে নির্বাচিত এমপিএ এনামুল হক মুস্তাফা শহীদ ও সিলেট-৩ আসন থেকে নির্বাচিত এমএনএ মানিক চৌধুরী।
উপর্যুক্ত শিবিরগুলো ছাড়া আরো কিছু স্থানে যুব শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সিলেট-১২ আসন থেকে নির্বাচিত এমপিএ তাইমুছ আলীর নেতৃত্বে ধর্মনগর, কুমিল্লা-৩ আসন থেকে নির্বাচিত এমএনএ দেওয়ান আবদুল আব্বাসের নেতৃত্বে নারসিনগর, ঢাকা-২২ আসন থেকে নির্বাচিত এমপিএ গাজী ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে বেলতলি নামক স্থানে যুব শিবির স্থাপন করা হয়েছিল। আগরতলার কংগ্রেস ভবনে অভ্যর্থনা শিবিরকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শরণার্থী হিসেবে আগত তরুণদের স্থানান্তর কেন্দ্র (transit camp) হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল।
ভয়ানক সঙ্কটময় পরিবেশ ও আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যেও সংশ্লিষ্ট সকলের গভীর দেশপ্রেমের কারণে যুব শিবিরের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশপ্রেমের মনোভাব প্রতিটি বাঙালি তথা শরণার্থীকে আপুত করে রেখেছিল। দেশপ্রেমের মন্ত্রে আবিষ্ট তরুণরা এসব যুবশিবিরের কর্মে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন। কোনো বাধা-বিপত্তি-অসুবিধা যুব শিবিরকে কখনো হীনবল করেনি। প্রথমদিকে কিছু অসুবিধা থাকলেও তা দ্রুত দূরীভূত হয়। শরণার্থী শিবির থেকেই যুব শিবিরের উৎপত্তি। তাই স্বাভাবিক কারণে যুব শিবিরের নিয়ন্ত্রণ প্রথমে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের (মন্ত্রী শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান) অধীন ছিল। প্রফেসর ইউসুফ আলী এমএনএ যুব শিবির বোর্ডের চেয়ারম্যান হলে এটি মোটামুটি একটি স্বতন্ত্র ও শিক্তিশালী অবস্থান লাভ করে। কিন্তু যেহেতু মূল লক্ষ্য ছিল যুবকদের যুদ্ধে প্রেরণ করা, তাই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুব শিবিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল মন্ত্রিপরিষদে যুব শিবির পরিকল্পনা সম্বন্ধে প্রথম আলোচনা হয় ২২শে জুনের সভায়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ- আলোচনার বিষয়বস্তু স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করেন। যুব শিবিরের সংখ্যা জুন মাসে মোট ১৭টি হলেও জুলাই মাসে তা ৩২-এ উন্নীত হয়। ৩২টি যুব শিবির হলো- বক্সনগর, বেলতলী, চারিপাড়া, কংগ্রেস ভবন, চোটাখোলা, ধর্মনগর, দুর্গা চৌধুরীপাড়া-বিজনা, দুর্গা চৌধুরীপাড়া-গুমতি, দুর্গা চৌধুরীপাড়া-ইছামতি, গোকুলনগর, গোকুলনগর-মেঘনা, গোকুলনগর-পদ্মা, হরিনা, হাতিমারা, হাপানিয়া, হাপানিয়া-বহ্মপুত্র, হাপানিয়া-গুমতি, হাপানিয়া-যুমুনা, হাপানিয়া-তিতাস, জয়নগর, কাঁঠালিয়া (বড়মুরা), কৈলাশহর, খোয়াই, মেলাঘর, মোহনপুর, মোতিনগর, পালাটোনা, পাথেরকান্দী, রাজনগর (রাধানগর), শিলাছড়া, শ্রীনগর ও উদয়পুর। জুন মাসে ১৭টি শিবিরের ভারপ্রাপ্ত সবাই ছিলেন জাতীয় অথবা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (দুই একজন ব্যতিক্রম ছিলেন, যেমন- এম এ হান্নান, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং আরেকজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন)। শিবিরগুলিতে ৮টি জেলার ৪৮৫০ জন সদস্য ছিলেন।
যুব শিবিরের বিভিন্ন ক্যাম্পে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং প্রদানের জন্য হাজার-হাজার তরুণকে প্রশিক্ষিত করা হয়।
মুক্তিবাহিনী তে নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণের পূর্বে চূড়ান্তভাবে এসব তরুণকে নির্বাচিত করার জন্য সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং- এর ব্যবস্থা করা হয়। যুব শিবিরে সমবেত তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে সরকারের কিছু নীতিমালা ছিল। এজন্য বহু তরুণকে অনেক সময় ধরে শিবিরে অবস্থান করতে হতো। এতে অনেকের মধ্যে এক ধরনের হতাশা দেখা দিত। হতাশা যাতে তাদের গ্রাস করতে না পারে, সেজন্য এ ট্রেনিং-এর পরিকল্পনা নেয়া হয়। ট্রেনিং-এর আওতায় প্রাথমিক চিকিৎসা-ব্যবস্থা, অগ্নি-নির্বাপণ, কিছু বোমা সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান, বোমার কার্যকারিতা ও এ থেকে আত্মরক্ষার উপায় ইত্যাদি সম্বন্ধে শিক্ষা দেয়া হতো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হতো। একজন পরিচালকের অধীন বিভিন্ন অঞ্চলে (zone) সহপরিচালক ছাড়াও অন্যান্য কর্মচারী ছিলেন। তাদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে নির্বাহ করা হতো। যুব শিবিরে আশ্রিত তরুণদের প্রাথমিকভাবে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং-এর জন্য প্রয়োজনীয় সিলেবাস ছিল।
মুক্তিবাহিনী গতানুগতিক যুদ্ধে (conventional warfare) পাকিস্তানিদের বাধা দেয়া শুরু করে নতুন-নতুন রণকৌশলে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করছিল। গেরিলা কায়দায় ওঁৎ পাতা (ambush), পেছন থেকে অতর্কিত আক্রমণ, শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্নকরণ, গোয়েন্দা-তথ্য সংগ্রহ করা ইত্যাদি উপায়ে পাকিস্তানিদের বিপর্যস্ত করা হচ্ছিল। এসব কারণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল সক্ষম, সাহসী ও দেশপ্রেমিক মানুষ। এক কথায়, জনবল সংগ্রহ করা। জনবলের কোনো অভাব ছিল না। বিশেষ করে ছাত্র-যুব সম্প্রদায় ঝাঁপিয়ে পড়তে চাচ্ছিল দেশের স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু সমস্যা ছিল বাছাই করা। বিভিন্ন পয়েন্ট এবং শরণার্থী শিবির থেকে আগ্রহী যুবকদের আনতে হতো বিশেষ ক্যাম্পে। সেখানে হতো প্রাথমিক বাছাই এবং তারপর মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এ ক্যাম্পগুলোকে বলা হতো মৌলিক শিবির (basic camp)। এখানে এদের মনোবল চাঙা করতে বিশেষ উদ্ধুব্ধকরণ (motivation) প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। তারপর এখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সেক্টর কমান্ডাররা নিয়ে যেতেন। তাঁরা কোনো গ্রুপকে অস্ত্র ও সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং দিয়ে নিয়মিত বাহিনীর কাছে বা নিজেদের সঙ্গে রেখে যুদ্ধ করাতেন বা শত্রুদের অবস্থান ও অন্যান্য খবর নিতে দেশের মধ্যে পাঠাতেন, আবার কোনো গ্রুপকে বিশেষ গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে আক্রমণের জন্য পাঠাতেন। ঢাকা এবং পাশ্ববর্তী এলাকায় যে-সমস্ত স্কোয়াড পাঠানো হতো ছোট স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, গ্রেনেড এবং নিশ্চিহ্নকরণ (demolition) সরঞ্জাম দিয়ে, তাদের অধিকাংশই ছিল খালেদ মোশাররফ ও সফিউল্লাহর সেক্টরে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। অত্যন্ত সাহসী ও বুদ্ধিমান, অস্ত্র পরিচালনা এবং গেরিলাযুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী যারা, শুধু তাঁদেরই পাঠানো হতো দেশের অভ্যন্তরে এবং অত্যন্ত গভীর অঞ্চলে।
ভারতীয় বাহিনীও যুব শিবির থেকে বাছাই করা গেরিলাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত। যুদ্ধে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন এবং ছাত্রলীগের সদস্যদের নিয়ে মুজিব বাহিনী নামে পৃথক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। তাঁদের প্রধান সংগঠক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। এছাড়াও মুজিব বাহিনীতে যাঁরা বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের মধ্যে আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরে আলম জিকু, সৈয়দ আহমদ প্রমুখ ছাত্রনেতার নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শক্তিঘর (power house) ছিল যুব শিবির। এ অসীম শক্তিঘর থেকে শক্তি না পেলে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় হয়তো অনেক বিলম্বিত হতো। [এইচ টি ইমাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড