যোগীশো-পালশা গণহত্যা (দুর্গাপুর, রাজশাহী)
যোগীশো-পালশা গণহত্যা (দুর্গাপুর, রাজশাহী) সংঘটিত হয় ১৬ই মে। রাজশাহী শহর থেকে সড়ক পথে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত দুটি গ্রাম যোগীশো ও পালশা। গ্রামদুটিতে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ৪২ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে দেলোয়াবাড়ী ইউনিয়নের যোগীশো এবং নওয়াপাড়া ইউনিয়নের পালশা গ্রাম পাশাপাশি অবস্থিত। গ্রামটিতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছিল। যোগীশো গ্রামের পূর্ব প্রান্তে ৩০টি এবং মধ্য পালশা গ্রামে ১২টি হিন্দু পরিবার বসবাস করত। ১৬ই মে সকালে ৬টি মোটরভ্যান যোগে পাকিস্তানি মিলিটারি যোগীশো গ্রামে প্রবেশ করে। খবর পেয়ে গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অনেকেই নিকটতম জঙ্গলে বাঁশবনে আত্মগোপন করে। এ অঞ্চলের মুসলিম লীগ নেতা এবং দেলোয়াবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ সরকারের অনুজ আব্দুল কাদের (পোস্টমাস্টার) শান্তি কমিটি গঠিত হবে এ মর্মে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলকে যোগীশো স্কুলে হাজির হতে বলে। পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে রাজাকার এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা যোগীশো স্কুলে উপস্থিত হয়। মিথ্যাচারের মাধ্যমে কাদের পোস্টমাস্টার তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী স্কুল শিক্ষক মোজাফফর মাস্টার ও অন্যান্য সহেযাগীদের মাধ্যমে বসতবাড়ি এবং জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা গ্রামবাসীদের স্কুলে হাজির করে। অনুরূপভাবে শান্তি কমিটি গঠনের নামে পার্শ্ববর্তী পালশা গ্রাম থেকেও গ্রামবাসীদের যোগীশো স্কুলে হাজির করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথকভাবে সারিবদ্ধ করে হিন্দুদের উত্তর দিকে মাটির ঘরের পেছনে নিয়ে গিয়ে পেটাতে থাকে। এক পর্যায়ে পেছন থেকে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। বুলেটের আঘাতে যারা রক্তাক্ত অবস্থায় নড়ে-চড়ে ওঠার চেষ্টা করে, পাকিস্তানি সৈন্যরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। এভাবে তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪২ জনকে হত্যা করে স্থানীয় দোসদের সহায়তায় নিকটবর্তী স্থানে গর্ত করে মাটিচাপা দেয়। নিহতদের স্মরণে এখানে ৪-স্তর বিশিষ্ট স্মৃতিসৌধ রয়েছে।
যোগীশো-পালশা গণহত্যায় নিহতরা হলেন- পালশা গ্রামের যতীন্দ্রনাথ সাহা (৫৫) (পিতা জয়চাঁদ সাহা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক), ষষ্টিচরণ সাহা (৬৫) (পিতা জয়চাঁদ সাহা, কবিরাজ), নিত্যানন্দ সাহা (২৫) (পিতা সতীশ চন্দ্ৰ সাহা, ব্যবসায়ী), ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহা (৫০) (পিতা জয়চাঁদ সাহা, পল্লী চিকিৎসক), যোগেন্দ্রনাথ সাহা (৫৫) (পিতা জয়চাঁদ সাহা), সন্তোষ কুমার সাহা (১৮) (পিতা বসন্ত কুমার সাহা, কৃষক), অনন্ত কুমার সাহা (৪০) (পিতা হেমন্ত কুমার সাহা, কৃষক), ভীমচন্দ্র কর্মকার (৬০) (কর্মকার), ভবেশ চন্দ্র কর্মকার (৩৫) (পিতা ভীমচন্দ্র সরকার, কৃষক), নীরেন্দ্রনাথ কর্মকার (২৫) (পিতা ভীমচন্দ্র সরকার, কর্মকার), সুধীর চন্দ্র সাহা (৪০) (পিতা মহিম চন্দ্ৰ সাহা, কাঠমিস্ত্রি), কিশোরী চন্দ্র সাহা (৫০) (পিতা অরুণ চন্দ্র সাহা, কৃষক), শীম চন্দ্র সাহা (৫৫) (পিতা শীশ চন্দ্ৰ সাহা, কৃষক), নিতাই চন্দ্র সাহা (২৫) (পিতা সিরিশ চন্দ্র সাহা, কৃষক), নিমাই চন্দ্র সাহা (৩৮) (পিতা সিরিশ চন্দ্র সাহা, কৃষক), সুরেশ চন্দ্র সাহা (৪৫) (পিতা শীশ চন্দ্র সাহা, আমিন), গোপাল চন্দ্র সাহা (১২) (পিতা সুরেশ চন্দ্র সাহা, ছাত্র) ও নরেন্দ্র সাহা (৩৫) (কৃষক)।
যোগীশো গ্রামের নিহতরা হলেন— নগেন্দ্রনাথ কর্মকার (৫০) (পিতা সাধু চন্দ্র কর্মকার, কৃষক), সুনীল কুমার কর্মকার (১৫) (পিতা নলিনী মোহন কর্মকার, কর্মকার), শীতল চন্দ্র দাস (৪৫) (পিতা হরিপদ দাস, কৃষক), রূপলাল দাস (৪৫) (পিতা শ্রীমন্ত দাস, কৃষক), শ্রীকৃষ্ণ সরকার (৩৫) (কর্মকার), কার্তিক চন্দ্র দাস (৫০) (কৃষক), তারণ চন্দ্র প্রামাণিক (৬৫) (পিতা রামেশ্বর চন্দ্র প্রামাণিক, কৃষক), বিভারণ চন্দ্র প্রামাণিক (৪৫) (পিতা তারণ চন্দ্র প্রামাণিক, কৃষক), নিবারণ চন্দ্র প্রামাণিক (৪০) (পিতা তারণ চন্দ্র প্রামাণিক, কৃষক), রতিকান্ত প্রামাণিক (২৬) (পিতা নরহরি প্রামাণিক, কৃষক), যোগেন্দ্র নাথ কর্মকার (৩৫) (পিতা হরিচরণ প্রামাণিক, কৃষক), যদুনাথ সরকার (৬০) (পিতা রামেশ্বর সরকার, কৃষক), রাম প্রসাদ সাহা (৩৫) (পিতা মঙ্গেশ্বর সাহা, কৃষক), কালীচরণ সরকার (৬০) (পিতা গৌরীলাল সরকার, কৃষক), যদুনাথ প্রামাণিক (৬০) (পিতা
মহেশ্বর সরকার, কৃষক), রঘুনাথ প্রামাণিক (৪০) (পিতা নেপালচন্দ্র প্রামাণিক, কৃষক), নরেন্দ্র নাথ প্রামাণিক (২০) (পিতা রামেশ্বর প্রামাণিক, কৃষক), রামেশ্বর প্রামাণিক (৫৫) (পিতা রামকান্ত প্রামাণিক, কৃষক), অর্জুন প্রামাণিক (৩০) (পিতা কৃষ্ণলাল প্রামাণিক, কৃষক), জয়গান যাশু (৩৫) (পিতা বিপিন চন্দ্র, কৃষক), যদুনাথ প্রামাণিক (৪০) (পিতা ঘঙ্গেশ্বর প্রামাণিক, কৃষক), যতীন্দ্রনাথ প্রামাণিক (৩৫) (পিতা ঘঙ্গেশ্বর প্রামাণিক, কৃষক), ভবগত সরকার (পিতা ভগবান সরকার, কৃষক) ও নীলকান্ত কর্মকার (পিতা বলরাম কর্মকার)। [এ কে এম কায়সারুজ্জামান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড