You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে যশোর সদর উপজেলা

যশোর সদর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল ৮নং সেক্টরের অধীন। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এখানকার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের নির্বাচন তাদেরকে আন্দোলন-সংগ্রামে বিশেষভাবে উদ্দীপিত করে। সত্তরের নির্বাচন শেষে আসে ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ সংগ্রামেও যশোরবাসী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। এজন্য তিনি বেশকিছু নির্দেশনাও দেন। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী যশোরে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। সংগ্রাম পরিষদ, বিশেষ করে ছাত্রলীগ-এর নেতৃত্বে শংকরপুরে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়। সেখানে ছাত্র, যুবক, আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উদ্যোগে অস্ত্র প্রশিক্ষণ চলে। নিয়াজ পার্কে এ বাহিনী কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে। যশোর সদর উপজেলা কোতোয়ালি থানার অন্তর্গত হওয়ায় সকল রাজনৈতিক দল যশোর শহর থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে আওয়ামী লীগ-এর এডভোকেট মশিউর রহমান এমএনএ, এম রওশন আলী এমএনএ, মো. সোহরাব হোসেন এমএনএ, মোশারফ হোসেন, এডভোকেট নুরুল ইসলাম, মহব্বত আলী, আব্দুস সালাম, ন্যাপ (মো)-এর এডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক, এডভোকেট কাজী আব্দুস শহীদ লাল, আমিরুল ইসলাম রন্টু, মাস্টার নুরুল ইসলাম, কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কোপন্থী)-র ডা. কাজী রবিউল হক, ছাত্রলীগের খান টিপু সুলতান, রবিউল আলম, জামালউদ্দিন রতন, অশোক রায়, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)-এর নুরুল ইসলাম, অশোক সেন প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যশোর সদরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের কোনো কমান্ডার বা ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন না। তবে মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন আলী হোসেন মনি ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন রবিউল আলম। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনী বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যশোরে প্রথমে বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) সদস্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব অস্ত্রসহ অতিরিক্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে প্রতিরোধ বাহিনীতে যোগ দেন। ছাত্র- জনতা, শিল্পী-সাহিত্যিক, কৃষক-শ্রমিক, চাকরিজীবী- ব্যবসায়ী, এক কথায়, সর্বস্তরের মানুষের সমন্বয়ে এ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। ২৮শে মার্চের মধ্যে যশোরের সব ইপিআর সদস্য বিদ্রোহ করে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং ঝুমঝুমপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়, যা ঝুমঝুমপুর প্রতিরোধ যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৩০শে মার্চ যশোর সেনানিবাসে বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করেন। এ সংবাদ বাইরে আসামাত্রই যশোরের পুলিশবাহিনী হিমাংশু ব্যানার্জী, আকমল হোসেন ও পীযূষের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। পুলিশের অস্ত্রাগারের চাবি ছিল একজন অবাঙালি জমাদারের কাছে। বিদ্রোহী পুলিশরা তাকে বন্দি করে অস্ত্রাগার খুলে প্রচুর অস্ত্র সংগ্রহ করেন। এসব অস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। যশোর নতুন উপশহরের আমবাগানে তাঁদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র-যুবক এবং সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসা বিদ্রোহী বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় প্রতিরোধ বাহিনী। এ বাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর একাধিক যুদ্ধ হয়। এর একটি সংঘটিত হয় যশোর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে পালবাড়ি রাস্তায় ভৈরব নদের ওপর নির্মিত ব্রিজের কাছে।
বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্যরা সেনানিবাস ছেড়ে চলে আসার পর ১লা এপ্রিল দু-দল পাকিস্তানি সেনা জিপে করে বেরিয়ে আসে। একদল যায় চাঁচড়ার দিকে। অন্য দল পালবাড়ি কেন্দ্ৰীয় বাসটার্মিনাল রোড ধরে এগুতে থাকলে প্রতিরোধ বাহিনী ভৈরব ব্রিজের কাছে তাদের প্রতিরোধ করে। দুপক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশ সদস্য হিমাংশু ব্যানার্জী শহীদ হন এবং পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ ঘটনা চাঁচড়া প্রতিরোধ যুদ্ধ নামে পরিচিত। পাকসেনারা এ যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা একটি চাতুর্যপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করে চাঁচড়া মোড় ও রাজবাড়ি এলাকায় সমবেত প্রতিরোধকারীদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। প্রতিরোধকারীরাও তার জবাব দেয়। উভয় পক্ষে প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ চলে, যা চাঁচড়া রাজবাড়ি যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধের পর বাঙালিদের চাঁচড়া অবরোধ ভেঙ্গে পড়ে।
পরবর্তীতে পাকবাহিনী সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে শহরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। শহর দখলের পর ৭ই এপ্রিল যশোর কোতয়ালি থানা প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৮ই এপ্রিল পাকসেনারা লেবুতলায় প্রতিরোধ বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। সেখানে পাকবাহিনীর মর্টারসহ আধুনিক অস্ত্রের সম্মুখে টিকতে না পেরে প্রতিরোধ বাহিনী মাগুরার দিকে পিছু হটে। পাকবাহিনী আগুন দিয়ে প্রায় অর্ধেক গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। ৯ই এপ্রিল পাকসেনারা বিমান বাহিনীর সহায়তায় দাইতলার প্রতিরোধ ভেঙ্গে দেয়। এরপর পাকবাহিনী মালঞ্চী প্রতিরোধ ভেঙ্গে বেনাপোলের দিকে অগ্রসর হয়।
যশোর ক্যান্টনমেন্ট শহরের নিকটবর্তী হওয়ায় সদর থানায় পাকবাহিনীর ভিন্ন কোনো ক্যাম্প ছিল না। তবে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল। পাকবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সকল অপারেশন পরিচালনা করত। যশোর সদর উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী দল ও সংগঠনের মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ। তাদের সহযোগী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিল মাওলানা আজিজুর রহমান, মাওলানা মশিউল আজম, এডভোকেট মোশারফ হোসেন খান, এডভোকেট শামছুর রহমান প্রমুখ। বিহারিরা ছিল পাকসেনাদের কট্টর সমর্থক।
পাকবাহিনীর সহায়তা ও সমর্থনে আগস্ট মাসে যশোর শহর শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এর চেয়ারম্যান ছিল কমরউদ্দিন বিএ (চৌরাস্তা), ভাইস-চেয়ারম্যান মো. শরিফ (রেলগেট), সম্পাদক ডা. মাসুদুর রহমান (রেলগেট), সহকারী সম্পাদক জয়নুল আবেদীন (স্মিত রোড), ওয়ালী আহমেদ (এন এস টাউন), প্রচার সম্পাদক সগীর আহমেদ (রেলগেট), দপ্তর সম্পাদক নাজিমুদ্দিন আল আজাদ (যশোর) এবং সদস্য- মো. হাসান (মিলন ট্রান্সপোর্ট), মীর্জা মো. আলী (বি কে রোড), মাহবুব সাব্বানী (ঘোপ), নুর মহম্মদ (ঘোপ), কামরুজ্জামান (ঘোপ), শেখ হাসান আলী (বারান্দীপাড়া), সোলায়মান হাসান (লোন অফিসপাড়া), এডভোকেট নাজির উদ্দিন (বারান্দীপাড়া), এডভোকেট আজিজুর রব খান (বারান্দীপাড়া), এডভোকেট রেজাউল হক (বারান্দীপাড়া), এস এম ইলিয়াস (বেজপাড়া), মুন্সী মো. ইয়াকুব (বেজপাড়া), হাফেজ বদরুজ্জামান (ইসলামিয়া হাইস্কুল), খন্দকার জহুরুল হক (ষষ্ঠীতলা পাড়া), শামসুর রহমান খোকা মিয়া (ষষ্ঠীতলা পাড়া), বেগম আয়শা সরদার (যশোর), ওয়ালিউল হক (বারান্দীপাড়া) এবং এডভোকেট মনোয়ার হোসেন (যশোর)। এ কমিটির অনুমোদন নিয়ে ইউনিয়ন ও মহল্লা পর্যায়েও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। পুরাতন কসবা ও ঘোপ এলাকায় গঠিত দুটি মহল্লা শান্তি কমিটির সদস্যদের নিয়ে ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এর চেয়ারম্যান ছিল শামসুল হুদা (ঘোপ), ভাইস-চেয়ারম্যান সৈয়দ আলী ইমাম (ঘোপ), কে জি মোস্তফা এলএলবি (পুরাতন কসবা) ও কাজী মল্লিক এলএলবি (পুরাতন কসবা), জয়েন্ট সেক্রেটারি বদরুদ্দীন আহমেদ (ঘোপ) ও রফিকুল ইসলাম (পুরাতন কসবা) এবং সদস্য ডা. মাহবুবুর রহমান (ঘোপ), মীর্জা আহমেদ বেগ (ঘোপ), আব্দুর রউফ (ঘোপ), কাজী নুরুল ইসলাম (পুরাতন কসবা), রফিকুল ইসলাম (পুরাতন কসবা) প্রমুখ। ঘোপের মহল্লা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল মীর্জা আলীম বেগ, সেক্রেটারি ইয়াকুব বকস এবং সদস্য শামসুল হক, মীর্জা রহমত বেগ, মীর্জা আমান বেগ, মাহবুবুর রহমান প্রমুখ। পুরাতন কসবা মহল্লার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল আমীর হুসাইন, ভাইস-চেয়ারম্যান কিউ এস হক, সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম, জয়েন্ট সেক্রেটারি এস এম হাসনাইন এবং সদস্য কাজী নুরুল ইসলাম, কে জি মোস্তফা এলএলবি, ইসহাক (অবসরপ্রাপ্ত এসআই), আবদুর রাজ্জাক মিয়া (ঢাকা রোড), জহির উদ্দিন (আহমাদাবাদ কলোনি), ওয়ালী খান (পালবাড়ি), আব্দুর রহমান (পাদুকা ভবন), শেখ সাকবুল (আহমাদাবাদ কলোনি), জাকি উল্লাহ খান (আহমাদাবাদ কলোনির ভাইস-চেয়ারম্যান) প্রমুখ। বারান্দীপাড়া শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিল এ শাকুর, ভাইস প্রেসিডেন্ট জাফির উদ্দিন, সেক্রেটারি আবদুল হক ও ইউসুফ গনি, জয়েন্ট সেক্রেটারি কালিমুল হক এবং সদস্য মো. ইজাজ, বাবু মিস্ত্রি, শেখ এ হামীদ, হাবীবুর রহমান, আনিসুর রহমান, আব্দুর রউফ, শফিউদ্দিন, ডা. সালাউদ্দিন প্রমুখ। উপশহর শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিল ওয়ালী আহমেদ এবং সদস্য ছিল নাসির আহমেদ, নিসার আহমেদ, জালাল উদ্দিন আকবর, ফিরোজ সিদ্দিকী, নজর হুসাইন প্রমুখ। যশোর শহর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মো. কমরউদ্দিন ২৭শে আগস্ট উপর্যুক্ত কমিটিগুলোর অনুমোদন দেয়।
এন এস টাউন, রেলগেট, বারান্দীপাড়া, বেজপাড়া, মহাজেরাবাদ কলোনি, লিয়াকতাবাদ কলোনিসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সংখ্যক সদস্যের এক রাজাকার বাহিনী ছিল। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর এসব সদস্য পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করত।
পাকবাহিনী ২৫শে মার্চের পর যশোর শহর এবং সদর থানার বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশ নেয়। বাঙালি সৈনিকরা সেনানিবাস ছেড়ে যাওয়ার পর হানাদার বাহিনী সেনানিবাসের বাইরে অপারেশনে বের হয়। তারা যশোর শহরের অলিতে-গলিতে ঢুকে অবর্ণনীয় তাণ্ডব চালায়। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়ে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করে, অনেককে ট্যাঙ্কের নিচে চাপা দিয়ে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানি নরঘাতকরা বাড়ি-বাড়ি ঢুকে মহিলাদের ধর্ষণ করে। গুলি চালিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে যায়। যশোর প্রধান ডাকঘরে প্রবেশ করে ডাককর্মচারী ক্ষিতীশ চক্রবর্তীকে হত্যা করে। এছাড়া ফুড ইন্সপেক্টর, রবীন্দ্রনাথ সড়কের ওয়ালিউর রহমান, রেজিস্ট্রি অফিসের করণিক হোসেন আলী এবং ৫ বছর বয়সী শিশু আবদুল মান্নানকে তারা হত্যা করে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বকচর গণহত্যায় কমপক্ষে ১০০ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। ৩রা এপ্রিল যশোর ইপিআর ক্যাম্প গণহত্যায় ৪৭ জন শহীদ হন। ৪ঠা এপ্রিল রাজারহাটে ৯ জন কিশোরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়, যা রাজারহাট গণহত্যা- নামে পরিচিত। এদিন পাকসেনাদের হাতে প্রায় ৮শ লোক নিহত হয়।
একই দিন পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসায় ২৩ জন মুসল্লিকে হত্যা করে। এ ঘটনা যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসা গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। এদিনই যশোর সার্কিট হাউজ গণহত্যায় বহু লোক এবং যশোর সদর হাসপাতাল গণহত্যায় ১১ জন শহীদ হন। যশোর সিটি কলেজ মাঠে বিভিন্ন সময়ে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ১২২ জনকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। হত্যার স্থানটি যশোর সিটি কলেজ মাঠ বধ্যভূমি নামে পরিচিত।
পরবর্তীকালে বাহাদুরপুরে ১৪ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনা বাহাদুরপুর গণহত্যা – হিসেবে পরিগণিত। ৮ই এপ্রিল খাজুরা এলাকায় খাজুরা বাজার, লেবুতলা ও ফুলবাড়ীতে ৯ জনকে হত্যা করে। খাজুরা গণহত্যার পর তারা শহর ও শহরসংলগ্ন বাহাদুরপুর, পাঁচবাড়িয়া, হাশিমপুর, বালিয়াডাঙ্গা, লেবুতলা, দায়তলা, তারাগঞ্জ, বকচর, চাঁচড়া, খিতিবদিয়া প্রভৃতি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। ১৮ই এপ্রিল -বাহাদুরপুর গণহত্যায় ২৪ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। ৪ঠা মে যশোর ক্যাথলিক চার্চ গণহত্যায় ৭ জন এবং ৭ই মে ধোপাখোলা গণহত্যায় ৩০ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
যশোর শহরে এডভোকেট শামছুর রহমান ও এডভোকেট মোশারফ হোসেনের বাসা, খাজুরা হাইস্কুল (রূপদিয়া), বাড়ীনগর হাইস্কুল (ষোলুয়া) এবং ক্যান্টনমেন্ট ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
যশোর সদর উপজেলায় ১০টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো- খয়েরতলা উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড বধ্যভূমি, বিরামপুর ভৈরব নদীতীর বধ্যভূমি, সারথি মিল সংলগ্ন ভৈরব নদীতীর বধ্যভূমি, উপশহর পার্ক বধ্যভূমি, মুড়লি বধ্যভূমি, রূপদিয়া বাজার নদীতীর বধ্যভূমি, চাঁচড়া রায়পাড়া বধ্যভূমি, শংকরপুর বধ্যভূমি, খাজুরা বধ্যভূমি এবং খাজুরা হাইস্কুল সংলগ্ন চিত্রা নদীতীর বধ্যভূমি। এ উপজেলায় ৩টি গণকবর রয়েছে। সেগুলো হলো- যশোর সেনানিবাস গণকবর, যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসা গণকবর ধোপাখোলা গণকবর।
যশোর সদর উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লেখযোগ্য পাঁচটি যুদ্ধ হয়, যথা— খাজুরা যুদ্ধ, দায়তলা যুদ্ধ, চাঁচড়া রাজবাড়ি যুদ্ধ, পুলেরহাট যুদ্ধ এবং কিফাইত নগর যুদ্ধ। ৬ই ডিসেম্বর যশোর সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আকরাম আহমেদ, বীর উত্তম (পিতা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ), মো. নুরুল হক, বীর বিক্রম (পিতা মো. শমছের আলী মোল্লা, ইছালি), মোহাম্মদ উল্লাহ, বীর বিক্রম (পিতা খলিলুর রহমান পাটোয়ারী, কামালপুর), শফিকুর রহমান, বীর প্রতীক (পিতা নওয়াব আলী বিশ্বাস, রহিমপুর) ও ২টি এম আলী, বীর প্রতীক (পিতা হাশেম আলী তরফদার, বারিনগর বাজার)।
যশোর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোহাম্মদ উল্লাহ, বীর বিক্রম (মহম্মদপুর থানা সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), টি এম আলী, বীর প্রতীক (রোয়াংছড়ি যুদ্ধে শহীদ), ওমর আলী (পিতা মতিউর রহমান, নতুন বেজপাড়া), নওশের আলী (পিতা নজীর জোয়ারদার, বড় রাজপুর), জিন্দার আলী (পিতা গোলাম আলী মোল্লা, গাওঘরা), আবদুল মান্নান (পিতা জাহাতাব মোল্লা, জঙ্গলবাঁধাল), মোস্তফা কামাল (পিতা আবদুল গফুর মোল্লা, জঙ্গলবাঁধাল), তবিবর রহমান (পিতা আবদুল গণি মোল্লা, গাওঘরা), মতিউর রহমান (পিতা আবদুল জব্বার শেখ, ভেকুটিয়া), মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (পিতা রহমত উল্লাহ, ষষ্ঠীতলা), আবদুল জলিল (পিতা আবদুর রহমান, আবদুলপুর), আলতাফ হোসেন (পিতা রজব আলী সরদার, ছাতিয়ানতলা), মকবুল হোসেন (পিতা আবদুর রহমান, আবদুলপুর), ইদরীস আলী (পিতা শেখ আমীর আলী, মথুরাপুর), মাহফুজ-উল-হক (পিতা আজহারুল হক, জঙ্গলবাঁধাল), হাবিলদার আবদুস সালাম (পিতা মুনসী নুরুল হক, বকুলতলা), মহিউদ্দিন (পিতা সিরাজুল হক, ঘোপ নওয়াপাড়া), জামাল সরদার (পিতা আবদুল মান্নান সরদার, টাউন হলপাড়া), আতিয়ার গাজী (পিতা জিন্নাত উল্লাহ গাজী, পোস্ট অফিস পাড়া), হিমাংশু বিকাশ চন্দ (পিতা লাল মোহন চন্দ, পুরাতন কসবা), সোহরাব হোসেন (পিতা ময়েজউদ্দিন, পুরাতন কসবা), কাজী আইয়ুব হোসেন (পিতা কাজী মোবারক হোসেন, রাজা বরদাকান্ত রোড), নিজাম উদ্দিন (পিতা ছবের আলী বিশ্বাস, দলেননগর), হাসেম আলী (পিতা নওশের আলী, জোত রহিমপুর) এবং সুবেদার সিদ্দিক আহমদ (পিতা হেদায়েত উল্লাহ চৌধুরী, পুরাতন কসবা)।
যশোর সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বকুলতলা মোড়ে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল, মনিহার চত্বরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক, সদর হাসপাতাল অভ্যন্তরে শহীদদের গণকবর, রেল স্টেশন মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে গণকবর, ক্যান্টনমেন্টে ‘স্বাধীনতা তোরণ’, ‘গৌরবাঙ্গন’ ও ‘রক্তঋণ’, হৈবতপুরে শহীদ আনোয়ার স্মৃতিস্তম্ভ, খুলনা বাসস্ট্যান্ডে ‘বিজয়স্তম্ভ’, চাঁচড়া রায়পাড়ায় ৭১-এর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, আইনজীবী ভবনসংলগ্ন স্থানে শহীদ আইনজীবীদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ, খাজুরা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, বাহাদুরপুর স্মৃতিফলক, সিটি কলেজে ‘চির উন্নত শির’ স্মৃতিস্তম্ভ, এম এম কলেজে ‘চেতনায় চিরঞ্জীব’, বিমান অফিসের সামনে ‘জাগ্রত বাঙালি’ এবং পালবাড়ি মোড়ে ‘বিজয় ৭১’ ভাস্কর্য, কোতয়ালি থানা চত্বরে স্মৃতিস্তম্ভ ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে। [মো. লিয়াকত আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!