You dont have javascript enabled! Please enable it!

যাদবপুর যুদ্ধ (মহেশপুর, ঝিনাইদহ)

যাদবপুর যুদ্ধ (মহেশপুর, ঝিনাইদহ) সংঘটিত হয় ২০ ও ২১শে সেপ্টেম্বর। এতে ১০-১২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ৩ জন সাধারণ মানুষ শহীদ এবং ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তঘেঁষা মহেশপুর উপজেলা। উপজেলা সদরের দক্ষিণে ১২ কিমি দূরে যাদবপুর সীমান্ত এলাকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদবপুরের উত্তর-পূর্বে চৌগাছা সীমান্তে বর্ণি বিওপির অবস্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর উত্তরে কাঠগড়া বাঁওড়। দেশের অভ্যন্তরে চোরাচালান বন্ধের লক্ষ্যে ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে মহেশপুর-ভারত সীমান্ত এলাকার ফাঁড়িসমূহ (বর্ণি, যাদবপুর, কুসুমপুর, বাগডাঙা ইত্যাদি)-এ ইপিআর ও আনসার বাহিনী মোতায়েন করা হতো। তখন এলাকাটি ছিল দুর্গম। একারণে ভারতের বয়রা, বনগাঁ ও রানাঘাট থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে বাংলাদেশের বেনাপোল অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সেপ্টেম্বর মাসে এ এলাকার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার গেরিলা আক্রমণ চালান। বর্ণি ও যাদবপুর সীমান্ত ক্যাম্পে উভয় পক্ষের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়।
যাদবপুর বিওপি থেকে বর্ণি আর্মি ক্যাম্প উত্তর দিকে ৪ কিমি দূরে অবস্থিত। এদুটি ক্যাম্পের মধ্যবর্তী অঞ্চলে উত্তর- দক্ষিণে বেতনা নদী প্রবাহিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদবপুর ও বর্ণি রাস্তার সংযোগস্থলে ছিল কালভার্ট। যাদবপুরে সাপ্তাহিক হাটের দিন শনি ও মঙ্গলবার বর্ণি ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি সেনারা টহল দিতে আসত। হাটের দিনগুলোতে নিয়মিত টহল দিতে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করার পরিকল্পনা করেন। ২০শে সেপ্টেম্বর হাটের আগের দিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের গুলি বিনিময় হয়। এতে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা সংখ্যায় অল্প হওয়ায় তারা পিছু হটে।
২১শে সেপ্টেম্বর হাটের দিন পশ্চিমবঙ্গের বয়রা ক্যাম্প থেকে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা ভারতের মধুপুর ক্যাম্পে আসেন। মধুপুর সীমান্তবর্তী গ্রাম। ওখান থেকে যাদবপুর বাজার মাত্র দু-কিমি দূরে। এদিন সকাল ৮টার দিকে মধুপুর থেকে নিয়মিত সেনাবাহিনী, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও পার্শ্ববর্তী কুলিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক ও আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা যাদবপুর বাজারে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁদের এ অবস্থান ছিল যাদবপুর বিওপির বিপরীত দিকে বেতনা নদীর অপর পাড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল বড়বাড়ি, কুলিয়া ও কৃষ্ণপুর গ্রামের মাঠে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনারা দুপুর ১টার দিকে বর্ণি ক্যাম্প থেকে যাদবপুর হাটে আসে। তখন পূর্ব থেকে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাদের লক্ষ করে গুলি করেন। তারাও পাল্টা গুলি করে। উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ধরে সংঘটিত এ যুদ্ধে ১০-১২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ হন ল্যান্স নায়েক সাত্তার। তাঁর লাশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটার সময় মাঠ দিয়ে আসা আরেকটি পাকিস্তানি সেনাদল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। এ অবস্থায় হাবিলদার জাকির পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গুলি করেন। পাকসেনারাও পাল্টা গুলি করে। এতে বড়বাড়ি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মঈনউদ্দিন শহীদ হন। পাকসেনাদের গোলাগুলির সামনে টিকে থাকা সম্ভব নয় দেখে হাবিলদার জাকিরসহ মুক্তিযোদ্ধারা বেতনা নদী পার হয়ে যাদবপুর বাজারের পাশের গ্রামে আশ্রয় নেন। বেতনা নদীর পাড় ধরে পিছু হটার সময় মুক্তিযোদ্ধা আয়ুব হোসেন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্মম নির্যাতন ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় কলাবাগানে আত্মগোপন করে জীবন রক্ষা করেন। এদিন কৃষ্ণপুর গ্রামের ৩ জন সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারায়।
মুক্তিযোদ্ধারা বারবার গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে বর্ণি ও যাদবপুর ক্যাম্পের পাকিস্তানি সৈন্যদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখেন। এর ফলে যাদবপুর ক্যাম্পের হানাদাররা বর্ণি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ সংবাদ পেয়ে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বর্ণি ক্যাম্প আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাদের নাস্তানাবুদ করেন। ফলে তারা এ ক্যাম্প ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। [অশোক বিশ্বাস]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!