বীর প্রতীক মোহাম্মদ মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী
মোহাম্মদ মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫০) বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিবাহিনীর নেভাল কমান্ডো দলের সদস্য এবং স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি ১৯৫০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি বর্তমান চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার মৈশাদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. মেহের উল্লাহ পাটোয়ারী এবং মাতার নাম শামসুন নাহার। মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা সম্পন্ন করে সফরমালী হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে ঐ স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৭ সালে চাঁদপুর কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চাঁদপুর কলেজ থেকে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে এমএসসি ক্লাসে ভর্তি হন।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনকালীন রাজনীতি এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনসহ মার্চের উত্তাল আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী। দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী চট্টগ্রাম থেকে নিজ গ্রামে চলে আসেন। ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এপ্রিল মাসে তিনি তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে পায়ে হেঁটে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমারা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেন। এ ক্যাম্প থেকে যুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং নেবার পর তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো দলে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হন। তারপর তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশী নৌ- প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে যোগদান করেন। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সেখানকার ভাগীরথী নদীতে নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর তাঁকে অপারেশন জ্যাকপট-এর আওতায় চাঁদপুর এলাকায় অপারেশনের জন্য মনোনীত করা হয়। সাবমেরিনার মো. বদিউল আলম, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে ২০ জনের একটি নৌ-কমান্ডো দলের সঙ্গে তিনি চাঁদপুর নদীবন্দর অপারেশনে আসেন। মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী ছিলেন এ দলের উপ-দলনেতা। পরিকল্পনা অনুযায়ী নৌ- কমান্ডোগণ ১৫ই আগস্ট অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে অপারেশন জ্যাকপট সম্পন্ন করেন। এদিন পুরো দলটি ছয়টি ভাগে ভাগ হয়ে চাঁদপুর বন্দরে মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় নোঙর করা পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি টার্গেটে লিমপেট মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়।
অপারেশন জ্যাকপট সম্পন্ন করে আগস্ট মাসের শেষের দিকে মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী ভারতে ফিরে যান। সেখান থেকে অক্টোবর মাসে সাবমেরিনার আমিন উল্লাহ শেখ, বীর বিক্রমএর নেতৃত্বে ৩০ জন নৌ-কমান্ডোর একটি দলের উপ-দলনেতা হিসেবে আবার চাঁদপুর আসেন। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা পর্যন্ত অসীম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে চাঁদপুরে অনেকগুলো সফল নৌ-অপারেশন পরিচালিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ২৬শে অক্টোবর দুটি খাদ্যবাহী বড় নৌকা দখল, ৩০শে অক্টোবর ডাকাতিয়া নদীতে আমেরিকার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি লোরেন ধ্বংস, ৫ই নভেম্বর চীনা পতাকাবাহী জাহাজ আক্রমণ ইত্যাদি। নৌ-কমান্ডো অভিযান ছাড়াও মমিন উল্লাহ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে চাঁদপুর অঞ্চলে পাকিস্তানি শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— বিস্ফোরকের সাহায্যে চাঁদপুর শহরে বার্মা ইস্টার্ন লি.-এর তেলের ডিপো উড়িয়ে দেয়া এবং মৈশাদী গ্রামে রেলপথের কালভার্ট ধ্বংস করা।
মহান মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডো দলের সদস্য হিসেবে সাহস ও বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্বের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মোহাম্মদ মমিন উল্লাহ পাটোয়ারীকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি ছাত্রজীবনে ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালে মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী এমএসসি পরীক্ষার মাত্র তিন মাস পূর্বে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত হয়ে পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন এবং বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল কেলিফোর্নিয়া থেকে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি পুলিশ সার্ভিস থেকে সিভিল সার্ভিসে উপ- সচিব হিসেবে যোগ দিয়ে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সেনেগাল এবং অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তাঁকে বেআইনিভাবে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী সরকারের এ আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন এবং তাতে তিনি জয়ী হন। আদালতের নির্দেশে তিনি ২০০৩ সাল থেকে অতিরিক্ত সচিব এবং ২০০৫ সাল থেকে সচিব পদে ভুতাপেক্ষিক পদোন্নতি পান। ২০০৮ সালে তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে নিজস্ব ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি ন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিংস লিমিটেড- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা। মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী বহু আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিয়োজিত রয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে তিনি তাঁর অবসরকালে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ দিয়ে ‘বীর প্রতীক মোহাম্মদ মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ট্রাস্ট থেকে চাঁদপুর সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রীদের ঝরে পড়া রোধ, এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ ও কলেজে অধ্যয়নরত গরিব ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে। তাঁর স্ত্রীর নাম নাজনীন মমতাজ। এ দম্পতির দুটি পুত্র সন্তান রয়েছে। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড