বীর প্রতীক মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান
মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৭) সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, স্বাধীনতাপরবর্তী মেজর জেনারেল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৭ সালের ৩১শে মে ভোলা জেলার সদর উপজেলার উকিলপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল ওয়াজেদ ও মাতার নাম আনোয়ারা বেগম। তিনি ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রামের কাজেম আলী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৬৯ সালে একই কলেজ থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) পাস করেন। ১৯৭১ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শেষবর্ষের ছাত্র ছিলেন।
কলেজে পড়াকালীন সময় থেকেই মাসুদুর রহমান স্বাধিকার আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফিসার ট্রেনিং করপস্ (ইউওটিসি)-এর মাধ্যমে রাইফেল চালানো শেখেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ তাঁর মধ্যে মুক্তির চেতনাকে শাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৩০শে মার্চ তিনি কালুরঘাট ব্রিজে প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকা অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন। তিনি যেহেতু রাইফেল চালাতে জানতেন, সেহেতু দুদিন পর তাঁকে ‘ব্রাভো’ কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত করে তাঁর জন্য রাইফেল ও গুলি সরবরাহ করা হয়। ‘ব্রাভো’ কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন চৌধুরী খালেকুজ্জামান। ১১ই এপ্রিল পাকবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় প্রতিরক্ষা অবস্থান উইথড্র করে মহালছড়ি হয়ে বুড়িঘাটে এসে তাঁরা অবস্থান নেন। ১৯শে এপ্রিল বুড়িঘাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ, বীরশ্রেষ্ঠ বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে যুদ্ধরত অবস্থায় পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। এরপর মাসুদুর রহমান খান অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে ভারতের সাবরুমে চলে যান এবং হরিণা ট্রেনিং সেন্টারে দুমাসের গেরিলা ট্রেনিং নেন। তারপর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি জেলার মুর্তি ট্রেনিং ক্যাম্পে ‘প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’-এর প্রশিক্ষণ শেষে ৯ই অক্টোবর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ৬ নম্বর সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টরে তাঁর পোস্টিং হয়। এ-সময় ৬ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার। মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান অমরখানা, জগদল হাট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, বীরগঞ্জ, খানসামা প্রভৃতি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে অমরখানা বিওপি আক্রমণ ও দখলের যুদ্ধ অধিক স্মরণীয়। পঞ্চগড় জেলার অমরখানা বিওপি ছিল পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি। এর উত্তরে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার চাউলহাটি ও ভাটপাড়া, পূর্বদিকে প্রবাহিত তালমা নদী। অমরখানার ওপর দিয়েই তেঁতুলিয়া- পঞ্চগড় যাওয়ার সড়ক পথ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে অমরখানা ছিল গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী অমরখানা বিওপি দখল করে সেখানে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। পাকবাহিনীর ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং মিলিশিয়াসহ দুই কোম্পানি সেনা বিওপি-তে অবস্থান করত। আগস্ট মাস থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকবার অমরখানা আক্রমণ করেও এ ঘাঁটির পতন ঘটাতে পারেননি। ২২শে মে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা অমরখানা বিওপি দখল করেন। এ যুদ্ধে মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানের ভূমিকা ও যুদ্ধকৌশল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরপর তিনি জগদলহাট, ২৯শে নভেম্বর পঞ্চগড়, ৩রা ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও দখলে অংশগ্রহণ করেন। ১৪ই ডিসেম্বর সংঘটিত দিনাজপুরের খানসামা যুদ্ধে পাকবাহিনীর একজন মেজরসহ ১৫ জন সেনাসদস্যকে মুক্তিযোদ্ধারা হাতেনাতে ধরে ফেলেন এবং ১৬ই ডিসেম্বর তাঁরা সৈয়দপুরে প্রবেশ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। তিনি ২০০৩ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ২ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম মিসেস সীমা রহমান। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড