বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন
মোহাম্মদ রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৩৫-১৯৭১) সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১০ই ডিসেম্বর যুদ্ধ জাহাজ পলাশ নিয়ে খুলনার শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি পৌঁছলে বিমান হামলায় মারাত্মকভাবে আহত এবং সে অবস্থায় সাঁতরে নদীর তীরে ওঠার পর পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে শহীদ হন। ১৯৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার বাগপাচড়া গ্রামে (বর্তমান রুহুল আমিন নগর) তাঁর জন্ম। পিতার নাম আজহার পাটোয়ারী ও মাতা জোলেখা খাতুন। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণি পাস করার পর আমিষাপাড়া কৃষক হাইস্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৫৩ সালে তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর করাচিতে নৌবাহিনীর কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে মেকানিক্যাল কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন এবং যথাসময়ে তা সম্পন্ন করে তিনি ইঞ্জিনরুম আর্টিফিশার পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি করাচি থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম পিএনএস বখতিয়ার নৌঘাঁটিতে যোগ দেন। ৭১-এর মার্চ মাসে এ নৌঘাঁটিতে থাকা অবস্থায় তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজে করে ইয়াহিয়া সরকারের অস্ত্র ও সৈন্য আনা, ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা, যুদ্ধ জাহাজ থেকে চট্টগ্রাম শহরে শেলিং করে অগণিত নিরীহ মানুষ হত্যা, চট্টগ্রামে ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের বিদ্রোহ ও পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রুহুল আমিন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন। শীঘ্রই তিনি সেখান থেকে পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন এবং সেখানে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফ, বীর উত্তম-এর অধীনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের সঙ্গে একাধিক স্থলযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এদিকে আগস্টের মাঝামাঝি একদল নেভাল কমান্ডো চট্টগ্রাম, চালনা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নৌ বন্দরে একই সময়ে নৌ অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকটি জাহাজ মাইন দিয়ে ধ্বংস করতে সমর্থ হন, যা অপারেশন জ্যাকপট- নামে খ্যাত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি ছিল সাড়া জাগানো একটি ঘটনা। এরপর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সরকার- বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। নৌবাহিনীর সাবেক সদস্যদের নিয়ে তা গঠিত হয়। রুহুল আমিন এতে যোগ দেন। ভারত সরকার কর্তৃক উপহার হিসেবে দেয়া ২টি টাগবোটকে যুদ্ধোপযোগী করে ১২ই অক্টোবর পরীক্ষামূলকভাবে নামানো হয়। এর একটির নাম দেয়া হয় ‘পদ্মা’ অপরটি ‘পলাশ’। রুহুল আমিন ছিলেন দ্বিতীয়টির ইঞ্জিনরুম আর্টিফিশার।
৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমান ভারতের কয়েকটি বিমান ঘাঁটিতে বোমা বর্ষণ করলে ভারত সঙ্গে-সঙ্গে এর যথাযোগ্য জবাব দেয়। এরপর ভারত সরাসরি বাংলাদেশকে পাকিস্তানি দখলদারমুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী – যৌথভাবে একের পর এক শহর ও শত্রুঘাঁটি দখলমুক্ত করে চলে। সদ্য গঠিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীও এ যুদ্ধে অংশ নেয়। খুলনায় পাকিস্তান নৌবাহিনীর ঘাঁটি পিএনএস তিতুমীর দখলে নেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধযান ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ এবং ভারতের রণতরী ‘প্যানভেল’ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ১০ই ডিসেম্বর খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি এসে পৌঁছায়। হঠাৎ এ সময় তিনটি জঙ্গি বোমারু বিমান মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পুনরায় ফিরে আসে। পদ্মা ও পলাশ-এর কমান্ডারদ্বয় বিমান লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার অনুমতি চান, কিন্তু অভিযানের অফিসার-ইন-কমান্ড ভারতের ক্যাপ্টেন মনেন্দ্রনাথ সামন্ত বিমানগুলো ভারতীয় বলে তাঁদের গুলি ছোড়া থেকে বিরত রাখেন। এরপর বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করা হলে ‘পলাশ’ রণতরীটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কমান্ডার সকলকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ রক্ষার নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন ছিলেন পলাশের ইঞ্জিনরুমে। তিনি কিছুতেই ‘পলাশ’ পরিত্যাগ করতে সম্মত হলেন না, বরং সেটিকে সচল রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। হঠাৎ বোমারু বিমানের একটি গোলার আঘাতে পলাশের ইঞ্জিনরুমে আগুন ধরে যায়। রুহুল আমিন আহত অবস্থায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কোনোভাবে তীরে গিয়ে ওঠতে সক্ষম হন। সেখানে পূর্ব থেকে অবস্থানরত পাকসেনা ও রাজাকারদের হাতে তিনি ধরা পড়েন। নির্মম অত্যাচারের পর তারা সেখানেই তাঁকে হত্যা করে। তাঁর লাশ রূপসা নদীর তীরে সমাহিত করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরত্বপূর্ণ অবদান ও আত্মোৎসর্গের জন্য শহীদ রুহুল আমিনকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর স্মরণে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে খুলনার রূপসা নদীর তীরে স্থাপন করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্মৃতি কমপ্লেক্স, নৌবাহিনীর একটি জাহাজের ‘বিএনএস রুহুল আমিন’ নামকরণ, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন ডিগ্রি কলেজ, তাঁর জন্মস্থানের নতুন নামকরণ ‘রুহুল আমিন নগর’, গ্রামের বাড়ির সম্মুখে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। [হারুন-অর-রশিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড