বীর উত্তম মোহাম্মদ শাহজাহান ওমর
হাম্মদ শাহজাহান ওমর, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪৯) বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন বৃহত্তর বরিশাল সাব-সেক্টরের কমান্ডার। তিনি ১৯৪৯ সালের ২৪শে ডিসেম্বর বর্তমান ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর থানার সাংগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল হামিদ, মাতা লালমোন বিবি। তিনি রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে ম্যাট্রিক এবং বরিশাল বি এম কলেজ থেকে ১৯৬৬ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান)-এ ভর্তি হন। কিন্তু তা সম্পন্ন না করে ১৯৬৭ সালে কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে রেগুলার কোর্সে যোগদান করেন। সেখান থেকে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন। তাঁকে খারিয়ান ক্যান্টনমেন্ট (পাঞ্জাব)-এ পোস্টিং দেয়া হয় এবং একই বছর তিনি লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। ঐ বছরই পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে তিনি গ্রাজুয়েশন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি পান। তিনি গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। একজন বাঙালি সেনা অফিসার হিসেবে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বাঙালিদের প্রতি অবজ্ঞা ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ তিনি প্রত্যক্ষ করেন। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ বিজয় অন্যসব বাঙালিদের মতো তাঁকেও উজ্জীবিত করে। নির্বাচনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সামরিক চক্র ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এ অবস্থায় ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের উদ্দেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তাতে তিনি সেনাসদস্যসহ সকল বাঙালির প্রতি পাকিস্তানিদের সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুষ্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। ২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকা শহর ও পূর্ব বাংলার অন্যত্র একযোগে পাকবাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা শাহজাহান ওমরকে খুবই বিক্ষুব্ধ করে। এমনি অবস্থায় তিনি মনে-মনে পাকিস্তান আর্মি ত্যাগ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দেশের মাটিতে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। ১৪ই আগস্ট কিছু বাঙালি সেনাকর্মকর্তাসহ পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে দীর্ঘ ২৭ মাইল দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করে ভারতের জম্মু শহরে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতা পৌঁছে থিয়েটার রোডে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁকে মেজর জলিলের অধীন ৯নং সেক্টরে ন্যস্ত করা হয়। ২১শে আগস্ট তিনি ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং যশোর হয়ে ২৬শে আগস্ট বরিশালের উজিরপুর থানার হারতা গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এরপর তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২৮শে আগস্ট গানবোট ও প্লেন নিয়ে পাক আর্মি ঐ ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী বিজয় অর্জন করে। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজারকার সহ শত্রুপক্ষের ব্যবহৃত ৬টি লঞ্চ ও ১টি গানবোট হারতা নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, বাঙালি সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য, পুলিশ ও আনসার সদস্যগণ তাঁর বাহিনীতে যোগ দেন। ফলে তাঁর অধীনে একটি বিরাট বাহিনী গড়ে ওঠে অপরদিকে ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আসতে থাকে।
তাঁর অধীনে বৃহত্তর বরিশালের ৩৪টি থানায় প্রত্যেকটিতে একজন কমান্ডারের নেতৃত্বে মোট ৩৪টি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ সৃষ্টি করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন নিয়ে সিভিলিয়ান কমিটি গঠন করা হয়। বরিশাল অঞ্চল অসংখ্য নদী পরিবেষ্টিত হওয়ায় হানাদারদের গানবোট আক্রমণ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম টার্গেট। পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে অপারেশনে তাঁর বাহিনী এম্বুশ, রেইড ইত্যাদি গেরিলা পদ্ধতি অনুস্মরণ করে। তবে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধেও তাঁরা অবতীর্ণ হন।
গৌরনদী, উজিরপুর, বাবুগঞ্জ, বানারীপাড়া, নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি), মুলাদি, হিজরা, মেহেন্দীগঞ্জ, ভোলার ৫টি উপজেলা, বাকেরগঞ্জ, রাজাপুর, গলাচিপা, বাউফল, হোমনা, কাউখালী ও নাজিরপুর থানায় ক্যাপ্টেন (তখন এটি তাঁর র্যাঙ্ক) শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বাধীন বাহিনী পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে একাধিক অপারেশন পরিচালনা করে। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গৌরনদী, দোহারিকা ফেরিঘাট, শিকারপুর ফেরিঘাট, মুলাদি, দপদপিয়া, লোহালিয়া (পটুয়াখালী)-র যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। তবে বড় যুদ্ধ হয় ঝালকাঠীর চাঁচৈড়, বরিশাল ক্যাডেট কলেজ, বাবুগঞ্জ, বাকেরগঞ্জ ও রাজাপুর থানা দখলের সময়। রাজাপুর থানা দখলের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর গুলিবিদ্ধ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক সফল অপারেশনের কারণে ২১শে নভেম্বর থেকে পাকিস্তানি সৈন্য, মিলিশিয়া, রাজাকার কেউই বাইরে বের হতে পারেনি, শহরের মধ্যে তারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ৮ই ডিসেম্বর বরিশাল শহর মুক্ত হয়। এরপর অন্যান্য শহরে পাক আর্মি এক-এক করে স্যারেন্ডার করতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেকগুলো সামরিক অভিযানে সাফল্যের পরিচয় দিয়ে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর সে-সময় ব্যাপক আলোচনায় আসেন ও প্রশংসিত হন। তাঁর দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা, বুদ্ধিমত্তা ও রণকৌশল তাঁকে বিশিষ্ট করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ আর্মিতে থেকে যান এবং ১৯৭৩ সালে মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯৭৪ সালে তাঁকে বাংলাদেশ আর্মি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ১৯৭৫-১৯৭৮ সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ইংল্যান্ডের লিঙ্কনস্ ইন থেকে বার-এট-ল ডিগ্রি লাভ করেন। ব্যারিস্টারি (বার-এট-ল) পাস করে স্বাধীন আইন পেশায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। পাশাপাশি রাজনীতিতে রয়েছে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এ যোগ দেন। ১৯৭৯, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে ঝালকাঠী-১ (রাজাপুর- কাঁঠালিয়া) আসন থেকে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি বর্তমানে বিএনপি-র ভাইস-চেয়ারম্যান। তাঁর স্ত্রীর নাম মেহজাবীন ফারজানা। তাদের এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: লেখকের সঙ্গে মেজর শাহজাহান ওমর, বীর উত্তম-এর সাক্ষাৎকার, ৪ঠা জানুয়ারি ২০১৯
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড