বীর উত্তম মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার
মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার, বীর উত্তম (১৯৩৫- ১৯৭৬) বীর মুক্তিযোদ্ধা, ৬নং সেক্টরের কমান্ডার এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান। তিনি ১৯৩৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পৈতৃক নিবাস বর্তমান নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার সাতারবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ হাসমত উল্লাহ শাহ এবং মাতার নাম হাছিনা বেগম। তিনি সাতক্ষীরা প্রাণনাথ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে তিনি জিডি (পাইলট) শাখায় কমিশনপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রনের অধিনায়কত্ব লাভ করেন। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি উইং কমান্ডার পদে পদোন্নতি পান এবং ঢাকার তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন।
৭১-এর ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দুদিন পূর্বে প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্থগিত ঘোষণা, প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর আহবানে পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন-এর কর্মসূচি, ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানের সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান, ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিষ্ফল আলোচনা, একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমান ও জাহাজে করে ইয়াহিয়া সরকারের অস্ত্র ও সৈন্য আনা, সম্ভাব্য সেনা-আক্রমণের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালিদের দেশজুড়ে সর্বাত্মক প্রতিরোধের প্রস্তুতি, ইত্যাদি ঘটনা খাদেমুল বাশার ঢাকায় তাঁর কর্মক্ষেত্র থেকে প্রত্যক্ষ করেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট – নামে বাঙালিদের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ ও নির্বিচার গণহত্যা তাঁকে ভীষণ ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করে। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ খাদেমুল বাশার সে-যুদ্ধে যোগদানের সুযোগ খুঁজছিলেন। ১৪ই মে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, স্কোয়াড্রন লিডার সদর উদ্দিন, ফ্লাইট লে. সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লে. বদরুল আলম, ফ্লাইট লে. কাদের ও সাবেক ফ্লাইট লে. রেজাসহ তাঁরা গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে পরের দিন কুমিল্লার সোনামুড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছান। এরপর তাঁরা বিশেষ ব্যবস্থায় কলকাতা যান। সেখানে মুজিবনগর সরকার-এর নেতৃবৃন্দ ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী-র সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটে। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত না হওয়ায় তাঁদের স্থলযুদ্ধের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত করা হয়। সে অনুযায়ী খাদেমুল বাশারকে ৬নং সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়।
বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলা নিয়ে ৬নং সেক্টর গঠিত হয়। এর হেডকোয়ার্টার্স ছিল বর্তমান লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তবর্তী বুড়িমারীতে। সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর এম কে বাশার মুক্তিযুদ্ধকে গতিশীল ও অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ৬নং সেক্টরকে ৬টি সাব- সেক্টরে বিভক্ত করা হয়, যথা- পাটগ্রাম, মোগলহাট, সাহেবগঞ্জ, চিলাহাটি, ফুলবাড়ি ও ভজনপুর সাব-সেক্টর। নিয়মিত বাহিনীর ১ হাজার ২শ সদস্য ও অনিয়মিত বাহিনীর ৬ হাজার সদস্য বা গেরিলা নিয়ে সেক্টরের মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। ভারতে গেরিলাদের জন্য তিন সপ্তাহের ট্রেনিং তাঁর কাছে যথেষ্ট মনে না হওয়ায় তিনি তাঁর সেক্টরের মুক্ত অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে তাঁদের জন্য অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তাঁর সেক্টরে ১২০টির মতো গেরিলা বেইজ ছিল। আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার সুবিধার্থে তেঁতুলিয়া ও বুড়িমারীতে দুটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। প্রথমদিকে গেরিলা অপারেশনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হলেও অক্টোবরের দিকে ভারতীয় আর্টিলারির সহযোগিতা নিয়ে তাঁর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুঘাঁটির ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকেন। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের পূর্বেই রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানীবাস ছাড়া ৬নং সেক্টরের প্রায় সমস্ত এলাকা হানাদারমুক্ত হয়। তাঁর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স বুড়িমারী মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় মুক্ত ছিল। এ সেক্টরে যেসব বড়বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তার মধ্যে ভুরুঙ্গামারী (রংপুর), মোগলহাট (রংপুর), অমরখান (দিনাজপুর), বড়খাতা, তেঁতুলিয়া, পাটগ্রাম, হাতিবান্দা, নাগেশ্বরী উল্লেখযোগ্য।
যদিও এম কে বাশার বিমান বাহিনীর অফিসার ছিলেন, তথাপি মুক্তিযুদ্ধে স্থলবাহিনী পরিচালনা ও তার নেতৃত্ব দানে তিনি উচ্চতর মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা-উত্তর উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশারকে বাংলাদেশ সরকার ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে।
স্বাধীনতার পর তিনি রংপুর সেনানীবাসের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে তিনি গ্রুপ ক্যাপ্টেন, ১৯৭৩ সালে এয়ার কমোডর এবং ১৯৭৬ সালে এয়ার ভাইস মার্শাল পদে উন্নীত হন। তিনি ১লা মে ১৯৭৬ বিমান বাহিনীর প্রধান পদে নিযুক্ত হন। একই বছর ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে উড্ডয়নকালে দুর্ঘটনায় তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। তাঁর স্মরণে বিমান বাহিনীর ঢাকা সেনানীবাসস্থ ঘাঁটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার’। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: শাহ মোহাম্মদ নাসিমুজ্জামান (এম কে বাশারের চাচাতো ভাই)-এর সাক্ষাৎকার ১৪-১১-২০১৮
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড