বীর প্রতীক মোহাম্মদ বজলুল গণি পাটোয়ারী
মোহাম্মদ বজলুল গণি পাটোয়ারী, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪২) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪২ সালের ২রা মার্চ চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুর রহিম পাটোয়ারী এবং মাতার নাম আফিয়া খাতুন। তিনি ১৯৫৬ সালে চান্দ্রা ইমাম আলী হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৬ সালে এবোটাবাদের কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে কমিশন প্রাপ্ত হন। এরপর তাঁকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত করে পশ্চিম পাকিস্তানের খারিয়ান সেনানিবাসে পোস্টিং দেয়া হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে বজলুল গণি ক্যাপ্টেন পদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯ম পদাতিক ডিভিশনের ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্টের এডজুট্যান্ট হিসেবে ঝিলাম সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার অব্যবহিত পূর্বে ৯ম পদাতিক ডিভিশন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তর করলেও এর সঙ্গে মোহাম্মদ আবু তাহের, বীর উত্তম ও বজলুল গণিকে পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং দিতে সামরিক কর্তৃপক্ষ অস্বীকৃতি জানায়। এর কারণ হয়তো তাঁরা ভেবেছিল, বাঙালি হয়ে আন্দোলনরত বাঙালিদের ওপর তাঁরা গুলি চালাতে রাজি হবেন না। সামরিক কর্তৃপক্ষের এরকম আচরণে তাঁরা উভয়েই ক্ষুব্ধ হন এবং এ ঘটনা তাঁদেরকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করে।
২৫শে মার্চ থেকে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতনের খবর শুনে তাঁরা উভয়ই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জুলাই মাসে পালিয়ে এসে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বজলুল গণি ১১নং সেক্টরে জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-এর অধীনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেন। পরবর্তীতে ব্রিগেড আকারে নিয়মিত বাহিনী গঠিত হলে তিনি ‘জেড’ ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ নম্বর ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি একই সঙ্গে এই রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানির অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেন।
বজলুল গণি যে-সকল যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন, সে-সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিলেটের কানাইঘাটের যুদ্ধ ও সিলেট শহরের যুদ্ধ। কানাইঘাটের যুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী শক্তিশালী পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে পরাজিত ও পর্যুদস্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৩ই ডিসেম্বর ‘জেড’ ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এম সি কলেজ সংলগ্ন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারাও ভারী অস্ত্রের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিমান আকাশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করলে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ যুদ্ধে প্রায় শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও বহুসংখ্যক আহত হয়। যুদ্ধে ফয়েজ আহমেদ, বীর উত্তমসহ ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানির ২০ জন সৈন্য শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মোহাম্মদ বজলুল গণি পাটোয়ারীকে বাংলাদেশ সরকার ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভুষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বজলুল গণি তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৭৫ সালে কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮১ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)- এর চেয়ারম্যান, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ স্টিল এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এবং ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশরেন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম লায়লা পারভীন। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড