You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৩রা আগস্ট, শুক্রবার, ১৯৭৩, ১৮ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সেই পুরোন আমলাতান্ত্রিক খেল্

তীব্র বস্ত্র সংকটের মুখে সরকার অবাধ সাধারণ লাইসেন্সের মাধ্যমে যে কাপড় আমদানীর ব্যবস্থা করেছেন তার সুষ্ঠু বন্টনের দিকেও নেকনজর সরকারের রয়েছে। গত পরশু এক হ্যান্ড আউটে সরকারের সেই মহতী ইচ্ছের কথাই ব্যক্ত হয়েছে। বলা হয়েছে, জেলা এবং মহকুমা পর্যায়ে ডেপুটি কমিশনার এবং মহকুমা প্রশাসকের নেতৃত্বাধীনে বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির উপর দায়িত্ব থাকবে আমদানীকৃত বস্ত্রের পাইকারী এবং খুচরা মূল্য নির্ধারণের আর বাদবাকী কাজ আমদানীকারক এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় সারবেন জেলা অথবা মহকুমা প্রশাসকবৃন্দ। তারা বাণিজ্য দপ্তরের ডিরেক্টরের নিকট মাসিক সমন্বিত রিপোর্ট পেশ করবেন।
আমরা খুশী হয়েছি সরকারের সদিচ্ছার কথা জানতে পেরে, সেই সদিচ্ছা পূরণে যে পথের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে তা ভেবে নয়। সত্যি কথা বলতে কি স্বাধীনতাত্তোর গত দেড় বছরে সরকারের এমন অনেক সদিচ্ছা শুধু ভুল ব্যবস্থা গ্রহণের ফলেই মাঠে মারা গেছে। ন্যায্যমূল্যে দ্রব্য সামগ্রী বন্টনের পরিকল্পনা ‘লাটে’ উঠতে বসেছে, সমবায়ের মাধ্যমে সূতা বন্টনের মহতী প্রয়াস কিছু ভুয়া ব্যবসায়ীর জন্ম দিয়েছে। জনসাধারণের দুর্গতি বেড়েছে, সরকার অপ্রস্তুত হয়েছেন।
এবারের ব্যবস্থা গ্রহণেও সেই পুরোন মহাজনী পন্থারই অনুসরণ করা হয়েছে। বাইরে সরকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনসাধারণের অংশীদারিত্বের একটা মেকী খোলস পরিয়ে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জেলা অথবা মহকুমা প্রশাসকের হাতে। আমদানীকারকরা বস্ত্র আমদানীর পর আটচল্লিশ ঘন্টার ভিতর রিপোর্ট করবেন জেলা অথবা মহকুমা প্রশাসকের কাছে। খুচরা বিক্রেতাদের তালিকা প্রণয়ন করবেন তারাই। এই খুচরা বিক্রেতারা তাদের বিক্রয় সম্পর্কে সাপ্তাহিক রিপোর্ট পেশ করবেন সেই জেলা কমিশনার অথবা মহকুমা প্রশাসকের কাছে। স্ব-স্ব এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যা এবং প্রয়োজনের ভিত্তিতে কাপড়ের ন্যায্য বন্টন নিশ্চিত করবার দায়দায়িত্বটাও অর্পণ করা হয়েছে জেলা-মহকুমা প্রশাসকের উপর।
এত কিছু যখন সরকারী কর্মচারীদের মাধ্যমেই করা হবে তখন আমাদের প্রশ্ন শুধুমাত্র মূল্য নির্ধারণের জন্য ঢাউস একটি কমিটি করবার কি প্রয়োজন ছিল। ও কাজ কি আর প্রশাসনিক কর্মকর্তারা চালিয়ে নিতে পারতেন না? সাংবাদিক সমিতির একজন প্রতিনিধি, জাতীয় সংসদ সদস্য, স্থানীয় চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি, বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট এমনি সব দায়িত্বশীল লোকদের উপর ঘটা করে শুধুমাত্র মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব অর্পণের হেতু কি?
সরকারী নীতি বাস্তবায়নে আমরা জনগণের অংশীদারীত্বে বিশ্বাসী। একমাত্র তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সরকারী নীতির সুষ্ঠু প্রতিফলন সম্ভব। কিন্তু একশ্রেণীর আমলাতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন লোক রয়েছেন যারা এই তেতো বড়িটা গিলতে কিছুতেই রাজী নন। অবস্থার চাপে পড়ে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বশীল লোকদের নিয়ে কমিটি করছেন বটে কিন্তু সুচতুরভাবে ক্ষমতাটা নির্দিষ্টভাবেই আগলে রাখছেন সরকারী কর্মচারীদের হাতে। এতে করে সাপও মরছে, লাঠিও ভাঙছেনা। অপবাদ যা কিছু তা বর্তাচ্ছে ক্ষমতাহীন কমিটির উপর আর স্বচ্ছন্দে পুরোন নিয়মে ক্ষমতার চাবিকাঠি ঘুরাচ্ছেন সরকারী কর্মকর্তারা। আমরা বহুবার এর প্রতিবাদ করেছি, এবার এই তীব্র বস্ত্রসংকটের মুখে যখন আমদানীকৃত কাপড় সুষ্ঠু বন্টনের একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে তখনও আমলাদের নয়া কারসাজি সম্বন্ধে সরকারকে সতর্ক হবার আহ্বান জানাচ্ছি।

আমরাও সংহতি জানাই

গত মাসের ২৮ তারিখ থেকে পূর্ব জার্মানীর রাজধানী বার্লিনে বিশ্ব যুব সম্মেলন শুরু হয়েছে। ৮৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মেলনে যোগদান করেছেন। সংবাদে প্রকাশ, উক্ত দশম বিশ্ব যুব সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষ দু’টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের হোতা বীর বাঙালীদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানানো হয়েছে। অন্য এক প্রস্তাবে, অবিলম্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানানো হয়েছে। জানা গেছে, প্রস্তাব দু’টি উথাপন করেছেন—নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি শ্রী রণজিত গুহ। বিশ্ব যুব সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পর্কে উত্থাপিত ও গৃহীত প্রস্তাব দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণে বিচার্য। বিশ্ব যুব সম্মেলনে এবার বাংলাদেশের যোগদান ও নব্য স্বাধীনতালব্ধ বাংলাদেশের প্রতি সম্মেলনের সম্মান প্রদর্শন নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আগামী বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী যুব সমাজ বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের যথার্থ মর্যাদাই দেখিয়েছেন। বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন একটি জোর আলোচন্য বিষয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্য। বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতনের দিকে বিশ্বের কৌতুহলী দৃষ্টি রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের যুক্ত প্রস্তাবের মধ্যে যেমন নিহিত রয়েছে উপমহাদেশের স্থানীয় শান্তি তেমনি এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা হবে বিশ্বশান্তি ও মৈত্রীর অনেক বড় সহায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিলো পাকিস্তানী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কবল থেকে মুক্ত হবার। অনিবার্যভাবে তাই যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়েছিলো বাংলাদেশকে। ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাংলাদেশ অত্যন্ত স্বল্প সময়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নাম আজ বিশ্ব রাজনীতিতে একটি আলোচনার বিষয়। তাঁর তুলনাহীন নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বের সকল প্রগতিশীল নেতার পরম শ্রদ্ধা। বঙ্গবন্ধু বর্তমানে কমনওয়েলথ সম্মেলনে রয়েছেন। সেখানে তিনি একটি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। বিশ্ব যুব সম্মেলনেও তিনি এবং তাঁর দেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি বিশ্ব যুব সম্মেলনের উল্লেখিত এ সংহতি জ্ঞাপন একটি সমমর্মিতারই নির্দশন। প্রগতিশীল বিশ্ব যুব সমাজ জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কে যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমাদের দেশ ও জাতির সঙ্গে তাদের যে সংহতি স্থাপনের ঘোষণা তাকেও আমরা অভিননন্দিত করি। সমমর্মিতার এই নির্দশনকে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করবো। সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘের প্রতি পুনরায় আমরা আহ্বান জানাবো—বাংলাদেশের সার্বভৌম ও বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তার সদস্য পদ দেবার জন্য।

প্রসঙ্গঃ

চালের মণ একশ’ থেকে একশ’ দশ, ডালের সের তিন থেকে সাড়ে তিন, তেলের দাম বারো টাকা এবং নুনের প্রতি সের পঞ্চাশ পয়সা যখন বাজার দর, সেই সময়ে বান্দরবন মহকুমার থানা উন্নয়ন সংস্থার কর্মচারীরা গত নয় মাস থেকে বেতন পাননি বলে খবর বেরিয়েছে। কাপড়ের মূল্য না হয় বাদই থাকলো আপাততঃ। পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে বান্দরবন মহকুমার চারটি থানার থানা উন্নয়ন সংস্থার কর্মচারীরা বাহাত্তর সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত বেতন থেকে বঞ্চিত। এ ব্যাপারে নাকি কর্তৃপক্ষও নীরব। আমরা ভাবছি এই কর্মচারী ভাইদের পরিবার-পরিজন নিয়ে দিন কাটছে কেমন করে? কেন তাঁরা বেতন পাচ্ছেন না? তাঁদের অপরাধ কি? যদি কোন দোষে অপরাধী তাঁরা হয়ে থাকেন তাহ’লে দীর্ঘ নয় মাসেও তার নিষ্পত্তি হয়নি কেন? কেন তাঁদেরকে এভাবে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে? তবে কি কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, না পাটের ফিতার (লাল ফিতা বদলিয়ে এখন পাটের ফিতা ব্যবহৃত হচ্ছে) দৌরাত্ম্য!
আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, কর্মচারীদের কোন ক্রুটি থেকে থাকলে সত্বর তার নিষ্পত্তি করা হোক। নইলে তাঁদেরকে বর্তমান আক্কারার বাজারে বেতন না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে পরাভুগ ভোগানোর কারো অধিকার নেই। বিষয়টির সত্বর নিষ্পত্তি না ঘটলে দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও ভাববো বান্দরবন মহকুমার চারটি থানার থানা উন্নয়ন সংস্থার কর্মচারীদেরকে কি তাহলে কর্তৃপক্ষ প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে সমুদ্রের হাওয়া খেয়ে থাকার নির্দেশ দিচ্ছেন?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!