You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, বীর প্রতীক (১৯৪৭- ২০১৪) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৫ই নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলার জানিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলতাফুর রহমান এবং মাতার নাম আজিরন নেছা। তিনি ১৯৬৩ সালে খোকসা জানিপুর পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৫ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬৬ সালের ১৮ই অক্টোবর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে (কাকুল, এবোটাবাদ) ৩৯তম পিএমএ লং কোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ বছরের ২০শে অক্টোবর সামরিক বাহিনীতে কমিশন পেয়ে তিনি তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পাঞ্জাবের শিয়ালকোট সেনানিবাসে পোস্টিং পান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে আনোয়ার হোসেন ক্যাপ্টেন পদে সৈয়দপুর সেনানিবাসে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। এর প্রতিবাদে আনোয়ার হোসেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তাঁর ইউনিটসহ বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ৩১শে মার্চ তিনি ফুলবাড়িয়া কলেজ মাঠে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পুনর্গঠিত করে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করেন।
এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত আনোয়ার হোসেনের দল সীমান্তবর্তী এলাকায় বিভিন্ন প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করে। পরবর্তীতে সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কিছুকালের জন্য তিনি ৭নং সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে ৭ই জুলাই ব্রিগেড আকারে ‘জেড’ ফোর্স গঠন করা হলে তাঁকে ঐ ফোর্সে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯শে জুলাই তিনি তাঁর ইউনিটসহ তেলঢাকায় পৌঁছে তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘জেড’ ফোর্সে যোগ দেন। তাঁকে এ ফোর্সের অধীন তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি কমান্ডার হিসেবেদা দায়িত্ব দেয়া হয়।
আনোয়ার হোসেন যেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, সে-সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বদরগঞ্জ যুদ্ধ, বাহাদুরাবাদ ঘাট যুদ্ধ ও ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি যুদ্ধ। ৮ই এপ্রিল বদরগঞ্জে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিরক্ষা যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। ৩১শে জুলাই ‘জেড’ ফোর্স যুগপৎভাবে তিনটি পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কামালপুর, অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নকশী এবং আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বাধীন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট শত্রুদখলকৃত এলাকার ৩০ মাইল ভেতরে ঢুকে বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণ করে তা দখলে নেয়। সুরমা নদীর তীরবর্তী ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি শক্ত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। ১৪ই অক্টোবর আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের এ অবস্থানের ওপর আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানি সেনারা পর্যুদস্ত হয় এবং ছাতকের একাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। পরের দিন সিলেট থেকে সড়কপথে পাকসেনাদের একটি নতুন দল এসে যোগ দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তাছাড়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তিনটি হেলিকপ্টার আকাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বিরামহীনভাবে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই হতাহত হন। আনোয়ার হোসেন বিচলিত না হয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। ১৬ই অক্টোবর পর্যন্ত যুদ্ধ চলার পর সিমেন্ট ফ্যাক্টরি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আনোয়ার হোসেন তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন ১৯৯২ সালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। তিনি এ বছরের ১০ই জুন থেকে ১৯৯৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ রাইফেলস-এর মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৩ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তারপর তিনি ২০১২ সাল পর্যন্ত ‘একটিভেট বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ২রা নভেম্বর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা পরলোক গমন করেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন দুই পুত্রসন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম খুরশিদা আনোয়ার। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড