বীর বিক্রম মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৪৮) বীর মুক্তিযোদ্ধা, ‘ক্রাক প্লাটুন’ নামে খ্যাত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর অন্যতম সদস্য, ঢাকায় সহযোদ্ধাদের নিয়ে একাধিক সফল অপারেশন পরিচালনাকারী, মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ‘বীর বিক্রম’ রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত, সাবেক মন্ত্রী, বর্তমানে আওয়ামী লীগ-এর কেন্দ্রীয় নেতা। ১৯৪৮ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার মোহনপুরে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম আলী আহমেদ মিয়া, মাতা আক্তারুন্নেছা। তিনি জগন্নাথ কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এমএ পাস করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এলএলবি এবং মিউজিক কলেজ থেকে আই মিউজিক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২৬শে মার্চের পর তিনি উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। ভারতের মেলাঘর ক্যাম্পে অন্যান্যদের সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং ক্যাপ্টেন হায়দারের তত্ত্বাবধানে বিশেষ গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের ১৬ সদস্যের একটি গ্রুপকে ঢাকায় পাঠানো হয় এবং এটি ‘ক্রাক প্লাটুন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ক্রাক প্লাটুনের এ গ্রুপটির প্রতি নির্দেশ ছিল, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান বা স্থাপনায় আক্রমণ চালিয়ে তা ধ্বংস বা ত্রাসের সৃষ্টি করা। জুন মাসে ঢাকা শহরে প্রবেশের পর এ গ্রুপের সদস্যরা জানতে পারেন যে, ৯ই জুন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পাকিস্তান সরকারের আহ্বানে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐদিন হাবিবুল আলম, বীর প্রতীকএর নেতৃত্বে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, কামরুল হক স্বপন প্রমুখ দেয়াল টপকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রবেশ করে পরপর ৩টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরাপদে ফিরে আসেন। এরপর তাঁরা রমনায় মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির অন্যতম সংগঠক এডভোকেট এ কিউ এম শফিকুল ইসলামের বাসায় ২টি, দৈনিক পাকিস্তান এবং মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসে ২টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটান। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ঢাকায় গেরিলাদের সরব উপস্থিতি জানাজানি হয়ে যায়। এর ফলে ঢাকায় পাকবাহিনীসহ বিদেশী দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, সাংবাদিক কেউ যে নিরাপদ নয়, তা বহির্বিশ্বে গুরুত্বসহকারে প্রচার পায় এ বাহিনী আগস্টের প্রথমদিকে ফার্মগেটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে কয়েকজন পাকসেনাকে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে উলন পাওয়ার স্টেশন, গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন, ওয়াপদা পাওয়ার স্টেশন, কাঁটাবন মসজিদের নিকট ভূগর্ভস্থ পাওয়ার স্টেশনে হামলা চালানো হয় এবং এর প্রত্যেকটিতে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
স্বাধীনতার পর মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া প্রথমে আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি কারাবরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৬ এবং ২০১৪ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ-সময় তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম পারভীন চৌধুরী। এ দম্পতির ১ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তান রয়েছে। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বর্তমানে সপরিবারে ঢাকার বারিধারায় বসবাস করছেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড