নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন
মোয়াজ্জেম হোসেন (১৯৩৩-১৯৭১) নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার, আগরতলা মামলার ২ নম্বর আসামী, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ ও মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত। তিনি ১৯৩৩ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর পিরোজপুর জেলার ডুমুরতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোফাজ্জেল আলী মোল্লা, মাতা লতিফুননেছা বেগম। পিতা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। মোয়াজ্জেম হোসেন ১৯৪৭ সালে কচুয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ১৯৫০ সালে তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কমিশন পেয়ে যোগ দেন। তিনি ১৯৫৮-১৯৬০ সালে ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ১৯৬৬ সালে নেভাল বেস চট্টগ্রামে চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ সালে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদে উন্নীত হন এবং ডেপুটেশনে তিনি বরিশালে পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থায় যোগ দেন।
পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকরিকালে বাঙালি ও অবাঙালিদের ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ করে মোয়াজ্জেম হোসেন মনে-মনে ক্ষুব্ধ হন। এক পর্যায়ে তিনি বাঙালি অফিসার সৈনিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি নৌবাহিনীর স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, কর্নেল আলমসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার কয়েকজন বাঙালিকে নিয়ে অতি গোপনে একটি ‘বিপ্লবী সংস্থা’ গড়ে তোলেন এবং সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করেন। পরবর্তী সময়ে কর্নেল শওকত আলী, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) মির্জা মোহাম্মদ রমিজ (চট্টগ্রামের স্টেশন ম্যানেজার, পিআইএ), পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রাক্তন লিডিং সিম্যান সুলতান উদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন ডা. খুরশীদ উদ্দীন আহমেদ, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ওয়াহেদ, মর্টার ব্যাটারির মেজর সালামত আলী খান সুর, লেফটেন্যান্ট খালেক, ক্যাপ্টেন এ এন এম নুরুজ্জামান প্রমুখ বিপ্লবী সংস্থার সদস্য হন। আইএসআই-এর মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার বিপ্লবী সংস্থার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত হয় এবং এর সদস্যদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে থাকে।
এদিকে ১৯৬১ সাল থেকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সক্রিয় রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে মনস্থির করেন এবং এ লক্ষ্যে অনেকেরে সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঘোষণা করেন বাঙালির ‘মুক্তিসনদ’ খ্যাত ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচি। সাধারণ বাঙালিদের মতো পেশাদার বাহিনীর মধ্যেও এর দ্রুত প্রভাব পড়ে এবং এর পক্ষে সমর্থন সৃষ্টি হতে থাকে।
এমনি অবস্থায় ১৯৬৭ সালের ৯ই ডিসেম্বর সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের একটি দল পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইনে মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করে। এভাবে ১৯৬৮ সালের ৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৬-দফা প্রচারকালে বন্দি হওয়া বঙ্গবন্ধুকে একই আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে ১ নম্বর আসামি করে সামরিক-বেসামরিক মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়, যার নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’। তখন এটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে অধিক পরিচিত ছিল (দ্রষ্টব্য আগরতলা মামলা)। পাকিস্তান সরকার ফৌজদারি আইন সংশোধন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে অভিযোগনামা গঠন করে। মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন ২য় নম্বর আসামি। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সাল থেকে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৌবাহিনীতে অবস্থানরত বাঙালিদের সমন্বয়ে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলা, সেনা ও বিমান বাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের এ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা, কার্যক্রম সফল করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-সহ পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সিভিল সার্ভিসের বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন গোপন বৈঠকে মিলিত হওয়া এবং সংগঠন পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ করার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। আইয়ুব সরকার কর্তৃক দায়েরকৃত আগরতলা মামলা ও অভিযুক্তদের ঢাকা সেনানিবাসে বিচারকার্য শুরু হলে পূর্ব বাংলায় ছাত্র-জনতার প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে ওঠে, সৃষ্টি হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-। ফলে আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি নিঃশর্ত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুসহ অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর মোয়াজ্জেম হোসেন নৌবাহিনীর চাকরিতে পুনর্বহাল হন। ১৯৭০ সালের ১৮ই মার্চ তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসরকালে তিনি ৩৬ এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় বসবাস করতেন।
অবসর গ্রহণের পর মোয়াজ্জেম হোসেন প্ৰত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭০ সালের ২৩শে মার্চ তিনি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের (১৯৪০) ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ঘোষণা দেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ২৮শে মার্চ ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি’ নামে একটি সংগঠন গঠন করেন। তিনি ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন’, ‘এক দফা’ ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন। ৭১-এ অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মী ও অনুসারীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের নির্দেশ দেন। ১৬ই মার্চ থেকে ২২শে মার্চ পর্যন্ত তিনি ফরিদপুর, যশোর ও কুষ্টিয়া সফর করেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারশেন সার্চলাইট-এর নামে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে এবং মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন তাদের বিশেষ টার্গেট। ২৬শে মার্চ সকাল বেলা পাকিস্তানি সৈন্যরা এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় হামলা চালিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁকে প্রথমে গুলি ও পরে বেয়নেট চার্জ করা হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে দৃঢ় কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেন, ‘আমি স্বাধীন বাংলাদেশ চাই’। তাঁর মরদেহ পাকিস্তানি সৈন্যরা গভর্নর টিক্কা খানকে দেখানোর জন্য বঙ্গভবনে নিয়ে যায়। তাঁর লাশ আর পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতাকামী এ বীর শহীদের অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০১২ সালে ‘স্বাধীনতা’ পদক (মরণোত্তর)-এ ভূষিত করে।
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন স্মরণে ১৯৭৬ সালের ১৬ই জুন রাঙ্গামাটিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ ঘাঁটির নামকরণ করা হয় ‘বি এন এস শহীদ মোয়াজ্জেম’। বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ ১৯৯৩ সালের ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নামে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন সড়ক’। তিনি ২ পুত্র ওয়ালি নোমান ও ওয়াসি নোমান এবং ১ কন্যা ওয়াদিয়া নোমান-এর জনক। তাঁর স্ত্রী কোহিনুর হোসেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড