You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে মোড়েলগঞ্জ উপজেলা (বাগেরহাট)

মোড়েলগঞ্জ উপজেলা (বাগেরহাট) বাগেরহাট জেলার উপকূলবর্তী একটি উপজেলা। ১৯৫২ সালের ভাষা- আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে মোড়েলগঞ্জের মানুষ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধের ঘোষণা দিলে এ অঞ্চলের মানুষ বিক্ষুব্ধ ও আন্দোলনমুখর হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ২রা মার্চ থেকে সর্বাত্মক হরতালের ঘোষণা দিলে এখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা পালিত হয়। এরপর তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ- এবং ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণায় এ অঞ্চলের মানুষ মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
৮ই মার্চ মোড়েলগঞ্জ থানা ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। থানা ছাত্রলীগের সভাপতি লিয়াকত আলী খানকে পরিষদের আহ্বায়ক করা হয়। পরিষদের অন্য সদস্যরা হলেন- প্রণব কুমার ঘোষ (মানিক), নুরুল ইসলাম হাওলাদার, মোস্তফা কামাল বাবুল, মোশারেফ হোসেন খান, বজলুর রহমান, নেছার উদ্দিন তালুকদার, হাবীবুর রহমান ফিরোজ, আব্দুল মান্নান তালুকদার, আকরামুজ্জামান, জামাল উদ্দিন বয়াতী, বিমল কুমার সাহা, রনজিত কুমার ঘরাই, চিত্তরঞ্জন রায় ও ইব্রাহীম হাওলাদার।
১০ই মার্চ আওয়ামী লীগ-এর কেন্দ্রীয় নেতা ও খুলনা জেলা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক শেখ আব্দুল আজিজ এমএনএ মোড়েলগঞ্জে এসে থানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আব্দুল লতিফ খান এমপিএ। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- শেখ মুজিবর রহমান (কচুবুলিয়া), বীরেন্দ্রনাথ গুহ (দৈবজ্ঞহাটী), শেখ সুলতান আহমেদ (মোড়েলগঞ্জ), শেখ আব্দুল হাকিম (সানকিভাঙ্গা), ডা. আব্দুল আজিজ (মোড়েলগঞ্জ), ডা. হীরেন্দ্রনাথ (মোড়েলগঞ্জ), ডা. আব্দুল মজিদ (মোড়েলগঞ্জ), কবির আহম্মেদ মধু (মোড়েলগঞ্জ), শামসুল আলম শ্যাম (মোড়েলগঞ্জ), ডা. জামান (মোড়েলগঞ্জ), অধ্যাপক আব্দুর রহিম খান (চালিতাবুনিয়া), জিন্নাত আলী মাস্টার (বাদুরতলা), ডা. শামসুউদ্দিন বাচ্চু (বারইখালী), জেলাপ খান (বারইখালী), মকবুল আহম্মেদ (বহরবুনিয়া), মোসলেম আলী হাওলাদার (পুটিখালী), মন্টু সিকদার (পুটিখালী), ফজলুর রহমান সিকদার (রামচন্দ্রপুর), ছিদ্দিকুর রহমান মৃধা (নিশানবাড়ীয়া), আদেল উদ্দিন বয়াতী (সানকিভাঙ্গা), ডা. মোবারেক হোসেন (শ্রণীখালী) ও মুরারিপদ বসু (বনগ্রাম)। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিয়নেও কমিটি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ নেতা মাস্টার শেখ মুজিবর রহমান হোগলাপাশা, বনগ্রাম, চিংড়াখালী, রামচন্দ্রপুর ও দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের দায়িত্ব পালন করেন। ১২ই মার্চ তাঁর বাড়িতে ৫টি ইউনিয়নের সংগ্রাম কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়। অন্যান্য ৮টি ইউনিয়নেও পর্যায়ক্রমে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন— পঞ্চকরণের ছোহরাব হোসেন ও আব্দুর রাজ্জাক সাজ্জাল, বলাইবুনিয়ার ডা. মোবারক আলী হাওলাদার, দৈবজ্ঞহাটীর বীরেন্দ্রনাথ গুহ, মাস্টার ওয়াজেদ আলী, মোসলেম উদ্দিন হাওলাদার ও মনটু শিকদার, চিংড়াখালীর মুজিবর রহমান তালুকদার, আব্দুল মজিদ, আব্দুস ছত্তার ও আনোয়ার হোসেন খান, হোগলাপাশার আব্দুল লতিফ হাওলাদার, নিরঞ্জন কুমার রায়, নির্মল কুমার বাছাড় ও মফিজুল হক, রামচন্দ্রপুরের শেখ মুজিবর রহমান, সুলতান হোসেন মীর, শিকদার ফজলুর রহমান, বনগ্রামের মুরারিপদ বসু ও মহাদেব ব্যানার্জী, হোগলাবুনিয়ার শেখ আ. হাকিম, ওয়াজেদ আলী হাওলাদার ও আদেল উদ্দিন বয়াতি, বহরবুনিয়ার মকবুল হোসেন ও শাহাবুদ্দিন, বারইখালীর আশ্রাফ আলী, আ. মজিদ ও শামসুদ্দিন বাচ্চু, নিশানবড়ীয়ার ছিদ্দিকুর রহমান মৃধা ও নূরুল ইসলাম, মোড়েলগঞ্জের জিন্নাত আলী মাস্টার ও আ. আজিজ, খাউলিয়ার মুনছুর আলী হাওলাদার, হোসেন আলী হাওলাদার, আ. রহিম খান প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হওয়ার পর ছাত্র-জনতা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে মোড়েলগঞ্জ, তেলিগাতি ও দৈবজ্ঞহাটীতে সমবেত হয়। তারা মোড়েলগঞ্জ গোডাউন ময়দানে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে। কবির আহম্মেদ মধু ও লিয়াকত আলী খানসহ বেশ কয়েকজন ট্রেনিং-এর দায়িত্ব নেন। তেলিগাতী ও দৈবজ্ঞহাটীতেও অনুরূপ অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়। এই ট্রেনিং ক্যাম্পের দায়িত্ব নেন ছুটিতে থাকা সেনাসদস্য রজবালী শিকদার, ইপিআর সদস্য মোক্তার আলী মীর প্রমুখ। বাগেরহাট মহকুমা সদরে একাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প গঠন করা হয়। এর মধ্যে নাগেরবাড়ি ক্যাম্পটি ছিল স্থায়ী ও সুরক্ষিত। মোড়েলগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে কয়েকশ যুবক বাগেরহাটে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন।
২৪শে এপ্রিল পাকবাহিনী বাগেরহাট আক্রমণ করলে নাগেরবাড়ি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় ফিরে স্থানীয়ভাবে ছোট-ছোট ক্যাম্প তৈরি করেন, কেউ-কেউ প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারতে যান। এ-সময় কবির আহম্মেদ মধু (পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত এবং ছুটিতে আসা সেনাসদস্য) ও লিয়াকত আলী খান খাউলিয়া গ্রামে রাধাগোবিন্দ সিকদারের বাড়িতে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলেন। ছলেমান খোকন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা তেলিগাতি স্কুলে অরেকটি ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। মোড়েলগঞ্জের উত্তরে শেখ মশিউর রহমান (বাগেরহাট মহকুমা ছাত্রলীগের সম্পাদক এবং স্বেচ্ছাসেবক কমিটির আঞ্চলিক সভাপতি)-এর নেতৃত্বে একটি আঞ্চলিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন হেমায়েত হোসেন মোল্লা, আনোয়ার হোসেন খান, সুলতান হোসেন খান, মোক্তাদির হোসেন হাওলাদার, হাবিবুর রহমান সরদার, উকিল উদ্দিন শেখ প্রমুখ। ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন ও কবির আহম্মেদ মধুর নেতৃত্বে সুন্দরবনে কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। এ ক্যাম্পগুলো হায়লাতলা স্টুডেন্ট ক্যাম্প, বঙ্গবন্ধু ক্যাম্প ইত্যাদি নামে পরিচালিত হতো। সুন্দরবনের এসব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে হাজার-হাজার মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং শেষে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এছাড়াও প্রত্যেক ইউনিয়নে আলাদা-আলাদা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে কাজের নির্দেশনা দেয়া হয়। সংগ্রাম কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর যৌথ পরিকল্পনায় এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধানের কাজ চলতে থাকে। এছাড়া জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে বন্দুক, লাঠি, দা ও তীর-ধনুক নিয়ে পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৩শে মার্চ সকালে দৈনিক সংবাদ-এর প্রথম পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের পতাকার একটি নমুনা ছাপানো হয়। পতাকার নমুনা পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বাগেরহাটের সব দর্জির দোকানে নতুন পতাকা তৈরির কাজ শুরু হয়। ২৩শে মার্চ প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচি শেষে শেখ মশিউর রহমান বাগেরহাট থেকে কয়েকটি বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এসে দৈবজ্ঞহাটী, পোলেরহাট ও রামচন্দ্রপুর বাজারসহ অন্যান্য স্থানে সরবরাহ করার সঙ্গে-সঙ্গে ঐ সকল স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। তিনি ও মহকুমা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আ. রহমান সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করেন। এরপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। মোড়েলগঞ্জ থানা সংগ্রাম কমিটির সদস্য শামছুল আলম শ্যাম তাঁর নিজের মেশিনে নিজেই কয়েক শত বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করে সরবরাহ করেন।
২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শেখ আব্দুল আজিজ তাঁর বাসার টেলিফোনে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয় অবগত করেন। পুলিশের সিআই আ. হাকিম খানের সহায়তায় ঐ রাতেই শেখ মুজিবর রহমান খুলনা শহরে বসবাসরত সালাউদ্দিন ইউসুফ এমপিএ ও আব্দুল লতিফ খান এমপিএ-র বাসায় গিয়ে শেখ আব্দুল আজিজের টেলিফোন বার্তা পৌছে দিয়ে ২৬শে মার্চ দুপুরের আগেই বাগেরহাটে চলে আসেন এবং প্রফেসর শামসুর রহমানের বাসায় পৌঁছে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করেন এবং শেখ আব্দুল আজিজের বার্তাসহ স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র (খুলনা পুলিশ লাইন্স থেকে পাওয়া) প্রদান করেন। সেই ভিত্তিতে মহকুমা আওয়ামী লীগ সম্পাদক সৈয়দ অজিউর রহমান তাৎক্ষণিক সংগ্রাম কমিটির মিটিং ডাকেন।
মোড়েলগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— শেখ আব্দুল আজিজ এমএনএ, আব্দুল লতিফ খান এমপিএ, শেখ মুজিবর রহমান মাস্টার (খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা), বীরেন্দ্রনাথ গুহ (তেলিগাতী), সোহরাব হোসেন (পঞ্চকরণ ইউনিয়ন), মন্টু শিকদার (পুটিখালী ইউনিয়ন), মোসলেম আলী হাওলাদার (দৈবজ্ঞহাটী ইউনিয়ন), শিকদার ফজলুর রহমান (রামচন্দ্রপুর, মুক্তিযোদ্ধা), মুজিবর রহমান তালুকদার (চিংড়াখালী), আব্দুল লতিফ হাওলাদার (হোগলাপাশা), মুরারিপদ বসু (বনগ্রাম), ডা. মোবারেক আলী হাওলাদার (বলইবুনিয়া), শেখ আব্দুল হাকিম (হোগলাবুনিয়া), মকবুল হোসেন (বহরবুনিয়া), ছিদ্দিকুর রহমান মৃধা (নিশানবাড়ীয়া), জেলাপ খান (বারইখালী), শেখ সুলতান আহম্মেদ (মোড়েলগঞ্জ), মুনছুর আলী হাওলাদার (খাউলিয়া, মুক্তিযোদ্ধা), হোসেন আলী হাওলাদার (খাউলিয়া), ডা. আব্দুল আজিজ (মোড়েলগঞ্জ) প্রমুখ।
এ উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা হলেন— কবির আহম্মেদ মধু (কমান্ডার, সুন্দরবন সাব-সেক্টর, পশ্চিম মোড়েলগঞ্জ), মো. লিয়াকত আলী খান (কমান্ডার, স্টুডেন্টস ক্যাম্প, সুন্দরবন সাব -সক্টর), মো. নুর মহম্মদ হাওলাদার (কোম্পানি কমান্ডার, বঙ্গবন্ধু ক্যাম্প, সুন্দরবন সাব-সেক্টর), আমজাদ হোসেন মল্লিক (কমান্ডার, টাইগার ক্যাম্প, সুন্দরবন সাব- সেক্টর), সুলতান আহম্মদ খান (কমান্ডার, মুজিব বাহিনী), সলেমান খান খোকন (কমান্ডার, তেলিগাতী), মোক্তার আলী মীর (তেলিগাতী), কারী আবুল হাসেম (সহকারী কমান্ডার, বঙ্গবন্ধু কোম্পানি, সুন্দরবন সাব সেক্টর), খালিদ হোসেন (সহকারী কমান্ডার সুন্দরবন পশ্চিম অঞ্চল, সুন্দরবন সাব-সেক্টর), মোসলেম উদ্দিন (সহকারী কমান্ডার, মুজিব বাহিনী), আব্দুল হাই খোকন (এডজুটেন্ড, হেডকোয়ার্টার্স, সুন্দরবন সাব-সেক্টর), আমজাদ হোসেন লাল মিয়া (এডজুটেন্ড, বঙ্গবন্ধু কোম্পানি, সুন্দরবন সাব- সেক্টর), শেখ মসিউর রহমান (ডিউটি অফিসার, বঙ্গবন্ধু ক্যাম্প, সুন্দরবন সাব-সেক্টর), মোশাররফ হোসেন তালুকদার (ইয়াং অফিসার, সুন্দরবন সাব-সেক্টর), মোশাররফ হোসেন খান (ইয়াং অফিসার, সুন্দরবন সাব- সেক্টর), মোখলেছুর রহমান (কমান্ডার, ওপি পোস্ট), বজলুর রহমান (কমান্ডার)।
সংগ্রাম কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর যৌথ উদ্দ্যোগে মোড়েলগঞ্জ থানার প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বিশেষ করে পাকবাহিনী যাতে নির্বিঘ্নে এ অঞ্চলে আসা-যাওয়া করতে না পারে সেজন্য রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়া হয়। কবির আহমেদ মধু, লিয়াকত আলী খান, শেখ মশিউর রহমান এবং ছলেমান খান খোকনের নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত পাহারার ব্যবস্থা করা হয়।
৬ই মে বৃহস্পতিবার পাকবাহিনী একটি গানবোট নিয়ে উপজেলার বেতবুনিয়া গ্রামে প্রবেশ করে। গানবোট থেকে নেমেই তারা যতীন মাঝির বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া গ্রামের শতাধিক বাড়িঘরে পাকসেনারা অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও নারীনির্যাতন করে। এরপর তারা বারইখালী ইউনিয়ন কাউন্সিলের দোতলা ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ নেজামে ইসলামী-, পিডিডি- ও ইসলামী ছাত্র সংঘ – যৌথভাবে থানা সদরে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠন করে পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে তৎপরতা শুরু করে। এসব সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এলাকার যুবকদের চাকরি, অর্থের লোভ এবং তথাকথিত ধর্মীয় শান্তি রক্ষার নামে রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করতে প্ররোচিত করে। যাদের নেতৃত্বে শান্তি কামিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়, তারা হলো— মাওলানা এ কে এম ইউসুফ (জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা), আতাহার আলী খান (মুসলিম লীগ নেতা), এডভোকেট আলতাফ হোসেন (মুসলিম লীগ নেতা), মুফতি মাওলানা আব্দুস ছত্তার, মোক্তার আলী খান (তেলিগাতী), আব্দুল গণি শিকদার (পুটিখালী), নাদের হোসেন (রামচন্দ্রপুর), মোসলেম আলী হাওলাদার (চিংড়াখালী), আব্দুর রশিদ ফরাজী (হোগলাপাশা ইউনিয়ন), শামছুল হক সরদার (বনগ্রাম, দাসখালী), আশ্রাব আলী সরদার (দাসখালী), কেরামত আলী মোল্লা ( ছোট কুমারখালী, রামচন্দ্রপুর), হাজী নুরুল হক (জামায়াত নেতা, হোগলাবুনিয়া), সিরাজ উদ্দিন মাস্টার ( চেয়ারম্যান, বহরবুনিয়া), নজির উদ্দিন খান (জিউধরা), মোসলেম গাজী (চেয়ারম্যান, নিশানবাড়ীয়া), ছাইদুর রহমান তালুকদার (চেয়ারম্যান, মোড়েলগঞ্জ), মাওলানা মোসলেম উদ্দিন (খাউলিয়া) ও আরব আলী (জামায়াত নেতা, বরইখালী) – এছাড়া পাকবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় দোসর হিসেবে তাদের লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে যারা সহযোগিতা করে, তারা হলো- মিয়া মোহাম্মদ আব্বাস (পিতা মানিক মিয়া; কমান্ডার, আলবদর বাহিনী; বারইখালী), আশ্রাব আলী (ইসলামী ছাত্র সংঘ, বারইখালী), শেরজন মৃধা (সোনাখালী), আবু ছালেহ শিকদার (জিউধরা), আব্দুল মৃধা (জিউধরা), হাজী নুর মহম্মদ (বলইবুনিয়া), দবির উদ্দিন তালুকদার (সরালিয়া), আবুল কাসেম শাহ ফকির (কালিবাড়ী), নাদের হোসেন হাওলাদার (কচুবুনিয়া), আইউব আলী হাওলাদার (চণ্ডিপুর), মোসলেম উদ্দিন হওলাদার (চিংড়াখালী), আব্দুল মালেক তালুকদার (বৌলপুর), আব্দুর রশিদ ফরাজী (গোবিন্দপুর; শান্তি কমিটির সদস্য), ফতেহ উদ্দিন মীর (বৌলপুর; শান্তি কমিটির সদস্য), শামছুল হক সরদার, মুনছুর আলী শিকদার (কালিকাবাড়ী; রাজাকার), মাওলানা আব্দুল লতিফ (রাজাকার, বনগ্রাম), আব্দুল বারেক হাওলাদার (রাজাকার, মোহনপুর), মোজাম্মেল হক হাওলাদার মোজাম (রাজাকার, মোহনপুর), হাফেজ সামছুর রহমান (রাজাকার কমান্ডার, খাউলিয়া), মো. ফারুক (পিতা ছৈয়দ আলী হাওলাদার, রাজাকার কমান্ডার; মোড়েলগঞ্জ), আমির আলী জল্লাদ (রাজাকার; মোড়েলগঞ্জ), মহম্মাদ আলী জল্লাদ (রাজাকার; মোড়েলগঞ্জ), মহম্মদ আলী হাওলাদার, আব্দুস ছালাম জল্লাদ (রাজাকার; মোড়েলগঞ্জ), মৌ. আব্দুল জব্বার হাওলাদার (শান্তি কমিটির সদস্য; কদম রশুলের পাড়), মুনসুর আলী হাওলাদার (জিলবুনিয়া), এনছাব আলী খান (রাজাকার, খালকুলিয়া), শাহাদাত আলী খান (রাজাকার, খালকুলিয়া), আব্দুস ছালেক খান (খালকুলিয়া), রুস্তম আলী খান মোসলেম আলী (পিতা আজাহার; রাজাকার কমান্ডার; সোলমবাড়ীয়া), মোফাক্কর আলী খান (খালকুলিয়া), নওশের আলী খান (খালকুলিয়া), শামছুর রহমান খান (রাজাকার, সোলমবাড়ীয়া), আলী আজিম (ফুলহাতা), আফতাব উদ্দিন হাওলাদার (আলবদর; চণ্ডিপুর), সোহরাব হোসেন খান (খালকুলিয়া), শাহ আলম তালুকদার (সরালিয়া), আব্দুল আজিজ তালুকদার (সরালিয়া), মোবারক আলী হাওলাদার (পশ্চিম সরালিয়া), মনসুর আলী শিকদার (রাজাকার কমান্ডার, কালিকাবাড়ি), হাফেজ শামসুর রহমান (রাজাকার কমান্ডার, খাউলিয়া), প্রমুখ।
চিংড়াখালী ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সভাপতি আইউব আলী মাস্টার ও তার সহযোগীদের আহ্বানে ৬ই মে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় পিরোজপুর থেকে পাকবাহিনী একটি গানবোট নিয়ে এসে বেতবুনিয়া গ্রাম আক্রমণ করে ব্যাপক গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটায়। এখানে তারা ১৩৫ জন লোককে গুলি করে হত্যা করে, যা বেতবুনিয়া গণহত্যা হিসেবে পরিচিত।
১১ই মে মাওলানা ইউছুফ, বাগেরহাট মহকুমা শন্তি কমিটির আহ্বায়ক ডা. মোজাম্মেল, বাগেরহাট রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকির, আতাহার আলী খান, এডভোকেট আলতাফ হোসেন, চেয়ারম্যান মোক্তার আলী খান ও মোসলেম মাওলানার নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী ও পাকবাহিনী একটি লঞ্চযোগে মোড়েলগঞ্জ বন্দরে অবতরণ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন লোককে গুলি করে হত্যা করে। সেরেস্তাদার বাড়ির ভেতরে কয়েকটি ঘরে তালা দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিলে সেখানে অনেক লোক পুড়ে মারা যায়। আগুনে পুড়ে বিশ্লেশরের পিতা মারা যায়। পাকসেনারা ভূঁই মালী বাড়ির এক হিন্দু লোককে ধরে এনে হত্যা করে। এরপর রাজেশ্বর বাবুকে ধরে এনে মোড়েলগঞ্জ টারমিনালে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া আরও কয়েকজন লোককে তারা সেখানে গুলি করে হত্যা করে। তারা কবির আহমদ মধুর বসতবাড়ি ও লিয়াকত আলীর পিতার দোকান ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বাজারের দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্বচারে লুট করে। রাজাকাররা তিনশতের মতো দোকান ঘর ও বসতবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এভাবে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মোড়েলগঞ্জকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।
হোগলাপাশা ও বনগ্রাম ইউনিয়নের শান্তি কমিটির নেতাদের আহ্বানে পিরোজপুর থেকে পাকবাহিনী ১২ই মে বুধবার দুপুর বেলা বলেশ্বর নদী পাড়ি দিয়ে মহিষপুরা খেয়াঘাটে আসে। এরপর শান্তি কমিটির সদস্যদের নিয়ে মহিষপুরা, ছোট হরিপুর, বড় হরিপুর, বৌলপুর, দাসখালী, বনগ্রাম ও বলভদ্রপুর গ্রামে ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনা ঘটায়। ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিয়ে তারা গণহত্যায় মেতে ওঠে পাকসেনারা এ অভিযানে ৫০ জনের মতো লোককে হত্যা করে। এটি ২ মহিষপুরা গণহত্যা – নামে পরিচিত। এখানকার হিন্দু অধ্যুষিত পাড়াগুলোতে পাকসেনাদের অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা ছিল বেশি। হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে যারা নির্যাতনের শিকার হন, তাদের কেউ- কেউ লোকজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করেন এবং কেউ-কেউ ভারতে চলে যান। পাকসেনারা মহিষপুরার চিত্তরঞ্জন হালদারের নব বিবাহিতা স্ত্রীকে তার সামনেই নির্যাতন করে এবং চিত্তরঞ্জনকে গুলি করে হত্যা করে। এ শোক ও লজ্জা সহ্য করতে না পেরে চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
মোড়েলগঞ্জে ধ্বংসযজ্ঞের ৩ দিন পর পাক মিলিশিয়া বাহিনী ও রাজাকাররা মোড়েলগঞ্জ থানার কাছে বারইখালী ইউনিয়ন কাউন্সিলের দোতলা ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা রাজাকার কমান্ডার খাউলিয়ার মো. ফারুক, সহকারী কমান্ডার আব্দুস ছালাম, মাওলানা মোসলেম এ ক্যাম্পের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। আতাহার আলী খান, আলতাফ হোসেন ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মোক্তার আলী খানের নেতৃত্বে মোড়েলগঞ্জ উত্তরাঞ্চলের দৈবজ্ঞহাটী বিশ্বাস বাড়িতে (জমিদার বাড়ি) রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিল করম আলী মোল্লা, আব্দুল কাদের মোল্লা, আব্দুল হামিদ মোল্লা ও অধ্যাপক ফজলুর রহমান তালুকদার। রাজনৈতিকভাবে এদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব প্রদান করা হয় মুফতি মাওলানা আব্দুস ছত্তারের ওপর। মাওলানা ইউসুফ ও আতাহার আলী খানের মৌখিক নির্দেশে এ অঞ্চলে অনেকে রাজাকার হয়। খুলনা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা উপজেলার নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ৫ই মে বাগেরহাট শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সংহতি ও আদর্শ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রচারপত্র বিলি করা হয়। মোড়েলগঞ্জে পাক মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনী হাটবাজারে এসব প্রচারপত্র বিলি করে এবং শান্তি কমিটির নির্দেশ মোতাবেক গ্রামে-গ্রামে ঢুকে ব্যাপক লুটতরাজ ও নারীনির্যাতন চালায়। রাজাকার ও পাক মিলিশিয়াদের তৎপরতা দিনদিন বেড়েই চলছিল। ফলে বহু হিন্দু পরিবার ও আওয়ামী লীগপন্থী মুসলমান পরিবার ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। যাওয়ার পথে অনেকেই পাকহানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের আক্রমণের শিকার হয়। যেসব হিন্দুরা পালিয়ে যেতে পারেনি, তাদের ধরে হত্যা করা হয় বা জোরপূর্বক মুসলমান বানানো হয়। মুসলমান হয়েও অনেকে রেহাই পায়নি।
মোড়েলগঞ্জের লক্ষ্মীখালী গ্রামের মতুয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মগুরু গোপালচাঁদ সাধু ঠাকুরের বাড়িতে প্রতিবছর সাধুর মেলা হয়। এখানে হাজার-হাজার মতুয়া সম্প্রদায়ের ভক্তদের সমাগম ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অসংখ্য ভক্ত এখানে এসে আশ্রয় নেয়। ২৩শে মে বাগেরহাটের রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর একটি বড় দল এসে সাধুর বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও গণহত্যা চালায়। এখানে তারা মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব আলী মেম্বারসহ ১৭৯ জন লোককে গুলি করে হত্যা করে। এটি ২ লক্ষ্মীখালী গণহত্যা- হিসেবে পরিচিত। পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী মোড়েলগঞ্জ বাজারে অভিযান চালিয়ে তিন শতাধিক দোকানপাট ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তারা বাজার এবং এর আশপাশের ঘরবাড়িতে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কবির আহম্মেদ মধুর বাড়ি এবং সানকিভাঙ্গা গ্রামের লিয়াকত আলী খানের দোকান ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা বহু নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। পাকবাহিনীর দোসর মেজাফ্ফর হাওলাদার ২ জন যুবতী নারীকে হানাদার বাহিনীকে খুশি করার জন্য তাদের হাতে তুলে দেয়। পাকসেনারা মোড়েলগঞ্জ বাজার ও তার আশপাশের গ্রামের বেশকিছু মানুষকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়, যা মোড়েলগঞ্জ গণহত্যা নামে পরিচিত। মোড়েলগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের র সহযোগিতা করার অভিযোগে ১৫ই আগস্ট রাজাকাররা সুতালড়ী গ্রামের আব্দুর রহমান হাওলাদার, তসিমুদ্দিন সরদার ও গয়েজদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে স্থানীয় তেতুলবাড়ীয়া বাজারে এনে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন করে এবং তসিমুদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে। একই দিন তারা মোহন (পিতা মনোহর ঋষি) এবং কবল চন্দ্র ঋষি (পিতা রাধা মোহন ঋষি, সুতালড়ী)-কে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা সায়েজ উদ্দিনকে বন্দি অবস্থায় মোড়েলগঞ্জ টর্চার সেলে এনে নির্যাতন করে একদিন পর হত্যা করে।
২৬শে মে পিরোজপুর ক্যাম্পের পাকবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার বাহিনী একত্রে তেলিগাতী আসে। এদের নেতৃত্ব দেয় পঞ্চকরণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোক্তার আলী খান ও তার সহযোগী হাসেম আলী দিহিদার। পথপ্রদর্শক ছিল কাকার বিলের নুর শিকদার এবং যশোরাদির আফসার শেখ। পাকসেনারা তাদের দোসরদের সহযোগিতায় তেলিগাতী গ্রামে হামলা চালিয়ে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা (আব্দুল জব্বার খান ও মান্নান খান) এবং ২৫ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, যা তেলিগাতী গণহত্যা নামে পরিচিত।
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ২৯শে জুন তেলিগাতী গ্রামের রেহেনের বাড়িতে অবস্থান করছিল। খবর পেয়ে দৈবজ্ঞহাটির রাজাকার কমান্ডার মোদাচ্ছের আলীর নেতৃত্বে রাজাকাররা রেহেনের বাড়ি আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধা কেস্ট ও হাবিবুর রহমান কোটাল গুলিবিদ্ধ হন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোক্তার আলী মীর ও কেস্ট পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন। কিন্তু হাবিবুর রহমান আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। রাজাকাররা তাকে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করে। এরপর তাঁকে দৈবজ্ঞহাটী বিশ্বাস বাড়ি রাজাকার ক্যাম্পের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করে। একদিন পর বাগেরহাট নিয়ে পুনরায় নির্যাতন শেষে পরের দিন খুলনা পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। দৈবজ্ঞহাটি যুদ্ধের পর রাজাকাররা তৈয়ব আলী শেখ (পিতা তোরাব আলী শেখ, হামচাপুর)-কে ধরে এনে বটগাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে। এরপর টর্চার সেলে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে একদিন পর তাকে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধা সাহেব আলী তালুকদার (পিতা আবছার আলী তালুকদার, ভাইজোড়া)-কে ধরে এনে মোড়েলগঞ্জ পাকবাহিনীর বন্দিশিবিরে রেখে কয়েক দিন পর্যন্ত অমানুষিক নির্যাতনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধানে কোনো তথ্য প্রকাশ না করায় ছালাম জল্লাদ তার জিহ্বা কেটে দেয়। তার দুদিন পর রাতে তাকে হত্যা করা হয়। এছাড়া পাকসেনারা বিভিন্ন সময় শের আলী মোল্লা (পিতা মুরাত আলী মোল্লা, ফুলহাতা), অমল বাছাড় (ফুলহাতা), কাদের হাওলাদার (ফুলহাতা), চিত্ত বসু (পিতা গোপাল বসু, ফুলহাতা), সুধীর বোস (ফুলহাতা), অনিল বিশ্বাস (পিতা বাদর বিশ্বাস, বহরবুনিয়া), আব্দুল মোতালিব হাওলাদার (পুলিশ, শ্রণীখালী), বুরজুক আলী শেখ (পিতা হাচেন উদ্দিন, এ.বি গজালীয়), ছালাম মৃধা (পিতা আব্দুর রাজ্জাক, ভাটখালী), মোহাম্মদ আলী ভূঞা (মোড়েলগঞ্জ), আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার (গুয়াবাড়ীয়া) ও মো. তৈয়ব আলী শেখকে নির্যাতনকেন্দ্রে বন্দি রেখে অবিরাম নির্যাতনের পর হত্যা করে। দৈবজ্ঞহাটী ক্যাম্পের রাজাকাররা বিভিন্ন সময়ে আব্দুস কুদ্দুস (পিতা খালেক, সুতালড়ী), ইউছুফ শেখ (পিতা আমিন উদ্দিন, তেলিগাতী), ইসমাইল শেখ (পিতা আব্দুল শেখ, তেলিগাতী) ও গোরা চাঁদ বসু (পিতা অমরেন্দ্র বসু, পুরাতন বাজার, বাগেরহাট)-কে হত্যা করে।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের একটি দল হোগলাবুনিয়া ইউনিয়নের বড় বাদুরা গ্রামের বাছাড় বাড়িতে আক্রমণ করে ৮ জন লোককে হত্যা করে। এটি বাদুরা বাছাড় বাড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত। গণহত্যার পর পাক মিলিশিয়া ও রাজাকাররা বাড়ি-বাড়ি ঢুকে গণধর্ষণ চালায়। ৫ই নভেম্বর শুক্রবার হাটের দিন বিকেলে শতাধিক রাজাকার একত্রিত হয়ে শাঁখারীকাঠি বাজার ঘেরাও করে হাটে আসা ৮২ জন লোককে বেঁধে আলোদিয়া খালের পারে দাঁড় করিয়ে একের পর গুলি করে হত্যা করে। এটি শাঁখারীকাঠি গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। আগস্ট মাসের শেষের দিকে বারইখালী ইউনিয়নে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সহায়তাদানের অভিযোগে বেশ কিছু গ্রামবাসীকে তেতুলবাড়িয়া বাজারে ধরে এনে তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। এরপর তাদের অনেককে গুলি করে হত্যা করে, যা তেতুলবাড়িয়া গণহত্যা নামে পরিচিত।
পাকবাহিনীর দোসররা হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ব্যাপক লুটতরাজ করে। তারা গৃহস্থের ঘরের আসবাবপত্র, খাদ্য- সামগ্রী এমনকি বসতবাড়ি পর্যন্ত ভেঙ্গে নিয়ে যায় এবং জমিজমা দখল করে নেয়। দৈবজ্ঞহাটির রাজাকাররা খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সংগ্রাম কমিটির নেতা কচুবুনিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শেখ মুজিবর রহমানের বাড়িতে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়।
মোড়েলগঞ্জ থানার এমন কোনো হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম নেই যেখানে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নারীনির্যাতন করেনি। কোনো-কোনো এলাকায় মুসলমান পরিবারের নারীরাও নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। বিশেষ করে চণ্ডিপুর, বেতবুনিয়া, মহিষপুরা, হোগলাপাশা, বড় হরীপুর, দাসখালী, বনগ্রাম, বলভদ্রপুর, রামচন্দ্রপুর চিংড়াখালী, দৈবজ্ঞহাটি, মিস্ত্রীডাঙ্গা, শাঁখারীকাঠি, তেতুলবাড়ীয়া, নিশানবাড়িয়া, খাউলিয়া সন্নাসী ও জিউধরা গ্রামে অনেক নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পাকসেনারা জিউধরা গোপাল সাধুর বাড়িতে হত্যা ও লুটতরাজ শেষে ঝোপের মধ্যে পলাতক এক মহিলাকে টেনে বের করে। এরপর তার দুই শিশুপুত্রকে কোল থেকে টেনে নিয়ে গাছের সঙ্গে আছড়ে হত্যা করার পর মহিলাকে কয়েকটা নরপশু ধর্ষণ করে। মহিলা এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। একই দিন তারা আরো অনেক তরুণীকে ধরে এনে গণধর্ষণ করে।
উল্লেখ্য, মে মাসের প্রথম দিকে পাকসেনারা পিরোজপুর থেকে চিংড়াখালী গ্রামে এসে এক হিন্দু বাড়িতে আশ্রিত ছয় যুবতীকে গণধর্ষণ করে। রাজাকাররা তাদের প্রভু পাকবাহিনীকে খুশি করার জন্য বিভিন্ন গ্রাম থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে এনে উপহার দিয়েছে এবং নিজেরাও ভোগ করেছে। দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্প, গুরুদাস বিশ্বাসের বিল্ডিং ও মোড়েলগঞ্জের কয়েকটি স্থান ছিল নারীনির্যাতনের কেন্দ্র। রাজাকাররা এসব কেন্দ্রে তরুণীদের ধরে এনে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালাত এবং পাকবাহিনী ও শান্তি কমিটির নেতাদের মনোরঞ্জনের জন্য জোগান দিত।
পাকবাহিনী মোড়েলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করে। সেগুলোর মধ্যে সুকুমার সাহার বিল্ডিং, জিতেন বাবুর বিল্ডিং, শিবাজি বিশ্বাসের বিল্ডিং ও মহালক্ষ্মী বিশ্বাসের বিল্ডিং উল্লেখযোগ্য। এসব নির্যাতনকেন্দ্রে তারা গ্রামবাসীকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করত। অনেক সময় তাদের গাছের সঙ্গে বেঁধে ছুরি দিয়ে সারা শরির ক্ষত- বিক্ষত করে রক্তাক্ত শরীরে লবণ ও মরিচ মাখিয়ে দিত।
এ উপজেলায় বেশ কয়েকটি গণকবর রয়েছে। সেগুলো হলো— বেতবুনিয়া গণকবর, হোগলাবুনিয়া গণকবর, মোড়েলগঞ্জ গণকবর ও দৈবজ্ঞহাটি গণকবর।
২৬শে মে বুধবার দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডার পঞ্চকরণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগ নেতা মোক্তার আলী খান তার বাহিনী ও পিরোজপুর ক্যাম্পের পাকবাহিনীকে নিয়ে তেলিগাতী স্কুলে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করে। কমান্ডার ছলেমান খান খোকনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালান। এক পর্যায়ে মোক্তার আলী খান মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে আহত এবং তার ভাই রাজাকার মুনসুর খানের স্ত্রী নিহত হয়। তেলিগাতী যুদ্ধ-এ দুই সহোদর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার খান ও আব্দুল মন্নান খান শহীদ হন। ২৯শে জুন মঙ্গলবার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল রেহেন খানের বাড়িতে অবস্থান করছিল। দৈবজ্ঞহাটি ক্যাম্পের রাজাকাররা খবর পেয়ে তাদের ওপর আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে গুলি বিনিময় চলে। ৭ই আগস্ট শনিবার পাকসেনা ও রাজাকাররা পুনরায় তেলিগাতীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে। কমান্ডার ছলেমানের বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। সারাদিন উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। এ যুদ্ধে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
১৭ই মে সোমবার দিবাগত রাতে মুক্তিযোদ্ধারা মোড়েলগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। কমান্ডার কবির আহমেদ মধুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তিন দিক থেকে রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করলে রাজাকাররাও পাল্টা গুলি চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে এক পর্যায়ে রাজাকাররা অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবুবকর ছিদ্দিক শহীদ হন। এটি মোড়েলগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ১৫ই আগস্ট সুন্দরবন সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিতীয়বার মোড়েলগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। রাজাকাররাও পাল্টা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে সারারাত যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শতাধিক রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে, বেশ কয়েকজন আহত এবং বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মোড়েলগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প যুদ্ধে এ সি লাহা হাইস্কুলের বিএসসি শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম মুকুল এবং ভান্ডারিয়ার মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব হোসেন গুরুতর আহত হন। এ যুদ্ধে শতাধিক রাইফেল ও প্রচুর গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
১৯শে সেপ্টেম্বর ৮ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল দৈবজ্ঞহাটি খালে রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালান। উভয় পক্ষের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ গুলি বিনিময় চলে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সুধীর কুমার সাহা শহীদ এবং শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ ও সরদার মতিন আহত হন। এটি দৈবজ্ঞহাটি খালকুলার যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ৯ই অক্টোবর রাতে বঙ্গবন্ধু কোম্পানি কমান্ডার নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। রাজাকাররাও পাল্টা গুলি চালায়। সারারাত দুপক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্প যুদ্ধ-এ ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। ৩রা নভেম্বর রাত ৯টায় মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে রাতভর গোলাগুলি হয়। এ যুদ্ধে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
২৪শে সেপ্টেম্বর রাত ৩টায় কবির আহমেদ মধু ও আমজাদ হোসেন মল্লিকের নেতৃত্বে ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা খাদ্যসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনার উদ্দেশ্যে একটি নৌকায় করে পল্লিমঙ্গল গ্রামের দিকে রওনা হন। তাঁরা ধানসাগর এলাকায় এলে রাজাকাররা তাঁদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। কিছুক্ষণ উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে ৩ জন রাজাকার নিহত এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। এটি ধানসাগর যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
৭ই নভেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমজাদ হোসেন মল্লিকের নেতৃত্বে ৭-৮ জন মুক্তিযোদ্ধা সরালিয়া গ্রামের রাস্তার পাশে এম্বুশ করেন। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা রেইঞ্জের মধ্যে আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাশফায়ার করেন। এতে ৩ জন রাজাকার নিহত হয় এবং পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে নয় বুঝতে পেরে তারা মোড়েলগঞ্জে ফিরে যায়। এটি সরালিয়া অপারেশন হিসেবে পরিচিত।
১৩ই নভেম্বর রাজাপুর গ্রামে পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি বড় দলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সুন্দরবন পশ্চিমাঞ্চলের সহকারী কমান্ডার খালিদ হোসেন এবং মোড়েলগঞ্জের কমান্ডার আমজাদ হোসেন মল্লিক। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রাশফায়ারে বেশ কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনা ও রাজাকাররা শরণখোলার দিকে পালিয়ে যায়। এটি রাজাপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৩ই ডিসেম্বর মোড়েলগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- আলী আহমেদ খান, বীর প্রতীক (পিতা মুসলেম আলী খান, বারুইখালী)। মোড়েলগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সৈয়দ আজিয়র রহমান (পিতা সৈয়দ আশ্রাব আলী, সোনাখালি), মোসলেম আলী (পিতা মো. হামেদ আলী হাওলাদার, সুতালড়ী), আবু বকর ছিদ্দিক (মোড়েলগঞ্জ), খান নজরুল ইসলাম (পিতা খান সোহরাব হোসেন, মহিষচরনী), সুধীর কুমার সাহা (পিতা পূর্ণ চরণ সাহা, জয়পুর), আব্দুল ওহাব (পিতা আব্দুল হামিদ শেখ, তেলিগাতী), আব্দুল মন্নান খান (পিতা সুরাত আলী খান, তেলিগাতী), আবুল বাশার খান (পিতা আব্দুর রহমান খান, তেলিগাতী), আব্দুল মান্নান খান (পিতা জব্বার খান, তেলিগাতী), আব্দুস ছালাম মৃধা (পিতা আব্দুর রাজ্জাক মৃধা, ভাটখালী), মোহাম্মদ উল্লাহ ভূঁইয়া (পিতা ওবাইদুল হক, মোড়েলগঞ্জ), আব্দুল লতিফ মল্লিক (পিতা তোফেল উদ্দিন মল্লিক, কেসরামপুর), মনোরঞ্জন ডাকুয়া (পিতা কালীচরণ ডাকুয়া, মিত্রডাঙ্গা), আনসার আলী খলিফা (পিতা আয়েজ উদ্দিন খলিফা, সরালিয়া), শান্তি রঞ্জন দাস (পিতা রাধেশ্যাম দাস, মোড়েলগঞ্জ), বুরজুক আলী শেখ (পিতা হাসেন উদ্দিন শেখ, গজারিয়া), শেখ জয়নাল আবেদিন (পিতা মো. ইউসুফ আলী, তেলিগাতী), সাহেব আলী (পিতা আফছার আলী, ভাইজোড়া), সেকান্দার আলী বেপারী (পিতা আব্দুল কাদের বেপারী, তেলিগাতী), গোলাম মোস্তফা শেখ (পিতা শরবত আলী, পুটিখালী), জমির শেখ (পিতা জব্বার আলী শেখ, তেলিগাতী), জুলমত আলী খান (পিতা ভেমর আলী খান, বারইখালী), আব্দুল জব্বার খান (পিতা সুরাত খান, তেলিগাতী)।
পানগুছি নদীর পাড়ে ছোলমবাড়ীয়া খোয়াঘাটে ২০১৩ সালে স্থানীয় খেয়াঘাট মাঝি সমিতির উদ্যোগে একটি ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার লিয়াকত আলী খানের উদ্যোগে মোড়েলগঞ্জ উপজেলা চত্বরে ৭ বীরশ্রেষ্ঠের প্রতিকৃতি ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকাসহ একটি ‘মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলক’ নির্মিত হয়েছে। নব্বই রশি বাসস্ট্যান্ডে একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ রয়েছে। বারইখালী ব্রিজের নিকট নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ ‘বিজয়’ স্তম্ভ। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে এখানে কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— শহীদ আবু স্মৃতি সড়ক, শহীদ মোসলেম আলী সড়ক, শহীদ সাহেব আলী সড়ক, মধু মিয়া সড়ক, নুর মিয়া সড়ক এবং শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক। [শেখ মো. মশিউর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!