You dont have javascript enabled! Please enable it! কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবউদ্দিন - সংগ্রামের নোটবুক

কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবউদ্দিন

মো. সাহাবউদ্দিন (শহীদ ১৯৭১) কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ও সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ। অসীম সাহসী, অকুতোভয় ও দেশমুক্তির নেশায় উন্মত্ত এ কিশোর মুক্তিযোদ্ধার পিতার নাম সাবু প্রধান এবং মাতা সাহেরা খাতুন। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের খুজেখানি গ্রামে তাঁর জন্ম। মাত্র ৬ মাস বয়সে তিনি পিতা-মাতাকে হারান। বড় বোন জামেনা খাতুন তাঁকে লালন-পালন করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে গোসিংগা প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে গোসিংগা হাইস্কুলে ভর্তি হন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে অনেকে যখন বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে গৃহত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন ১৪ বছরের তরুণ সাহাবউদ্দিনও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ ফকির, সামসুল হক, হাবিবুল্লাহ ফকির, আলাউদ্দিন খান প্রমুখ সাহাবউদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগ্রহ দেখে তাঁকে অনুপ্রেরণা যোগান। তাঁদের দলের সঙ্গে সাহাবউদ্দিন কুমিল্লা হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হাপানিয়া
শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় নেন। বয়সে কম এবং শারীরিক গঠনে ছোট ছিপছিপে থাকায় প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচকরা তাঁকে নির্বাচিত করতে চাননি। ওসি নুরুদ্দিনের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত সাহাবউদ্দিন ভারতের অম্পিনগর সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৩০ দিনের প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ পান। প্রশিক্ষণ শেষে দলের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সাহাবউদ্দিনও দেশে ফিরে আসেন। তাঁকে সাইকেল দিয়ে রেকি করার কাজেই বেশি ব্যবহার করা হতো।
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর রেলস্টেশন ও রাজেন্দ্রপুর স্টেশনের মধ্যবর্তী ইজ্জতপুর স্টেশনের দক্ষিণে পারুলী নদীর তীর ঘেঁষে পাটপঁচা ব্রিজ নামক স্থানে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এখান থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহের রেল যোগাযোগের সুবিধার কারণে এখানে ৮৫ জন সেনাসদস্য নিয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা এ ক্যাম্পটি স্থাপন করে এবং আশপাশের অঞ্চলগুলোতে অত্যাচার ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ক্যাম্পটিকে ধ্বংস করার জন্য প্রহ্লাদপুর ও শ্রীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তিনদিক থেকে গুলি চালাতেন। এরই মধ্যে একদিন প্লাটুন কমান্ডার এম এ কাদের (প্রহ্লাদপুর), আব্দুল বারেক (শ্রীপুর), মোবারক হোসেন (মাওনা), হাজী জয়নাল আবেদীন মোড়ল (গোসিংগা), মিয়ার উদ্দিন (ইজ্জতপুর), হযরত আলী, আজিজুল হক, মাহবুবুর রহমান ফকির, আবু সাঈদ, বাবর আলী সরদার ও কমান্ডার মতিউর রহমান মিলে এ ক্যাম্পটিতে চূড়ান্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। আক্রমণের তারিখ নির্ধারিত হয় ৬ই ডিসেম্বর। আক্রমণে ৬৫ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্থানীয় লোকজন অংশগ্রহণ করেন। কিশোর সাহাবউদ্দিনও এ দলের সঙ্গে ছিলেন।
প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা এবং স্থানীয় লোকজন ইজ্জতপুর পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের চতুর্দিক থেকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হন। শহীদ সাহাবউদ্দিনের দলটি ছিল এম্বুশে এবং তাঁদের ব্যাকআপে পেছনে ছিল আরেকটি দল। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। পূর্বাকাশে সূর্য ওঠা পর্যন্ত দুপক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই চলে। অবশেষে পাকিস্তানি সেনাদের ভারী অস্ত্র এবং কামানের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে গণনা করে দেখেন তাঁদের একজনের উপস্থিতি কম। দেখা গেল, কিশোর সাহাবউদ্দিন তাঁদের সঙ্গে ফিরে আসেননি। আরো খোঁজাখুজির পর জানা গেল সম্মুখ যুদ্ধে সাহাবউদ্দিন শহীদ হয়েছেন।
৬-৭ই ডিসেম্বর ইজ্জতপুর যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার এবং রাজাকারদের ৬ জন নিহত হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মারমুখী আক্রমণে ৮ই ডিসেম্বর ইজ্জতপুর ক্যাম্প ছেড়ে পাকিস্তানি বাহিনী শ্রীপুর ক্যাম্পে চলে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একটি স্পেশাল ট্রেনে করে শ্রীপুর থেকে রাজেন্দ্রপুর পর্যন্ত বিরতিহীন টহল, বিক্ষিপ্তভাবে গোলা, শেল এবং বোমা বর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ সাহাবউদ্দিনের লাশ উদ্ধার করতে পারছিলেন না। হানাদারদের টহল ট্রেন রুখে দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা তাজউদ্দিন ও মোবারক হোসেন মাইন বসিয়ে ব্রিজ ধ্বংসের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। তখনো পাকিস্তানি সেনাদের স্পেশাল ট্রেন চলাচল অব্যাহত ছিল। ট্রেনে চলমান বাহিনীর সঙ্গে দফায়-দফায় গুলি বিনিময় হতে থাকে। এদিকে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করে ১১ই ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ ফকিরের নেতৃত্বে আকবর আলী, আফাজউদ্দিন ও নাজিমউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় মাটিচাপা দেয়া শহীদ সাহাবউদ্দিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এদিন রাত ৯টায় গোসিংগা হাইস্কুল মাঠের এক কর্নারে তাঁকে সমাহিত করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সাহাবউদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর নামে শ্রীপুর- গোসিংগা সড়ক এবং উপজেলা সদরে একটি শিশুকাননের নামকরণ করা হয়েছে। [মো. নূরুন্নবী আকন্দ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড