বীর প্রতীক মো. সিদ্দিক
মো. সিদ্দিক, বীর প্রতীক (১৯৪২-২০০৫) অনারারি ক্যাপ্টেন ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪২ সালের ২৪শে জানুয়ারি ভোলা জেলার সদর উপজেলার চরনোয়াবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলবি গোলাম রহমান এবং মাতার নাম উম্মে কুলসুম।
মো. সিদ্দিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। এ রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ এ রেজিমেন্টর বেশির ভাগ বাঙালি সেনাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ২৫শে মার্চের পূর্বে সেনাননিবাসের বাইরে মোতায়েন করে। ২৫শে মার্চ মো. সিদ্দিককে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাঠিয়ে দেয়া হয়। একই দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে মো. সিদ্দিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলিকৃত মেজর শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রমএর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রথমদিকে ক্যাপ্টেন এম এ মতিনের নেতৃত্বে তিনি চট্টগ্রাম জেলার মাস্তাননগর ও মিরশ্বরাইয়ে যুদ্ধ করেন। ২০শে এপ্রিল সকালে মিরশ্বরাইয়ে অবস্থানকালে হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ তিনি প্রতিহত করেন। এ-সময় পলায়নরত শত্রুদের একটি গুলি তাঁর বাম কাঁধে বিদ্ধ হয়। এতে তিনি পিছপা না হয়ে আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। এখানকার যুদ্ধ শেষে সহযোদ্ধাদের সহযোগিতায় আগরতলা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করে তিনি সুস্থ হন। পরবর্তীতে তিনি প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন।
সীমান্তের ওপারে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের দলনেতা লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবির চৌধুরী গোপন সূত্রে খবর পান যে, পাকিস্তানি সৈনদের একটি দল চন্দ্রপুর- লাতুমুড়ার দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি হানাদার বাহিনীর এ দলটিকে এম্বুশ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সহযোদ্ধাদের ৩টি উপদলে বিভক্ত করে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এর একটি দলে ছিলেন মো. সিদ্দিক। ২২শে জুন সকালে পাকিস্তানি বাহিনী এম্বুশের ৫০-১০০ গজের মধ্যে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠে। আকস্মিক আক্রমণে হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এতে ৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। হানাদার বাহিনী সংগঠিত হয়ে পুনরায় অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে মো. সিদ্দিক ও তাঁর সহযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করেন। এরপর হানাদার বাহিনী লাতুমুড়ার উত্তরে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। ২৪শে জুন হানাদার বাহিনী যখন প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরিতে ব্যস্ত, তখন মো. সিদ্দিক ও তাঁর দল তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। এ আক্রমণে আরো কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। চন্দ্রপুর-লাতুমুড়া যুদ্ধে মো. সিদ্দিক যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
১১ই নভেম্বর সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা সিলেট জেলার কানাইঘাট এলাকায় অবস্থানকালে হানাদার বাহিনীর আকস্মিক হামলার শিকার হন। এতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কিন্তু সাইদুর রহমান তাঁর দৃঢ়চেতা মনোভাব নিয়ে তাঁর হাতে থাকা চায়না হালকা মেশিনগান দিয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেন। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং একজনকে মুক্তিযোদ্ধারা জীবিত ধরে ক্যাম্পে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. সিদ্দিককে ‘বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বহাল হন এবং অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে চাকরি থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেন। ২০০৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৫ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড