You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সিদ্দিকুর রহমান

মো. সিদ্দিকুর রহমান, হাইকমান্ড (জন্ম ১৯৪৪) বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৪৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার দেউলা ইউনিয়নের বড়পাতা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল হক হাওলাদার এবং মাতার নাম জমিলা খাতুন। তিনি বোরহানউদ্দিন ও লালমোহনে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশুনা করে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ছুটি নিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভোলায় নিজ গ্রামে আসেন, আর ফিরে যাননি। মার্চ মাসে বোরহানউদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং ভোলার এসডিও-র নিকট থেকে অস্ত্র নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এমপিএ মোশাররফ হোসেন শাহজাহানের নিকট থেকে একটি লঞ্চ নিয়ে তিনি পিরোজপুর যান এবং সেখানে মেজর জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। পিরোজপুর যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল পাকসেনাদের বড় শহরে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা, যাতে তারা ছোট শহর এবং গ্রাম এলাকায় সাধারণ মানুষ ও নারীদের ওপর নির্যাতন করতে না পারে। সেখান থেকে খুলনা গিয়ে তিনি মেজর এম এ জলিলের সাক্ষাৎ করেন এবং প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। এক পর্যায়ে তাঁরা খুলনা শহরের উপকণ্ঠে গল্লামারীতে অবস্থিত খুলনা রেডিও স্টেশন দখলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অপারেশনের কমান্ডার মনোনিত হন সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন, রেডিও স্টেশন আক্রমণের অধিনায়ক নির্বাচিত হন কমান্ডার নায়েক সিদ্দিকুর রহমান এবং সমন্বয়কারী শেখ কামরুজ্জামান টুকু। ৩রা এপ্রিল রাত ১২টার পর রেডিও স্টেশন দখল অভিযান শুরু হয়। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এ অভিযান সফল হতে পারেনি। এখানে হানাদারবাহিনীর গুলিতে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ভোর পর্যন্ত যুদ্ধ চলার পর মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে নিজেদের আশ্রয়ে ফিরে আসেন (দেখুন —গল্লামারী রেডিও স্টেশন অপারেশন )। খুলনা থেকে নায়েক সিদ্দিকুর রহমান বাগেরহাট গিয়ে শেখ মো. আব্দুর রহমান এমএনএ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ, রূপসার পাড় এবং স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করেন।
বাগেরহাট থেকে এক পর্যায়ে তিনি বরিশালে ফিরে যান। সেখান থেকে পটুয়াখালী গিয়ে বিহারিদের জেলে বন্দি করে বাঙালিদের জেল থেকে মুক্ত করেন। এপ্রিলের শেষদিকে মেজর এম এ জলিল, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ, আব্দুল জব্বার, ক্যাপ্টেন নাসির প্রমুখের সঙ্গে তিনি ভারতে যান। ভারত থেকে দুটি লঞ্চবোঝাই অস্ত্র নিয়ে ফেরার পথে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে সাতদিন পায়ে হেটে তিনি ভোলায় আসেন। ভোলায় এসে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন (দেখুন সিদ্দিক বাহিনী )।
মো. সিদ্দিকুর রহমান ও তাঁর বাহিনী ভোলায় একাধিক যুদ্ধে অংশ নেয়, যার মধ্যে ছিল ওসমানগঞ্জের যুদ্ধ (চরফ্যাশন), দেউলার যুদ্ধ (বোরহানউদ্দিন), বাংলা বাজারের যুদ্ধ (ভোলা) এবং বোরহানউদ্দিনের যুদ্ধ। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দেউলার যুদ্ধ। এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫ ও ১৬ই অক্টোবর। ১৫ তারিখের যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে এবং ১২টি অস্ত্র সিদ্দিক বাহিনীর হস্তগত হয়। ১৬ই অক্টোবর সংঘটিত হয় মূল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বহুসংখ্যক পাকসেনা নিহত হয়, ১০ জন রাজাকার ধরা পড়ে এবং ৪০টি অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ যুদ্ধের খবর দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি সমগ্র ভোলার মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার হিসেবে আবির্ভূত হন। আর এ সময় থেকেই তিনি সকলের নিকট হাইকমান্ড বা বাঘা সিদ্দিক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। ভোলার বিভিন্ন অঞ্চলের যুদ্ধে তাঁর সঙ্গে তাঁর বড়ভাই হাবিলদার শামসুল হক সার্বক্ষণিক যুদ্ধ করেন।
২২শে অক্টোবর লালমোহন থানা দখলের যুদ্ধে মো. সিদ্দিকুর রহমান নেতৃত্ব দেন। ৭ই ডিসেম্বর পটুয়াখালী মুক্ত দিবসে তিনি পটুয়াখালীতে অবস্থান করে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। স্বাধীনতার পর তিনি দুবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ৪ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের জনক। [হারুন-অর-রশিদ ও মনিরুজ্জামান শাহীন]
তথ্যসূত্র: মো. সিদ্দিকুর রহমানের ঢাকাস্থ মিরপুর ডিওএইচএস-এর বাসায় ২২-১০-২০১৫ তারিখে গৃহীত তাঁর সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য উৎস।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!