বীর প্রতীক মো. হাবিবুল আলম
মো. হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫০) ঢাকা ক্র্যাক প্লাটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৫০ সালে নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার পিরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. হাফিজুল আলম এবং মায়ের নাম ফাতেমা বেগম। তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে এসএসসি এবং ১৯৭০ সালে একই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন-এ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং মধ্যরাতের পরপর তাদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি এপ্রিলে গোপনে গৃহত্যাগ করে ২নং সেক্টরের মতিনগরে যান। এ সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম এর নেতৃত্বে মতিনগর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তিনি প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৭ জনের একটি দল নিয়ে তিনি ঢাকা শহরে ফিরে আসেন এবং বেশ কয়েকটি গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করে পাকহানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন।
পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ওপর হামলা পরিচালনা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। হাবিবুল আলমদের আত্মঘাতী গেরিলা দলটি মেজর এ টি এম হায়দারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত হয়। গেরিলাদের হামলা পরিচালনার আরো উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে আর্থিক সাহায্য প্রদান থেকে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা মিশন ও জাতিসংঘ উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানকে বিরত রাখা এবং বিশ্ববাসীকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা ও নির্যাতনের বিষয়ে সচেতন করা। ৯ই জুন হাবিবুল আলম তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশনে অংশ নেন। তাঁরা গ্রেনেড ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। এ অপারেশনের খবর বিবিসি এবং অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে প্রচারিত হয়। এ অপারেশনের পর গেরিলারা মেলাঘরে গেলে সেখানে তাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়। পরবর্তীতে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন ‘কে’ ফোর্সের সঙ্গে হাবিবুল আলমকে যুক্ত করা হয়।
হাবিবুল আলম খুব ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিখুঁত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে একের পর এক অপারেশন চালিয়ে ঢাকা শহরে অস্থিরতা সৃষ্টির পাশাপাশি পাকহানাদারদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলতে সক্ষম হন। এ বিষয়গুলো প্রচার মাধ্যমে প্রচার হতে থাকলে বিশ্ববাসী হানাদার কবলিত বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা জানতে ও বুঝতে সক্ষম হয়।
হাবিবুল আলমের ক্র্যাক প্লাটুন অপারেশন পেট্রল পাম্প, অপারেশন ফাইভ পাওয়ার সাবস্টেশন, অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট পরিচালনা করে। আত্মঘাতী এ দল ৯ই জুন ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছাড়াও ৯ই জুলাই হোম ইকনোমিক্স কলেজ সংলগ্ন নীলক্ষেত পেট্রল পাম্প, ১৯শে জুলাই ঢাকা শহরের পাঁচটি পাওয়ার স্টেশন, ৮ই আগস্ট ফার্মগেট সড়ক দ্বীপের পাকবাহিনী ক্যাম্প এবং ১১ই আগস্ট পুনরায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গেরিলা হামলা চালায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
উল্লেখ্য, হাবিবুল আলমের পিতা হাফিজুল আলম মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় সহযোগিতা করতেন। তাঁর ১/৩ দিলু রোডের বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নিরাপদ আশ্রয়। এ বাড়িতে তিনি একটি ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগার নির্মাণ করেন। হাবিবুল আলমের চার বোনের সহযোগিতায় হাতে বানানো পতাকা একাত্তরের আগস্টে অবরুদ্ধ ঢাকার আকাশে উড়েছিল। এছাড়াও অস্ত্র পরিষ্কার, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা এবং গ্রেনেড বহনের মতো দুঃসাহসী কাজগুলো তাঁর চার বোন মিলে করেছিলেন।
স্বাধীনতার পর হাবিবুল আলম ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায়ের পাশাপশি তিনি নিজেকে সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি বাংলাদেশ স্কাউটসের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি নিজ গ্রামে পিরুলিয়া হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। তিনি ব্রেথ অফ হার্ট নামক গ্রন্থের রচয়িতা। তিনি ১ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম তৌহিদা আলম। [জেবউননেছা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড